পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয় তখন বিশ্বব্যাপী সকলের ভাবনায় ছিলো বাঙালির ললাটে এখন স্পর্শিত সুখের পরশ। যোগ্য নেতৃত্বের হাতেই ছিলো স্বদেশ। কিন্তু সে সুখ আমাদের বেশি দিন আছন্ন করে রাখতে পারেনি। স্বাধীনতার মাত্র ৪ বছরের মধ্যে কিছু বিপথগামী সেনার বুলেটে রক্তাক্ত হয় জাতির জনকের দেহ। সেই সাথে রক্তাক্ত হয় এদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালোরাত্রিতে সপরিবারে শহীদ হন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। প্রবাসে থাকায় সেদিন প্রাণে রক্ষা পান জাতির জনকের কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা। সপরিবারে জাতির জনককে হত্যার পর ওই বছরের ৩ নভেম্বর ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের কেন্দ্রীয় কারাগারে সকল বিধি-বিধান উপেক্ষা করে সংঘটিত হয় ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাকান্ড। অথচ কারাগার হলো সবচেয়ে নিরাপদ স্থান।
বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজুদৌলার পরাজয় ও মৃত্যুর মাধ্যমে স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়। পলাশীর প্রান্তরে অধ্যায় রচনা কলঙ্কময় করেছিল যারা তারা ছিল নবাবের সহচর। নবাব সিরাজউদ্দৌলার সেনাপতি মোহন লালের নেতৃত্বে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন সে যুদ্ধে ব্রিটিশ বেনিয়া কো¤পানির সাথে গোপন বৈঠক করেন মীর জাফর আলী খান। নবাব এ কথা জেনেও মীর জাফরের কৃতকর্মের জন্য তাকে ক্ষমা করেছিলেন। কিন্তু বিশ্বাসঘাতক মীর জাফর, রায় দুর্লভ, ইয়ার লতিফ নবাবের বিরুদ্ধে গিয়ে এবং কো¤পানির হয়ে কাজ করে ইতিহাসের পাতায় নিজেদের নাম বিশ্বাসঘাতক হিসেবে পরিচিত করেছে।
অপরদিকে বাংলাদেশ স্বাধীনতার ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাই, মহান মুক্তিযুদ্ধে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে তাঁর একান্ত সহচর এবং এদেশের ৭ কোটি মুক্তিপাগল মানুষের আত্মত্যাগ ও প্রচেষ্টার ফলে স্বাধীনতা অর্জিত হয়। দেশ স্বাধীন হবার পর থেকে নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় আমাদের।
বঙ্গবন্ধুর সাথে যারা রাজনীতি করতেন তাদের মধ্যে খন্দকার মোশতাক আহমেদ ছিলেন অন্যতম। ইতিহাসের ঘৃণ্য ব্যক্তি খন্দকার মোশতাক আহমেদ তার রাজনৈতিক জীবনের শুরুতে বঙ্গবন্ধুকে প্রতিদ্ব›দ্বী হিসেবে ভাবতেন। বঙ্গবন্ধুও জানতেন সবকিছু। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর হৃদয় ছিল সাগরের মতো বিশাল। উদার বঙ্গবন্ধু খন্দকার মোশতাককে সব জানার পরও ক্ষমা করেন এবং আওয়ামী লীগের একজন কর্মী হিসেবে তাকে রাজনীতি করার সুযোগ দেন। দলীয় রাজনীতি করার সুবাধে খন্দকার মোশতাক জাতির জনকের কাছাকাছি আসার সুযোগ পেয়ে যান। মুখে জাতির জনকের প্রতি তার আনুগত্য প্রকাশ করলেও অন্তরে ছিলো তার ঘৃণ্য পরিকল্পনা। তিনি দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠেন। এর ফলস্বরূপ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে তাঁর পরিবারসহ নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে তাঁর রক্তের সিঁড়ি বেয়ে খন্দকার মোশতাক ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তিনি সেনাবাহিনীর একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ, বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিপরিষদ থেকে কিছু সদস্য এবং স্বাধীনতা বিরোধীদের তথা পাকিস্তানি এজেন্টদের নিয়ে একটি জোট করেন। এ জোট ক্ষমতা গ্রহণ করেই জাতির জনকের হত্যার এক সপ্তাহের মধ্যে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও জাতীয় চার নেতা যথাক্রমে বাংলাদেশের প্রথম সরকারের উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ. এইচ. এম. কামারুজ্জামান এবং অর্থমন্ত্রী এম. মনসুর আলীকে গ্রেপ্তার করে। জাতীয় এ চার নেতাকে কারাগারে আটক রেখে মন্ত্রিত্বের প্রলোভন দেখালেও তারা বাঙালি জাতির জনকের রক্তের উপর পা দিয়ে মোশতাকের সাথে হাত মেলাতে অস্বীকৃতি জানান। মোশতাকের ধারণা ছিল, বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে যারা একটি দেশ স্বাধীন করতে পারে তারা তার সরকারকে উৎখাত করবেই। এজন্য প্রায় আড়াই মাস কারাগারে আটক রাখার পর মোশতাক সরকার ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর নাজিমউদ্দীন রোডের কেন্দ্রীয় কারাগারে ৫ জন সেনা সদস্যকে প্রেরণ করে, যারা সবচেয়ে নিরাপদ স্থানে সকল বিধি বিধান উপেক্ষা করে ইতিহাসের বর্বর হত্যাকান্ড পরিচালনা করে। কেন্দ্রীয় কারা কর্তৃপক্ষ প্রথমে জাতীয় চার নেতাকে হত্যায় বাধা প্রদান করলেও রাত ৩টার সময় বঙ্গভবন থেকে কর্নেল রশিদের ফোন আসে কারা কর্তৃপক্ষের কাছে। ফোনে জাতীয় চার নেতাকে হত্যায় সহযোগিতা করতে কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেয় কর্নেল রশিদ। কারা কর্তৃপক্ষ রাষ্ট্রপতির সাথে কথা বলতে চাইলে পাশ থেকে নির্দেশ আসে ‘তাদের কাজ করতে দাও’। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘাতকের বুলেটের আঘাতে জাতীয় চার নেতার শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়। তাজউদ্দীন আহমদ এবং এ.এইচ.এম. কামারুজ্জামানকে বেওনেট চার্জ করে তাদের শরীরকে ক্ষত-বিক্ষত করা হয়। মৃত্যুর পূর্বে তাজউদ্দীন আহমদ পানি পিপাসায় কাতরালেও ঘাতকেরা কোনো দয়া দেখায়নি। জেলের মধ্যে হত্যাকান্ড হয়েছিল বলে এটিকে ইতিহাসের বর্বরতম ‘জেল হত্যা’ বলা হয়। জাতির জনককে হত্যার মধ্য দিয়ে খুনিরা ভেবেছিল শুধু বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলেই তাদের কাক্সিক্ষত উদ্দেশ্য সফল হবে না। উদ্দেশ্য সফল করতে এবং আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব শূন্য করতে হলে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করতে হবে। ঘাতকরা তাই করেছিল।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর ঢাকা ছিল এক অস্থিরতার নগরী। তখনো ঢাকাসহ সারাদেশে এক থমথমে ভাব। এ অবস্থায় ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর রাত দেড়টার দিকে ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডস্থ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে একটি পিকআপ এসে থামে। সে গাড়িতে ছিলো বেশ কয়েকজন সেনা সদস্য। ওই সেনা সদস্যরা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আসার পর কারা মহাপরিদর্শক টেলিফোন করে তৎকালীন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার আমিনুর রহমান তাৎক্ষণিকভাবে আসতে বলেন। তিনি দ্রুত কারাগারের মূল ফটকে গিয়ে দেখলেন একটি পিকআপে কয়েকজন সেনা সদস্য সশস্ত্র অবস্থায় বসে আছে। কারাগারের মূল ফটকের সামনেই সেনা সদস্যরা কারা মহাপরিদর্শককে একটি কাগজ দেয়।
২০১০ সালে বিবিসি বাংলার কাছে সে ঘটনার বর্ণনা দেন জেলার আমিনুর রহমান। তাঁর বর্ণনায়, কারাগারের মূল ফটক দিয়ে ঢুকে বাম দিকেই ছিল তাঁর কক্ষ। তখন সেখানকার টেলিফোনটি বেজে উঠে। তিনি যখন টেলিফোনের রিসিভারটি তুললেন তখন অপর প্রান্ত থেকে বলা হলো প্রেসিডেন্ট কথা বলবেন। পরে টেলিফোনে বলা হলো প্রেসিডেন্ট কথা বলবেন আইজি সাহেবের সাথে। তখন তিনি দৌড়ে গিয়ে আইজি সাহেবকে খবর দিলেন। কথা শেষে আইজি সাহেব বললেন যে প্রেসিডেন্ট সাহেব ফোনে বলছে, আর্মি অফিসাররা যা চায়, সেটা তোমরা কর। এরই মধ্যে রাত তিনটা বেজে যায়। এক পর্যায়ে জাতীয় চার নেতাকে একত্রিত করার আদেশ আসে। কারা মহাপরিদর্শক একটি কাগজে জাতীয় চার নেতার নাম লিখে জেলার আমিনুর রহমানকে দিলেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং তাজউদ্দীন আহমদ কারাগারের একটি কক্ষে ছিলেন। ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং এএইচএম কামরুজ্জামানকে অপর কক্ষ থেকে এখানে নিয়ে আসা হয়। সেখানে আসার আগে ক্যাপ্টেন মনসুর আলী কাপড় পাল্টে নেন। তাজউদ্দীন সাহেব তখন কোরআন শরীফ পড়ছিলেন। ওনারা কেউ কারা কর্তৃপক্ষকে জিজ্ঞেস করলেন না আমাদের কোথায় নেওয়া হচ্ছে? সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব হাত-মুখ ধুয়ে নিলেন। এরপর চার জাতীয় নেতাকে একত্রিত করার পর সেনা সদস্যরা গুলি চালিয়ে ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে তাদের নির্মমভাবে হত্যা করে।
জাতীয় চার নেতাকে কারা হত্যা করেছিল? কারা এ হত্যাকান্ডের অন্যতম পৃৃষ্টপোষক ছিল? জাতীয় চার নেতার বর্বরোচিত হত্যাকান্ডের ফলে কারা সুযোগ গ্রহণ করেছিল এবং এ হত্যাকান্ডের বিচারে কারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বাধা প্রদান করেছিল তা সকলের সামনে দিবালোকের মতো পরিষ্কার। ইতিহাস তাঁদের ক্ষমা করবে না, করতে পারে না। ইতিহাসের বর্বরোচিত এ হত্যাকান্ডের হোতারা সাধারণ মানুষের কাছে ঘৃণ্য ব্যক্তি হিসেবে পরিগণিত। আজকের এই দিনে আমাদের মহান স্বাধীনতার অন্যতম কান্ডারী জাতীয় চার নেতাকে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি।
লেখক: গণমাধ্যকর্মী ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।