Inqilab Logo

শক্রবার ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ কার্তিক ১৪৩১, ০৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রাজনীতিবিদদের পেশা এবং তাদের আচরণ

কামরুল হাসান দর্পণ | প্রকাশের সময় : ২ নভেম্বর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

রাজনীতি কি এবং কেন করতে হয়? আমাদের দেশের রাজনীতির যে ধারা চলছে, এ প্রেক্ষাপটে এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। রাজনীতির সংজ্ঞা ব্যাপক এবং বিশ্লেষণ সাপেক্ষ ব্যাপার। এর যেমন পুস্তকীয় সঙ্গা রয়েছে, তেমনি অতি সরল সঙ্গাও রয়েছে। পুস্তকীয় ভাষায় রাজনীতির মূল কথা হচ্ছে, একটি রাষ্ট্র কীভাবে চলবে, তার সাংবিধানিক কাঠামো কী হবে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। এসব সিদ্ধান্তের মধ্যে অনেক জটিল বিষয়-আসয় থাকে। সেগুলো সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা সহজ নয়। এগুলো গবেষণার বিষয়। এ জন্য রাষ্ট্র বিজ্ঞান নামে পড়ালেখার আলাদা বিষয় রয়েছে। তবে রাজনীতি বলতে সাধারণ মানুষ যা বোঝে তা হচ্ছে, এটি তাদের এবং সকলের কল্যাণের নীতি। তারা বোঝে, এর মাধ্যমে রাষ্ট্র তাদের কল্যাণে কাজ করে এবং সবসময়ই করবে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশের মান-সম্মান এবং ভাবমর্যাদা উজ্জ্বল করার ক্ষেত্রেও রাজনীতি কাজ করবে। আমাদের দেশের রাজনীতি এবং এর ধারা কেমন তা সাধারণ মানুষ কম-বেশি জানে। স্বাভাবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে তারা বোঝে, রাজনীতি তাদের কল্যাণে খুব কমই ব্যবহৃত হয়। এটা মূলত তাদের জন্যই যারা দল গঠন করে এ নীতি অবলম্বনের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতায় যেতে এবং থাকতে চায়। ক্ষমতায় যাওয়া এবং থাকার জন্য তারা এর নানারকম কলা কৌশল অবলম্বন করে। যদিও প্রত্যেকটি দলেরই লক্ষ্য রাজনীতির মাধ্যমে জনগণের কল্যাণে নিবেদিত হয়ে কাজ করা, তবে এর প্রকৃত প্রতিফলন খুব কম দেখা যায়। মুখে মুখে তারা সভা-সমাবেশ করে জনগণের কল্যাণ করার অজস্র প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে। যেসব রাজনৈতিক দল ক্ষমতার বাইরে তারাও ক্ষমতায় গিয়ে দেশ ও জনগণের জন্য কী করবে তার অসংখ্য ফিরিস্তি তুলে ধরে। আর যারা ক্ষমতায় থাকে তারা দেশ ও জনগণের জন্য কী করছে, তারও অসংখ্য উদাহরণ তুলে ধরে। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। বিরোধী দলের নেতা-কর্মী ও সমর্থকরা ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিকে সমালোচনা করে প্রত্যাখ্যান করে, অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী ও সমর্থকরাও বিরোধী দলের রাজনীতিকে উড়িয়ে দেয়। রাজনীতিতে পারস্পরিক এই বিরোধিতা স্বাভাবিক হলেও আমাদের দেশে এর ব্যতিক্রম দেখা যায়। এখানে ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দল একে অপরকে শত্রুজ্ঞান করে। একে অপরকে দ্ইু চোখে দেখতে পারে না। 

দুই.
রাজনীতি সাধারণত ক্ষমতামুখী। এর লক্ষ্যই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে দেশ ও জনগণের সেবা করা। সমস্যা হচ্ছে, আমাদের দেশের রাজনীতিতে এ ধারাটি ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হয় না। এখানে রাজনীতি বলতে একে অপরকে মেরে কেটে কিংবা রাজনীতির নানা অপকৌশলের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়াই মূল লক্ষ্য হয়ে উঠে। রাজনৈতিক দলগুলো মুখে মুখে জনগণের অধিকার কিংবা সেবা করার রাজনীতির কথা বললেও তাদের মানসিকতার নেপথ্যে থাকে ক্ষমতা ভোগ করা। দলগুলোর নেতা-কর্মীদের মানসিকতাই এমন যে, ক্ষমতায় যেতে পারলে তাদের জীবন বদলে যাবে। বাস্তবে তাই হচ্ছে। দেখা গেছে, যে দলই ক্ষমতায় যায়, তার অনেক নেতা-কর্মী রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হয়ে ওঠে। বিপুল ধন-সম্পদের মালিক হয়ে যায়। আমরা যদি বর্তমানের দিকে তাকাই, তাহলে দেখব, ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের অনেকে কী অগাধ ধন সম্পদের মালিক হয়েছেন! দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরুর পর ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গ সংগঠনের শীর্ষ পর্যায়ের অনেক নেতার যে ধন-সম্পদের হিসাব প্রকাশিত হয়েছে, তা থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না রাজনীতি এবং এর ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে তারা এই বিপুল বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়েছেন। একেকজন রাজনৈতিক সংগঠনের পোস্ট-পদবির ক্ষমতা ব্যবহার করে, কেউ ক্যাডার বাহিনী গড়ে তুলে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন। অথচ রাজনীতি শুরুর প্রাক্কালে তাদের অনেকে অত্যন্ত দীনহীন অবস্থায় ছিলেন। কালক্রমে রাজনৈতিক অপব্যবহার এবং দুর্বৃত্তায়ণের মাধ্যমে তারা এই সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন। অথচ স্বাভাবিকভাবে তাদের রাজনীতি হওয়ার কথা ছিল জনকল্যাণমুখী। তা না করে নিজেদের আখের গোছানোতেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে। জনকল্যাণের পরিবর্তে উল্টো জনগণের কাছ থেকে চাঁদাবাজি, হুমকি-ধমকি, ভয়-ভীতি দেখিয়ে অর্থ আদায় করে। জনগণ তাদের কাছে জিম্মি হয়ে থাকে। রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের রাজনীতি কি এমন হওয়ার কথা? এখন ক্ষমতাসীন দলের অনেকেই রাজনীতির মূল লক্ষ্য থেকে সরে গিয়ে জনসাধারণের পকেট থেকে অর্থ আদায়ের মাধ্যমে নিজেরা লাভবান হয়েছে। তা নাহলে, ক্ষমতাসীন দলের যেসব নেতা ইতোমধ্যে ধরা পড়েছে এবং তাদের যে সম্পদের পরিমাণ, তা কি বৈধ পথে হয়েছে? অনেকে বলছেন, যারা ধরা পড়েছেন, তারা রাজনৈতিক এই দুর্বৃত্তায়ণের ক্ষুদ্রাংশ মাত্র। এর বাইরে আরও অসংখ্য নেতা-কর্মী রয়েছে। প্রত্যেক এলাকার জনগণ তাদের ক্ষমতাসীন দলের এসব নেতা-কর্মী সম্পর্কে ভাল করেই জানে। যে জনকল্যাণের রাজনীতির জন্য এসব নেতা-কর্মীর দল ক্ষমতাসীন হয়েছে, তারা কি তা কখনো উপলব্ধি করেন বা করছেন? অবশ্য এসব নেতা-কর্মীদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। আমাদের দেশের রাজনীতিই এমন যে, একজন সাধারণ মানুষও জানে, ক্ষমতায় যাওয়া মানেই ক্ষমতাসীন দলের লোকজনের অবস্থার পরিবর্তন হওয়া। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে একেকজনের কোটিপতি হওয়া। সুদীর্ঘকাল ধরেই সাধারণ মানুষ দেশে রাজনীতির এই অপসংস্কৃতি দেখে আসছে। তারা মেনেই নিয়েছে, এটাই আমাদের রাজনীতি। একেক দল ক্ষমতাসীন হবে, আর তাদের লোকজনের অবস্থার পরিবর্তন হবে-আমাদের কিছু হবে না। তারা খেয়ে-পরে কিছু থাকলে, তা তাদের কপালে জুটলেও জুটতে পারে। ফলে সাধারণ মানুষ রাজনীতি থেকে তেমন কিছু আসা করে না। তারা নিজেরাই নিজেদের জীবনযাপন উন্নত করতে সংগ্রাম করে যায়। এতে সরকারের যতটুকু অবদান থাকার কথা তার ছিঁটেফোটা হয়তো যুক্ত হয়। তবে যেভাবে যুক্ত হলে জীবনযাপন আরও সহজ হয়ে যেত, সেভাবে যুক্ত হয় না। সরকারের বেশিরভাগ সুবিধা সরকারি দলের লোকজনরাই পেয়ে থাকে। তারা এতটাই সুবিধা পায় যে, অর্থ রাখা বা খরচ করার জায়গা খুঁজে পায় না। ফলে বিচিত্র উপায়ে অর্থ খরচের পথ খুঁজে। এই যে অর্থ খরচের জন্য ক্যাসিনোতে জুয়া খেলা এবং রাতের মধ্যে লাখ লাখ টাকা উড়িয়ে দেয়া-এটা আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষেরই অজানা ছিল। এই খেলায় বেশিরভাগই রাজনীতির সাথে যুক্ত কিংবা রাজনৈতিক প্রভাবে প্রভাবিত। তার অর্থ হচ্ছে, রাজনীতির অপব্যবহারের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ দিয়ে তারা আমোদ-ফূর্তি করতেন। এমনকি ক্যাসিনো খেলার জন্য সপ্তাহন্তে বিদেশেও চলে যেতেন।
তিন.
একজন রাজনীতিবিদের পেশা কি? কে রাজনীতি করেন এবং এতে যুক্ত হন? এ প্রশ্নের উত্তরে বল যায়, রাজনীতিবিদদের নির্দিষ্ট কোনো পেশা নেই। যে কেউ যে কোনো পেশায় থেকে তার পছন্দের রাজনৈতিক দলের নীতি ও আদর্শ অনুযায়ী রাজনীতিতে যুক্ত হন। তাল লক্ষ্য থাকে, এই নীতি ও আদর্শের অনুসারি হয়ে জনসেবা করা। এর মাধ্যমে অর্থকড়ি রোজগারের সুযোগ নেই। জনসেবায় বা পরের তরে নিজেকে উৎসর্গ করাই রাজনীতির অন্যতম লক্ষ্য। হ্যাঁ, এর মাধ্যমে উপার্জনের সুযোগ রয়েছে। এ সুযোগ হচ্ছে, জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হয়ে মন্ত্রী-এমপি হওয়া। সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়া। এতে রাষ্ট্রের বিধান অনুযায়ী একজন মন্ত্রী কিংবা এমপি সরকারের নির্দিষ্ট মেয়াদ কালে বেতন-ভাতা, বাসস্থানসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পাওয়া। একজন রাজনীতিবিদ বা নিঃস্বার্থ জনসেবকের জন্য এ সুযোগ-সুবিধা যথেষ্ট। এদের বাইরে যারা রাজনীতিতে জড়িয়ে থাকেন, তাদেরকে জনসেবামূলক কাজেই ব্যস্ত থাকতে হয়। এছাড়া রাজনৈতিক দলগুলো পরিচালনা করার জন্য দলের সদস্য থেকে শুরু করে বিভিন্ন দাতা সংস্থার অনুদান গ্রহণের মাধ্যমে খরচ মিটানো হয়। সাদা দৃষ্টিতে রাজনীতির মূল ধারাটাই এমন হওয়ার কথা। আমাদের দেশে রাজনীতির স্বাভাবিক এই ধারা বলতে কিছু নেই। এখানে রাজনীতি যারা করেন এবং যুক্ত হন, তাদের লক্ষ্যই থাকে রাজনীতি মানেই ক্ষমতাবান হওয়া এবং ক্ষমতা ব্যবহার করে বিত্তশালী হওয়া। বিশেষ করে যারা ক্ষমতায় থাকে, তাদের এ লক্ষ্য পূরণ সহজেই হয়। বিরোধী দলে যারা থাকে, তাদের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে কামাই রোজগার করা কঠিন হয়ে পড়ে। তাদের অনেকেই আশায় থাকে, ক্ষমতায় গেলে তারাও বিত্তবান হতে পারবে। অর্থাৎ আমাদের দেশের রাজনৈতিক ধারাকে এমন করে ফেলা হয়েছে যে, রাজনীতি মানেই ক্ষমতাবান হওয়া এবং এর মাধ্যমে নিজেদের ভাগ্যের পরিবর্তন করা। এই ধারার ফলে আদর্শ রাজনীতি বা জনকল্যাণমুখী রাজনীতি তিরোহিত হয়ে গেছে। রাজনীতিকে ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হওয়ার নীতিতে পরিণত করা হয়েছে। ফলে এতে ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে ধনী ব্যক্তিরাও যুক্ত হয়েছে এবং হচ্ছে। ভাবা যায়, আমাদের দেশের সংসদে জনপ্রতিনিধিদের শতকরা পঞ্চাশ ভাগের বেশি ব্যবসায়ী! এদের বেশিরভাগই অর্থ শক্তির মাধ্যমে নির্বাচিত হয়েছেন! অর্থাৎ তাদের নেপথ্যের লক্ষ্যই হচ্ছে, তাদের বিপুল অর্থ-বিত্তকে ক্ষমতার ব্যবহারের মাধ্যমে আরও বৃদ্ধি করা। আবার নির্বাচিতদের অনেকের নির্বাচিত হওয়ার আগে যে সহায়-সম্পদ ছিল তার দ্বিগুণ-তিনগুণ বা তারও বেশি অর্থ সম্পদের মালিক হয়েছেন। অনেকে শিল্পপতি হয়েছেন। মন্ত্রী-এমপিরা সরকারি যে বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পান, তার মাধ্যমে শিল্পপতি হওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তাদের লক্ষ্যও তা হওয়ার কথা নয়। অথচ আমরা দেখছি, ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতা-কর্মী এমনকি এমপি কোটিপতি হয়েছেন। তার নজির পাওয়া যায়, সম্প্রতি সংসদ সদস্যসহ অনেকের ব্যাংক হিসাব তলব ও বিদেশ যাওয়ার নিষেধাজ্ঞা দেয়া থেকে। তারা যদি সৎ হতেন এবং সততার সাথে অর্থ-বিত্তের মালিক হতেন, তাহলে কি তাদের ব্যাংক হিসাব তলব বা দেশ ত্যাগের নিষেধাজ্ঞা দেয়া হতো? এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, তারা রাজনীতি ও ক্ষমতাকে ব্যবহার করে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন। ভাবা যায়, একজন রাজনীতিবিদ যার তেমন কিছুই ছিল না, অথচ এমপি হয়েই শিল্পপতি হয়ে গেছেন। তার এলাকার মানুষের তেমন কোনো উন্নতি না হলেও তার ঠিকই উন্নতি হয়েছে। তার রাজনৈতিক লক্ষ্য যে, জনসেবা ছিল না, কেবল নিজের উন্নতি ছিল-এ থেকে বিষয়টি স্পষ্ট হয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, বিগত এক দশকে ক্ষমতাসীন দল এবং তার জোটের অনেক নেতা-কর্মী, মন্ত্রী-এমপি জিরো থেকে হিরো হয়েছেন। অঢেল ধন-সম্পদের মালিক হয়েছেন। আমরা দেখেছি, ক্ষমতাসীন জোটের এক বাম নেতা মন্ত্রী হয়েছিলেন। মন্ত্রী হওয়ার পর পত্র-পত্রিকায় তার অতি সাধারণ জীবনযাপনের বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরা হয়। এমনকি তার সংসার চালাতেও রীতিমতো হিমশিম খেতে হতো। তিনি যে এলাকায় থাকতেন সে এলাকার দোকানপাট থেকে চাল, ডাল, তেলসহ অন্যান্য পণ্য বাকিতে নিতেন। বাসার আসবাবপত্রের অবস্থা ছিল অত্যন্ত করুণ। এমন সাদাসিধা জীবন এবং তার সততারও দারুণ প্রশংসিত হয়। দেখা গেল তিনি যখন মন্ত্রী হলেন, ধীরে ধীরে তার অবস্থার পরিবর্তন হয়ে গেল। অনেকটা কোটিপতি হয়ে গেলেন। তিনি যে বাম রাজনীতি এবং মেহনতি মানুষের রাজনীতি করতেন, সেই মেহনতি মানুষের উন্নতি না হলেও তার নিজের ব্যাপক উন্নতি হয়। অবশ্য এ সরকারের পরবর্তী মেয়াদে মন্ত্রীসভায় তার জায়গা হয়নি। এভাবে দেখা যায়, ক্ষমতাসীন জোটের বাম নেতৃবৃন্দের কেউ কেউ মন্ত্রী হয়ে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। কারো কারো নাম ক্যাসিনোকান্ডের সাথেও জড়িয়েছে। অর্থাৎ ক্ষমতার মোহ এবং এর আকর্ষণের কাছে আমাদের দেশের অনেক রাজনীতিকের সততা বিলীন হয়ে গেছে। বিরোধী দলেও যে এ ধারা রয়েছে, তাও আমরা দেখেছি। অথচ বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রের অনেক প্রেসিডেন্ট বিশ্ব শাসন করে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিয়ে সাধারণ জীবনযাপন করেন। কেউ কেউ বিদায় নেয়ার পরপরই চাকরি খোঁজা শুরু করেন। ক্ষমতা থেকে বিদায় নেয়ার কিছুদিনের মধ্যেই বারাক ওবামাকে জীবিকার জন্য চাকরি খুঁজতে দেখা গেছে। তার আগের প্রেসিডেন্টরা বিভিন্ন সংস্থার দূত হিসেবে কাজ করেছেন। বিশ্বের ধনী ও ক্ষমতাধর দেশের প্রেসিডেন্ট বা রাজনীতিকদের পক্ষে কি তাদের ব্যক্তিগত ধন সম্পদ অর্জন করা কঠিন ছিল? মোটেই না। তারা ইচ্ছা করলে তা করতে পারতেন। তারা সত্যিকার অর্থেই দেশ ও জনগণের সেবার মনোভাব নিয়ে রাজনীতি করেছেন। বলা বাহুল্য, আমাদের মতো উন্নয়নকামী দেশের উন্নতির জন্য এ ধরনের সৎ রাজনীতি ও রাজনীতিক সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল।
চার.
রাজনীতিকদের তো এমন হওয়ার কথা, যারা নিঃস্বার্থ হয়ে এবং নিজেকে বিলিয়ে জনসেবা করবেন। তিনি হবেন কষ্টি পাথরের মতো। যে কষ্টি পাথরের ছোঁয়ায় সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হবে। একজন রাজনীতিকের লক্ষ্যই তো মানুষের সেবা করে ভালবাসা অর্জন করা। এটাই তার বড় সম্পদ। দুঃখের বিষয়, আমাদের অধিকাংশ রাজনীতিক এ সম্পদ অর্জনের চেয়ে আর্থিক সম্পদ অর্জনকেই রাজনীতির মূল লক্ষ্য করে নিয়েছেন। তারা মানুষের ভালবাসা চান না। ভালবাসা দিয়ে মন ও পেট ভরাতে চান না। অথচ রাজনীতির নিগূঢ় তাৎপর্যই হচ্ছে, জনসেবা ও মানুষের ভালবাসা অর্জনের মাধ্যমে প্রশান্তি লাভ করা। আমাদের দেশে যে রাজনীতির এমন ধারক-বাহক ছিলেন না, তা নয়। অনেকেই ছিলেন। তাদের সেই সৎ রাজনীতির পথ ধরে কোনো কোনো রাজনৈতিক দল কার্যক্রম চালালেও, তাদের সৎ রাজনীতির মধ্যে থাকতে পারেনি। তারা এমন ধারণা তৈরি করেছেন যে, রাজনীতি মানে জনসেবা নয়, ক্ষমতা ভোগ করা। মানুষের উন্নয়ন নয়, নিজেদের উন্নয়ন। এতদিন সাধারণ মানুষের কাছে ওপেন সিক্রেট ছিল ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতা রাজনীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে অঢেল ধন-সম্পদের মালিক হয়েছেন। গত প্রায় দেড় মাস ধরে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে যেসব নেতা-কর্মী, কাউন্সিলর ও প্রভাবশালী ব্যক্তি ধরা পড়েছেন এবং নাম প্রকাশিত হচ্ছে, তাতে এটি ওপেন হয়ে পড়েছে যে তারা রাজনৈতিকে দুর্বৃত্তায়ণের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। দেখতে ও শুনতে খারাপ লাগলেও এ ধরনের একটি অভিযানের বড়ই প্রয়োজন ছিল। অন্তত দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতির যে বল্গাহীন অপসংস্কৃতি চলছিল, তাতে কিছুটা হলেও ছেদ টানতে পেরেছে। রাজনীতিতে গডফাদারে পরিণত হওয়ারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকলেও, তাদের পিছু হটতে বা সচেতন হতে বাধ্য করেছে। রাজনীতিকে পরিশুদ্ধ করতে এ ধরনের অভিযানের বিকল্প নেই। আমরা আশা করব, এ অভিযানের জালে ধীরে ধীরে আরও বড় বড় রাঘব-বোয়ালরা ধরা পড়বে এবং তাদের রাজনীতিকে কঠিন করে তুলবে।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন