পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বাংলাদেশে পুকুরে মাছ চাষের ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বৈপ্লবিক সাফল্য অর্জিত হয়েছে। গত ৩৪ বছরে দেশে মাছের উৎপাদন বেড়েছে ৬ গুণ। এ সাফল্য অর্জনে পুকুরে মাছের চাষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এ সময়ে পুকুরে মাছের উৎপাদন বেড়েছে ১২ গুণের বেশি। দেশের ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মাছ চাষ ও এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। খাদ্যনীতিবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফুডপলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্যানুযায়ী, পুকুরে মাছ চাষে বাংলাদেশ সারা বিশ্বে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
দেশের দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে মৎস্য খাতের অবদান শীর্ষ তিনের মধ্যে রয়েছে। আর কর্মক্ষম মানুষের ২৩ শতাংশ এখন কোনো না কোনোভাবে মৎস্য খাতের সঙ্গে যুক্ত। বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু মাছ খাওয়ার পরিমাণ ১৯৯০ সালে ছিল বছরে সাড়ে ৭ কেজি, এখন তা ৪ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ৩০ কেজিতে পৌঁছেছে। মৎস্য অধিদফতরের হিসাবে, বাংলাদেশে ২০১৭-১৮ সালে মোট মাছের উৎপাদন হয় ৪২ লাখ ৭৬ হাজার ৬৪১ মেট্রিক টন। এর মধ্যে পুকুরে উৎপাদিত হয় ২৪ লাখ ৫ হাজার ৪১৫ টন। অথচ ১৯৮৩-৮৪ সালে পুকুরে মাছের উৎপাদন ছিল মাত্র ১ লাখ ৭৮ হাজার টন। দেশের ২৪টি জেলায় পুকুরে মাছের চাষ দ্রæত বেড়েছে। এর মধ্যে বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী, রংপুর, ময়মনসিংহ, গাজীপুর ও নেত্রকোনায় পুকুরে মাছের চাষ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। এসব জেলায় পুকুরে মাছ চাষ বছরে ১০ শতাংশ হারে বেড়েছে।
অন্যদিকে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ঘেরে মাছ চাষ গত দুই যুগে ২৪ শতাংশ কমেছে। সেখানেও পুকুরে মাছ চাষ জনপ্রিয় হচ্ছে। দেশে পুকুরে মাছ চাষ বৃদ্ধি নিঃসন্দেহে আশাজাগানিয়া ঘটনা। গত তিন যুগে দেশে পুকুরের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার বদলে কমেছে। তবে একসময় যেসব পুকুর ব্যবহার হতো শুধু গোসল করা, কাপড় ধোয়া ও বাসন পরিষ্কারের কাজে সেগুলোয় মাছ চাষের উদ্যোগ বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। তার পরও বলা যায়, পুকুরে মাছ চাষের যে সম্ভাবনা রয়েছে তার এক বড় অংশ এখনো অব্যবহৃত। গ্রামাঞ্চলে শক্রতামূলকভাবে প্রতিপক্ষের মাছের খামার বা পুকুরে বিষ ঢেলে মাছ নিধন করা কিংবা চুরি করে মাছ ধরা একটি নিয়মিত ব্যাপার। এসব দুষ্কর্ম রোধ করা গেলে অনেকেই পুকুরে মাছ চাষে উৎসাহী হবে এবং দেশের সার্বিক মাছ উৎপাদন আরও বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে।
দেশে চাকরিবাকরি নেই, তাই জায়গাজমি বিক্রি করে হলেও বিদেশে যেতে হবে, বহু বেকার তরুণ ও যুবক এই ভাবনা নিয়ে এখনো বসে আছেন। বিদেশে শ্রমিকের কাজ করতে যে টাকা লাগে, তাই দিয়ে দেশে বসেও যে ভালো কিছু করা সম্ভব, তা তাঁদের মাথায় খেলে না। এই বেকার শ্রেণির বোধোদয়ে পুকুরে মৎস্য চাষ উদ্দীপক হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারে।
নদ-নদী, হাওর-বাওর, বিল জলাশয়ের দেশ এই বাংলাদেশ। এখানে জালের মতো ছড়িয়ে আছে নদী, হাওর, বিল, ডোবা। সরকারি হিসেবে পাঁচ হাজার চারশত ৮৮ হেক্টর জলাশয় এবং ছয় শতাধিক হাওর রয়েছে সারাদেশে। এর মধ্যে মাত্র ২৯টি সরকারের মৎস্য উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের আওতায় রয়েছে। বাকিগুলো প্রভাবশালীদের কাছে বিভিন্ন সময় নামমাত্র মূল্যে ইজারা দেয়া হয়েছে।
দেখা গেছে, মৎস্যজীবী নয়, এমন ব্যক্তিও হাওর-জলাশয় ইজারা পেয়েছে। ফলে ইজারাগ্রহীতারা অনেক সময়ই হাওরকে নিজেদের ইচ্ছেমতো ব্যবহার করছে। এতে মৎস্য উৎপাদন তো বৃদ্ধি হচ্ছেই না বরং হাওর-বিলের জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। শুধু তাই নয়, হাওর-বিল ইজারা নিয়ে তা ভরাট করে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণের মতোও ঘটনা ঘটছে। অর্থাৎ বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় আমাদের হাওর বিল জলাশয় ভরাট হচ্ছে, ধ্বংস হচ্ছে মৎস্য ও জীববৈচিত্র্য।
জানা গেছে, চীন ও ভিয়েতনামে প্রতি হেক্টর জলাশয়ে মাছ উৎপাদন হচ্ছে কমপক্ষে দশ মেট্রিক টন। সেখানে বাংলাদেশে উৎপাদন হচ্ছে মাত্র এক মেট্রিক টন। বিশেষজ্ঞদের মতে, লাগসই প্রযুক্তি ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করে পরিকল্পিতভাবে বিল, হাওর ও জলাশয়সহ পুকুরে মাছ চাষ করা হলে প্রতি হেক্টরে কমপক্ষে পাঁচ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদন করা সম্ভব। শুধুমাত্র ছয়শ’টি হাওর-বাওরের ব্যবস্থাপনা উন্নত করে পরিকল্পিতভাবে মাছ উৎপাদন করা সম্ভব হলে দেশে মাছের কোনো ঘাটতি থাকবে না। সেই সঙ্গে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের সুযোগও সৃষ্টি হবে।
এখানে উল্লেখ করা জরুরি যে, আমাদের হাওর-বাওর, বিল-জলাশয়, নদী-নালা, খাল, পুকুর, ডোবা ক্রমাগত ভরাট হচ্ছে। প্রথমে এগুলোকে রক্ষা করতে হবে। প্রভাবশালী ভূমিখেকো চক্র যেগুলো দখল করে রেখেছে, তা উদ্ধার করতে হবে। মরে যাওয়া জলাশয়, পুকুর, ডোবা, বিল সংস্কার করতে হবে। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত হাওর-বাওর, জলাশয়গুলোতে কোনো তদারকি ছিলনা সরকারের। তখন এগুলোতে মৎস্য উৎপাদন হতো খুব সামান্য। কিন্তু এর পর থেকে এগুলোকে সরকারি ব্যবস্থাপনায় নেয়া হলেও মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য যথাযথ পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে না। প্রতি বছর মৎস্য সপ্তাহে হাওর-বাওর, জলাশয়ে বিপুল পরিমাণ মাছের পোনা অবমুক্ত করা হয়। এর ইতিবাচক ফলাফল কিছুটা পাওয়া যাচ্ছে বলেই অনেকে মনে করেন। এই ধারা অব্যাহত রাখার ওপর জোর দিতে হবে। যেহেতু দেশের জনসংখ্যা বাড়ছে, বাড়ছে মাছের চাহিদা। তাই মৎস্য উৎপাদন বাড়ানোর সুযোগগুলো কাজে লাগাতে হবে।
লেখক: সহ সভাপতি, এফবিসিসিআই, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড লিমিটেড।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।