Inqilab Logo

শনিবার ০২ নভেম্বর ২০২৪, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ২৯ রবিউস সানী ১৪৪৬ হিজরি

অনুকূল পরিবেশ পেলে অর্থনীতিকে এগিয়ে নেবে এসএমই খাত

ইআরএফের কর্মশালায় সালমান এফ রহমান

অর্থনৈতিক রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ২৮ অক্টোবর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বলেছেন, দেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পখাতের (এসএমই) বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। এ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে অনুকূল পরিবেশ জরুরি। আর এই পরিবেশ তৈরি করতেই কাজ করছে সরকার। একই সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের জন্য সব ধরনের সেবা এক ছাতার নিচে আনার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনে (বিসিক) ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস’ চালু করা হবে।
ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) এবং বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) আয়োজিত কর্মশালায় গতকাল প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এসব কথা বলেন। রাজধানীর পল্টনস্থ ইআরএফ কার্যালয়ে এ কর্মশালার আয়োজন করা হয়। ইআরএফ সভাপতি সাইফ ইসলাম দিলালের সভাপতি অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন শিল্পসচিব মো. আব্দুল হালিম, বিসিকের চেয়ারম্যান মো. মোশতাক হাসান, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ফার্স্ট সেক্রেটারি ম্যানফ্রেড ফ্রেনহোলজ এবং ইআরএফের সাধারণ সম্পাদক এসএম রাশেদুল ইসলাম। সালমান এফ রহমান বলেন, দেশে এসএমইখাতের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমানে গার্মেন্টসখাতের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্পের পরিসর ৭ বিলিয়ন ডলার। এর পুরোটাই এসএমই। এছাড়া এখাত থেকে ১ বিলিয়ন ডলার সরাসরি রফতানি হয়। অভ্যান্তরীণ বাজারেও এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। অথচ এক সময়ে ভিয়েতনামসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করতে হতো। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা বলেন, বিশ্ব ব্যাংকের ‘ডুয়িং বিজনেস’ সূচকে গত বছর বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৭৬ নম্বরে। আট ধাপ এগিয়ে এবার বাংলাদেশ উঠে এসেছে ১৯০ দেশের মধ্যে ১৬৮ নম্বরে। আগামী বছর সহজে ব্যবসা সূচকের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হবে। তিনি বলেন, আমরা টার্গেট করব যেন ডাবল ডিজিটে আসতে পারি। এ জন্য অন্যান্য সংস্থার মত বিসিকেও অতি দ্রæত ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু করা হবে। এছাড়াও আইটিখাতে ফ্রিল্যান্সের সম্ভাবনা ব্যাপক। বর্তমানে দেশে ৬ থেকে ৭ লাখ ফ্রিল্যান্সার রয়েছে। কিন্তু তাদেরকে সাপোর্ট দেয়ার মতো অবকাঠামো তৈরি হয়নি। কিন্তু চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য এই অবকাঠামো খুবই জরুরি।

সালমান এফ রহমান বলেন, দেশে ফ্রিল্যান্স বা আউটসোর্সিং করে অনেক যুবক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করলেও রেজিস্ট্রেশন না থাকায় সমাজে তাদের মর্যাদা দেয়া হয় না। তিনি বলেন, আমরা ফ্রিল্যান্সের রেজিস্ট্রেশন দেয়ার জন্য ডাটাবেজের কাজ শেষ করে এনেছি। আশা করছি আগামী জানুযারী থেকে তাদের রেজিস্ট্রেশনের আওতায় আনতে পারব। এ রেজিস্ট্রেশন কার্ড থাকলেই তার টাকা উঠাতে ব্যাংক কোনো প্রশ্ন করবে না। এ সনদ দিয়েই তারা অন্যান্য কাজ সহজেই করতে পারবেন। একই সঙ্গে বছরে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব বলে উল্লেখ করেন তিনি।

সালমান এফ রহমান বলেন, একদিন এক যুবক আমাকে এসে বললো আমি ফ্রিল্যান্সার। অস্ট্রেলিয়ার এক মহিলা তার প্রতিষ্ঠানের ওয়েব পেজ ডেভেলপ করে দেয়ার বিনিময়ে আমাকে ৫০০ ইউএস ডলার পেইড করেছেন। কিন্তু ব্যাংক আমাকে টাকা দিচ্ছে না। ব্যাংক জানতে চায় ওই মহিলার সাথে আমার সম্পর্ক কি, কেনো টাকা পাঠালো, এই সব। এছাড়া বিয়ের বাজার থেকে শুরু করে বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তি করতে গেলে নানা বিপত্তিতে পড়েন তারা। তাই ফ্রিল্যান্সারদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি চান তিনি। ‘অন্য একজন বলল, ফ্রিল্যান্স করে তিনি মাসে কয়েক লাখ টাকা আয় করেন। তারপরও নিয়মিত আয় নেই- এই অজুহাতে একটি ভালো স্কুল তার ছেলেকে ভর্তি নেয়নি।

প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা বলেন, এ ধরনের অনেক অভিযোগ পাওয়ার আমি আইসিটি প্রতিমন্ত্রীসহ বাংলাদেশ ও অন্যান্য ব্যাংকের প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠক করলাম। এরপর আমরা ফ্রিল্যান্সারদের একটি ডাটাবেজ করার উদ্যোগ গ্রহণ করি।

সালমান এফ রহমান বলেন, ডাটাবেজ শুরুর আগে আমাদের ধারণা ছিলো দেশে হয়তো ২/৩ লাখ ফ্রিল্যান্সার রয়েছে। কিন্তু এ কাজ করতে গিয়ে দেখলাম ফ্রিল্যান্সারের সংখ্যা ৬/৭ লাখ এবং এরা প্রতিবছর প্রচুর পরিমাণে রেমিট্যান্স আয় করছে। এর বেশির ভাগ আসে অবৈধ পথে। এদের বৈধতা দিলে বছরে ১ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স দেশে আসবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

বিশ্বব্যাংকের ব্যবসা সহজীকরণ (ইজ অব ডুয়িং বিজনেস) সূচকের বিষয়ে সালমান এফ রহমান বলেন, আমাদের অনেক অগ্রগতি হয়েছে। ব্যবসা সহজীকরণ সূচকে অনেক সংস্কার করেছি। কিন্তু কীভাবে বিশ্বব্যাংক স্কোরিং করে র‌্যাংকিং করে এসব বিষয়গুলো, আমরা ভালোভাবে বুঝিনি। যার ফলে আমরা রিফর্ম করলেও নম্বরটা পাইনি। তিনি বলেন, গত মার্চে বিশ্বব্যাংক বলল, এ বছরের র‌্যাংকিং এপ্রিল মাসের ভিত্তিতে হবে। আর এটা অক্টোবরে ঘোষণা করা হবে। আমরা ক্ষমতায় এসেছি জানুয়ারিতে, বুঝতে বুঝতে ফেব্রæয়ারি চলে গেল। তখন বিশ্বব্যাংক বলল, এবার আমাদেরই কিছুটা এগোতে হবে। কাজ শুরু করলাম।

এ কাজ করার উদাহরণ দিতে গিয়ে সালমান এফ রহমান বলেন, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) অনুমোদন নিতে গেলে ১৪-১৮ ধাপে অনুমোদন নেয়ার প্রয়োজন পড়ে। এটাকে আমরা কমিয়ে চার ধাপে নামিয়ে আনলাম। ভূমি সংশ্লিষ্ট নানা সংস্কার করা হলেও এগুলো ওয়েবসাইটে না দেয়ার কারণে আমরা নম্বর পাই না। পরে এসব তথ্য ওয়েবসাইটে দেয়ার ব্যবস্থা করা হলো। প্রধানমন্ত্রীর এই উপদেষ্টা বলেন, রাজউকের সংস্কারের বিষয়ে বিশ্বব্যাংক জারিপ চালালে রাজউক চেয়ারম্যান বললো, এটা সংস্কার হয়েছে। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে যে অফিসার অনুমোদন দেন, তিনি বলেন, আমি এ বিষয়ে কিছুই জানি না। সেখানেও আমার নম্বর হয়ে গেল শূন্য। তারপরও এবার আমরা কয়েক ধাপ এগিয়েছি। কিন্তু এটাতে আমরা সন্তুষ্ট নয়। আগামী বছর আমরা ডাবল ডিজিটে আসতে চাই।

অনুষ্ঠানে শিল্প সচিব আব্দুল হালিম বলেন, সরকারের পলিসিতে দেশের জাতীয় অর্থনীতিকে ২০৩০ সালের মধ্যে বিসিকের অবদান ৪০ শতাংশে নিয়ে যাওয়া। ইতোমধ্যে এসএমই’র অবদান ২৮ শতাংশ। যা আগে ছিল ২৫ শতাংশ। দিন দিন জাতীয় অর্থনীতিতে এমএমই’র অবদান বাড়ছে। বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ হলেও জাতীয় অর্থনীতিতে শিল্পের অবদান সবচেয়ে বেশি। ফলে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমাদের এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। তিনি বলেন, বিসিকের আওতায় চামড়াখাত এগিয়ে চলছে। বতর্মানে এখাতের রফতানি ১ বিলিয়ন ডলার। ২০২৪ সালের মধ্যে এটি ৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে।

আব্দুল হালিম বলেন, বর্তমান সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে দেশে দারিদ্র্য শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে কাজ করছে। একটা দেশের অতিদারিদ্র্য ৩ শতাংশে পৌঁছালে তাকে দারিদ্র্যমুক্ত দেশ বলা যায়। সেখানে আমাদের দেশে অতি দারিদ্র্য ১২ শতাংশ। এই দারিদ্র্য কমাতে সরকারের পাশাপাশি বিসিক কাজ করছে। বিসিকের মাধ্যমে আমরা যে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করছি যাতে আমাদের উৎপাদিত পণ্য দেশের বাইরে নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু বিসিকের বাজার ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা থাকায় সেটা করতে পারেনি। তাই বাজার ব্যবস্থাপনায় গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ বিসিক যে বাজার তৈরি করছে সেটা দেশের ভেতরে। তাই আমাদের বিদেশের বাজারে প্রবেশ করতে হবে। এজন্য প্রয়োজন দক্ষ জনবল। যাতে তারা দেশের তৈরি পণ্য বিদেশের বাজারে নিয়ে যেতে পারে।

ম্যানফ্রেড ফ্রেনহোলজ বলেন, অর্থনৈতিক দিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। কিন্তু বিভিন্ন সূচকে পিছিয়ে রয়েছে। যেমন বিশ্বব্যাংকের ডুইং বিজনেস রিপোর্টে সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৮। এছাড়াও প্রতিযোগিতা সক্ষমতা সূচক এবং ডিজিটাল সূচকেও পিছিয়ে বাংলাদেশ। তিনি বলেন, বর্তমানে দেশে ৪ কোটি মানুষ দরিদ্র সীমার নিচে। এদের উন্নয়নে এসএমই বিশাল ভূমিকা রাখতে পারে।

মো. মোশতাক হাসান বলেন, ২০৩০ সালের মধ্যে সরকার দেশে ৩ কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের ঘোষণা দিয়েছে। আশা করছি, এর ১ কোটিই তৈরি হবে বিসিকের মাধ্যমে।

তিনি বলেন, আমরা ২০ হাজার একর জমিতে ৫০টি শিল্পনগরী তৈরির চেষ্টা করছি। এছাড়া প্রায় ১০ হাজার লোককে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। বর্তমানে বিসিক শিল্প নগরীতে সর্বোচ্চ এক হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ করেছে উদ্যোক্তারা। মো. মোশতাক হাসান বলেন, এসএমই উদ্যোক্তাদের সুযোগ না দিলে তারা অপরিকল্পিতভাবে শিল্প গড়ে উঠবে। যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। এজন্য দেশের আনাচে-কানাচে যে শিল্প নগরী ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, সেখানে উদ্যোক্তাদের প্লট দেয়া, ঋণের ব্যবস্থাসহ ব্যবসার সুযোগ দিতে হবে। গত ৬২ বছরে দেশে ৭৬টা শিল্প নগরীতে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার উদ্যোক্তাকে প্লট দেয়া হয়েছে। এতে সাড়ে ৮ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। এছাড়া দেশের রফতানি বাজারে বিসিকের অবদান ১০ শতাংশ। আমরা প্রায় ৬ বিলিয়ন মূল্যের পণ্য উৎপাদন করে থাকি। এর সিংহভাগই রফতানি করা হয়।

 



 

Show all comments
  • মশিউর ইসলাম ২৭ অক্টোবর, ২০১৯, ১২:৪৮ এএম says : 0
    দ্রুত অনকুল পরিবেশ তৈরি করা হোক। কারণ এসএমই খাতের অগ্রগতি হলে কর্মসংস্থান হবে।
    Total Reply(0) Reply
  • মিনহাজ উদ্দিন রিমন ২৭ অক্টোবর, ২০১৯, ১২:৫০ এএম says : 0
    উন্নত বিশ্বের অনেক দেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প দিয়ে বেশ এগিয়ে আছে। আমাদেরও এই খাতকে শক্তিশালী করে দেশের অথনীতির চাকা সচল করতে হবে।
    Total Reply(0) Reply
  • সাইফুল ইসলাম চঞ্চল ২৭ অক্টোবর, ২০১৯, ১২:৫১ এএম says : 0
    আমি আপনার সাথে একমত। এজন্য সরকারকে বলবো দ্রুত অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেন, আমরা বেকাররা আর বেকার থাকতে চাই না।
    Total Reply(0) Reply
  • মোঃ তোফায়েল হোসেন ২৭ অক্টোবর, ২০১৯, ১২:৫২ এএম says : 0
    এসএমই খাতের বিকাশ ঘটলে বাংলাদেশে লাখ লাখ বেকারের সংখ্যা অনেকটা কমে আসবে। ফলে অর্থনীতি এমনিতেই এগিয়ে যাবে।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সালমান এফ রহমান


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ