Inqilab Logo

সোমবার ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইন্টারনেটভিত্তিক অর্থনীতি ও তার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ

সরদার সিরাজ | প্রকাশের সময় : ২৭ অক্টোবর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

বর্তমান যুগ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির। এ ক্ষেত্রে যারা যত অগ্রগামী হচ্ছে, তারা তত উন্নতি করছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রধান বাহন ইন্টারনেট, যার কাজ সম্পাদিত হয় কম্পিউটার, ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোন দিয়ে। তাই এসব উপকরণ অত্যাধুনিক করার প্রতিযোগিতা চলছে। বাজারও রমরমা। জাপানের তোশিবা কোম্পানি সুপার-ফাস্ট কম্পিউটার উদ্ভাবন করেছে, যাতে ৯০ শতাংশের বেশি নির্ভুলতাসহ এক সেকেন্ডের দশ লক্ষ ভাগের একভাগ সময়ের মধ্যে ক্রয়াদেশ দেওয়া সম্ভব। এই কম্পিউটারে আর্থিক বিষয় ছাড়াও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় নিরাপদ পথ খুঁজে পাওয়া এবং শিল্প কাজে ব্যবহারের রোবটকে দক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। তোশিবার প্রকৌশলীরা বলেছেন, সুপার কম্পিউটারের চাইতেও অনেক বেশি দ্রুতগতির কোয়ান্টাম যন্ত্র আবিষ্কারের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা চলছে। তবে আকার বিশাল হওয়ার মতো অনেক সমস্যা এর রয়ে গেছে। তাঁদের সুপার-ফাস্ট কম্পিউটার কোয়ান্টাম মাত্রার কাছাকাছি আঁটসাঁট যন্ত্র। তদ্রুপ ইন্টারনেটের গতি বাড়ানোর জন্য নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। এর ব্যবহারকারী সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। অয়ারসোস্যাল’র তথ্য মতে, বর্তমানে বিশ্বে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৪.৪ বিলিয়ন। যা এক বছর আগের তুলনায় ৯% বেশি। এসব পরিচালনার জন্য দক্ষ লোক তৈরি করা হচ্ছে সব দেশেই। কারণ, ব্যক্তিগত, বিনোদন ছাড়াও দাপ্তরিক, যোগাযোগ, চিকিৎসা, ব্যাংকিং, যুদ্ধ, মিডিয়াসহ বিভিন্ন কর্ম হচ্ছে ইন্টারনেটভিত্তিক, যা ই-গভর্নমেন্ট বলে খ্যাত। এসব কাজের অনেক কিছু ওয়েব সাইটে প্রকাশ করা হয়। তাই ওয়েব সাইট খোলার সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইন্টারনেট লাইভ স্ট্যাটসের তথ্য মতে, চলতি বছরের ১৯ আগস্ট পর্যন্ত বিশ্বে মোট ওয়েবসাইটের সংখ্যা ছিল ১৭১ কোটি, যা ১৯৯২ সালে ছিল মাত্র ১০টি। ইন্টারনেট ভিত্তিক বাণিজ্যও চালু হয়েছে। যা ই-কমার্স বলে খ্যাত, এর বাজারও বিশাল এবং তা অনবরত স¤প্রসারিত হচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে আরো অনেক কিছুই সংঘটিত হবে এর মাধ্যমে।

কর্মক্ষেত্রে সনাতনী পদ্ধতির পরিবর্তন বা রূপান্তর ঘটছে প্রতিনিয়তই। যেমন: বাষ্প ইঞ্জিনের আবিষ্কারে শুরু হয়েছিল প্রথম শিল্প বিপ্লব, বিদ্যুতের উদ্ভাবনে হয়েছিল দ্বিতীয়টি আর কম্পিউটার-ইন্টারনেটের প্রচলনে তৃতীয় শিল্প বিপ্লব। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবটিক্স, মেশিন লার্নিং, ইন্টারনেট অব থিংকস, বায়োটেকনোলজির সঙ্গে অটোমেশন প্রযুক্তির মিশেলে একবিংশ শতাব্দিতে শুরু হয়েছে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব। ডেল জানাচ্ছে, ২০৩০ সালে এমন সব চাকরি থাকবে, যার ৮৫ ভাগেরই অস্তিত্ব নেই এখন। অনেকে চাকরি হারাবেন অটোমেশনের কারণে, আবার নতুন কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রও প্রস্তুত হবে। ২০৪০ সালে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথমবারের মতো পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সী একদল প্রজন্ম থাকবে, যারা ‘টেকনোলজিক্যালি সাউন্ড’। এদের জন্য হয়তো গড়ে উঠবে নতুন কোনো সার্ভিস, এখন যা কল্পনাতেও নেই। এই রুপান্তরের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে প্রয়োজন সার্বক্ষণিক হালনাগাদের দক্ষ জনবল।

ইন্টারনেটভিত্তিক কর্ম পরিচালনার জন্য আমাদের দেশে দক্ষ লোক ও উপকরণ তেমন নেই। যে যৎসামান্য লোক তৈরি হচ্ছে, তার বেশিরভাগ চলে যাচ্ছে বিদেশে। অন্যদিকে, বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে তেমন ধারণা নেই আমার। এ নিয়ে দেশে মিডিয়ায় তেমন খবরও প্রকাশিত হয় না। দেশের শিল্প-সাহিত্য ও রাজনীতিতেও তথৈবচ! শিক্ষা ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। দেশে আইটি পাঠ্যসূচি ভুক্ত করা হয়েছে বিদ্যালয়ে। কিন্তু তাতে বিপত্তি অনেক। যেসব বিদ্যালয়ে কম্পিউটার সরবরাহ করা হয়েছে, তার বেশিরভাগই ব্যবহার করার মতো তেমন দক্ষ লোক নেই। তাই প্যাকেটেই পড়ে রয়েছে। আইটি বিষয়েও বেশিরভাগ বিদ্যালয়ে দক্ষ শিক্ষক নেই। তদ্রুপ অবস্থা ব্যবসা-বাণিজ্যেও। কারণ, এসব কাজে যে দক্ষ লোকের প্রয়োজন, তার বিশাল ঘাটতি আছে। তাই ই-বিআইএন এর নম্বর ৯,১১,১৩ নম্বর নিয়ে মহা হযবরল সৃষ্টি হয়ে ভ্যাট আদায় কঠিন হয়ে পড়েছে। এসব নানা কারণে জাতি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মনস্ক হতে পারছে না। অথচ বর্তমানকালে এটা অপরিহার্য। সে লক্ষ্যে সংরক্ষিত তথ্য ভান্ডার থেকে কিছু তথ্য উপস্থাপন করার চেষ্টা করছি, যদি এতে দেশবাসীর কিছু কল্যাণ হয় সে আকাক্সক্ষায়।

আগেই বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী ইন্টারনেটভিত্তিক অর্থনীতির আকার বিশাল। গত ৩ অক্টোবর প্রকাশিত গুগল ও সিঙ্গাপুরের দুটি প্রতিষ্ঠানের যৌথ গবেষণা প্রতিবেদন মতে, দক্ষিণ-পূর্ব এশীয়দের মধ্যে অনলাইন সেবা ব্যবহার বাড়ছে। ফলে ২০২৫ সালে এ অঞ্চলের ইন্টারনেট অর্থনীতি ৩০ হাজার কোটি ডলার অতিক্রম করবে। তবে এই লক্ষ্য অর্জনে আগামী পাঁচ বছরে অনলাইন বাণিজ্যের হার ২০০% বাড়াতে হবে। গত চার বছরে এই খাতে অর্থনীতির পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ৩ গুণ। বিগত বছরে তরুণ ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মধ্যে অনলাইন ব্যাংকিংসহ ই-কমার্সে কেনাবেচা বেড়েছে। স্মার্টফোন সহজলভ্য হওয়ার পাশাপাশি টেলিকম সেবা বাড়ায় জনসংখ্যার বড় একটি অংশ বর্তমানে ইন্টারনেট ব্যবহার করছে এবং পাশাপাশি ডিজিটাল সেবার ওপর ভোক্তার আস্থা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। গত চার বছরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অনলাইন প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৩,৭০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ হয়েছে, যার বেশিরভাগই ফ্যাশন রিটেইলার প্রতিষ্ঠানগুলোতে। ২০১৫ সালে শুধু রাইড ভাগাভাগির খাতে অর্থনীতি ছিল ১,৩০০ কোটি ডলার। ২০২৫ সালে তা ৪ হাজার কোটিতে পরিণত হবে। ২০১৪ সালের পর থেকে এ অঞ্চলের গড় বৃদ্ধির হার ছিল ৫%, যা বিনিয়োগের ক্ষেত্র হিসেবে বৈশ্বিক অবস্থার চেয়ে অত্যন্ত লাভজনক। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পাঁচটি দেশ ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর ও ফিলিপাইনে প্রায় ৩৬ কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী রয়েছে, যা বিশ্বের মোট ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর ৯%। তবে ইন্টারনেট অর্থনীতির এ দ্রæত প্রবৃদ্ধির বিপরীতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কিছু সমস্যাও রয়েছে। যার অন্যতম হলো সরকারি বিধিনিষেধ ও দক্ষ কর্মীর অভাব। ই-কমার্সের অবস্থা যদি শুধুমাত্র দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলেই এত বিশাল হয়; তাহলে, সমগ্র এশিয়াতে আরও বেশি। ইউরোপ-আমেরিকায় তার চেয়েও বেশি। উল্লেখ্য যে, ইন্টারনেটভিত্তিক কর্ম ক্রমান্বয়ে ব্যাপক বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই বিশেষজ্ঞদের অভিমত-এই শতাব্দির মধ্য সময়েই বিশ্বের প্রায় সব কর্মই ইন্টারনেটভিত্তিক হবে।

ইন্টারনেটভিত্তিক কর্মের অন্যতম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, যার প্রধানতম হচ্ছে: ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার, লিঙ্কডইন বা হোয়াটসঅ্যাপ। এসবের কোটি কোটি গ্রাহক। যেমন: ডিসকর্ড-২৫ কোটি, পিন্টারেস্ট-২৬.৫ কোটি, স্ন্যাপচ্যাট-২৯.৪ কোটি, সিনা ওয়াইবো-৪৬.৫ কোটি, রেড্ডিট-৩৩ কোটি, কিউকিউ-৮২.৩ কোটি, ফেসবুক-২৩৫ কোটি, ইউটিউব-২০০ কোটি। অন্যদিকে, কারো সাহায্য ছাড়াই নির্দিষ্ট পথ পাড়ি দিতে পারে চালকবিহীন গাড়ি। ব্যস্ত রাস্তায় দুর্ঘটনা এড়াতে গাড়িগুলোতে বসানো হয় শক্তিশালী সেন্সর যুক্ত একাধিক ক্যামেরা। নিজেদের তৈরি গাড়িতে বসানো ক্যামেরা ও সেন্সরগুলো কীভাবে কাজ করে তা জানিয়েছে ফোর্ড। পাশাপাশি ক্যামেরা ও সেন্সরগুলোর ত্রুটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে শনাক্ত করতে নতুন প্রযুক্তিও উদ্ভাবন করেছে তারা। স্বাস্থ্যখাতেও নতুন দিগন্ত উম্মোচন করবে ফাইভ-জি প্রযুক্তি। একটি আধুনিক জরুরি চিকিৎসা সেবার ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে ফাইভ-জি। এতে থাকবে কানেক্টেড অ্যাম্বুলেন্স ও এআই সাপোর্টেড অ্যাপ্লিকেশন। যেমন: এআর, ভিআর এবং ড্রোন। যখন কোনো রোগী ফাইভ-জি সংযুক্ত অ্যাম্বুলেন্সে উঠবেন, কর্তব্যরত চিকিৎসক অ্যাম্বুলেন্সে থাকা চিকিৎসা উপকরণ দিয়ে রক্ত পরীক্ষা, ইসিজি পরীক্ষা অথবা বি-মোড স্ক্যানের মতো পরীক্ষাগুলি সম্পন্ন করতে পারবেন। এছাড়াও একই সময়ে, আহত ব্যক্তির প্রয়োজনীয় তথ্যাদি যেমন স্ক্যানকৃত ছবি, মেডিকেল সাইন এবং মেডিকেল রিপোর্ট হাসপাতালে পাঠানো যাবে। ফলে চিকিৎসকগণ সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাসহ অপারেশনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারবেন এবং এটি সময় বাঁচাবে, যা চিকিৎসার সাফল্যের হার বৃদ্ধি করবে। হুয়াওয়ের ডিরেক্টর উইলিয়াম ঝু বলেন, ফাইভ-জি প্রযুক্তির ক্ষেত্রে এখন খুব উপযুক্ত সময়। প্রথাগত কানেকশনের তুলনায় ফাইভ-জি আরও বেশি কাভারেজ, বেশি ব্যান্ডউইথ এবং কম ল্যাটেন্সিতে ইন্টারনেট দিতে সক্ষম। ফাইভ-জি প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে সাথে আরও অনেক ফাইভ-জি সম্বলিত অ্যাপ্লিকেশন আসবে, যা বদলে দেবে পৃথিবীকে। এছাড়াও, ফাইভ-জি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, আইটি এবং ক্লাউড মানুষ এবং সমাজের প্রাত্যহিক জীবন ব্যবস্থাকে উন্নীতকরণের মাধ্যমে পৃথিবীকে একটি সুন্দর বাসযোগ্য স্থান হিসেবে গড়ে তুলবে।

ইন্টারনেটভিত্তিক বিভিন্ন অপরাধও বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেমন: সাইবার অপরাধের শিকার হচ্ছেন অসংখ্য মানুষ এবং তা প্রতিদিনই। হ্যাকাররা প্রায়ই বিভিন্ন দেশে আক্রমণ চালিয়ে ব্যাপক ক্ষতি সাধন করছে। ব্যাংকের বিপুল টাকা নিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের তথ্য চুরি করছে। শিশুরাও ইন্টারনেটভিত্তিক গেমে আসক্ত হয়ে নানা ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআই পরিচালক ক্রিস্টোফার রে বলেছেন, ফেসবুক শিশু পর্নোগ্রাফির মঞ্চ হয়ে উঠতে পারে। ফেসবুক তাদের জনপ্রিয় মেসেজিং প্ল্যাটফর্ম ঘিরে যে এনক্রিপশন যুক্ত করার প্রস্তাব করেছে, এতে এটি অনলাইনে নিপীড়নকারী ও শিশু পর্নোগ্রাফির সঙ্গে যুক্ত দুর্বৃত্তদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হবে। গত ৫ অক্টোবর তিনি এসব কথা বলেন। ইন্টারনেটের মাধ্যমে পর্নো ছবি ব্যাপকভাবে প্রকাশিত হওয়ায় শিশুসহ অসংখ্য মানুষ বিপথগামী হচ্ছে। কম্পিউটার ও ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অফলাইনে পেনড্রাইভ কিংবা এক্সটার্নাল স্টোরেজ ডিভাইসের পাশাপাশি ইন্টারনেটেও ইমেইল কিংবা ওয়েবলিংক থেকেও আক্রান্ত হয় ভাইরাসে। অবশ্য, অ্যান্টি ভাইরাস সফটওয়্যারও আছে। এটা ব্যবহার করে ভাইরাসের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। এর বাজারও বিশাল। স্ট্যাটিসটা’র তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের শেষে সাইবার নিরাপত্তা সফটওয়্যার ও এ-সংক্রান্ত প্রযুক্তি পণ্যের বাজার দাঁড়িয়েছে ১৫১.৬৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যা ২০২৩ সালে হবে ২৮৪.২৬ বিলিয়ন ডলার। এই বিশাল বাজারের অংশীদার যে দেশ হতে পারবে, তার আর্থিক চেহারা পাল্টে যাবে।

বাংলাদেশেও ইন্টারনেটভিত্তিক কর্ম বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই ইন্টারনেটের ব্যবহার বাড়ছে। বিটিআরসি’র তথ্য মতে, গত ৩১ আগস্ট পর্যন্ত দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৯ কোটি ৮১ লাখ ৩৬ হাজার। ব্যান্ডউইথের ব্যবহারও বেড়েছে। বর্তমানে দেশে ১,৪০০ জিবিপিএস ব্যান্ডউইথ ব্যবহার হচ্ছে। অন্যদিকে, মোবাইল সংযোগ ১৫ কোটি ৫৮ লাখ ১০ হাজার বলে গত ১২ অক্টোবর এক দৈনিকে প্রকাশ। কিন্তু দেশে যে হারে ইন্টারনেটের ব্যবহার বাড়ছে,সে হারে এর গতি বাড়ছে না। ইন্টারনেট ডাউন লোডের স্পিডে সর্বনিম্ন গতি সম্পন্ন ৮৭টি দেশের তালিকায় দশম অবস্থানে বাংলাদেশ। এখানকার ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা ডাউন লোডে গড়ে ৫.৭ এমবিপিএস। অথচ দক্ষিণ কোরিয়ার ৫২.৪ এমবিপিএস। ওপেন সিগনাল ২০১৯ সালের জানুয়ারি-মার্চ’র ওপর পর্যালোচনা করে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। অবশ্য শহর ও গ্রামাঞ্চলের মানুষ ইন্টারনেটের মাধ্যমে সরকারের ৪০ ধরনের সেবা গ্রহণ করতে পারছেন। চালু হয়েছে-ই-কৃষি, ই-হেল্থসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অনেক সেবাই এখন মানুষ ঘরে বসেই পাচ্ছেন। বিচার বিভাগে ই-জুডিশিয়ারি প্রকল্পের অগ্রগতি ঘটেছে, বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম ডাটা সেন্টার নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে, এ্যাপস ও গেমিং ডেভেলপমেন্ট ইন্ডাস্ট্রি প্রকল্পের কাজ চলছে। মহেশখালীকে ডিজিটাল দ্বীপে রূপান্তর করা হয়েছে। সারাদেশে শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব তৈরি, ই-কমার্স নীতিমালা এবং ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট বাস্তবায়ন করা হয়েছে বিদায়ী বছরেই বলে গত ১২ অক্টোবর এক দৈনিকে প্রকাশ। এছাড়া, দেশে আধুনিক প্রযুক্তিভিত্তিক পরিবহন খাত গড়ে উঠছে। তার মধ্যে রাইড শেয়ারিং অন্যতম। বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় উবার, দেশীয় উদ্যোগ পাঠাও, পিকমি ও সহজের মতো প্রতিষ্ঠানের আবির্ভাব হয়েছে দেশে এবং ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। এ প্রতিষ্ঠানগুলো বিনিয়োগ, প্রশিক্ষণ, কর্মসংস্থান ইত্যাদি বৃদ্ধি করছে। অন্যদিক, আঙ্কটাড’র ডিজিটাল ইকোনমি রিপোর্ট-২০১৯ মতে, বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা বর্তমানে ডিজিটাল আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে বছরে প্রায় ১০ কোটি ডলার আয় করছে এবং ফ্রিল্যান্সারের সংখ্যা এখন পাঁচ লাখ। সাধারণত বিশ্বের বড় বড় কোম্পানি নানা ধরনের অ্যাপ্লিকেশন সফটওয়্যার থেকে শুরু করে ওয়েব ডিজাইন, গ্রাফিক্স ডিজাইন, ডাটাবেজ তৈরি, সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন, রিপোর্ট প্রসেসিংয়ের মতো কাজগুলো আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে করিয়ে থাকে। আগে বড় বড় কোম্পানি শুধু বিভিন্ন দেশের তৃতীয় আরেকটি কোম্পানিকে দিয়ে কাজ করাত। কিন্তু অনলাইন ব্যবস্থার অগ্রগতির কারণে এখন তারা অনলাইনেই তাদের কাজ দিচ্ছে। এ জন্য গড়ে উঠেছে একাধিক অনলাইন প্ল্যাটফর্ম। এসব প্ল্যাটফর্ম থেকে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কাজ খুঁজে নিচ্ছেন ফ্রিল্যান্সাররা। এজিলইঞ্জিনের তথ্য অনুযায়ী, এ মুহূর্তে ডিজিটাল আউটসোর্সিংয়ের বাজারের সবচেয়ে বেশি দখল রয়েছে ভারতের। আর প্রতি ঘণ্টা কাজের জন্য বিশ্ববাজারে সবচেয়ে বেশি মূল্য পান ব্রাজিলের ফ্রিল্যান্সাররা। আমাদের আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ গত ৮ অক্টোবর আর্মেনিয়ায় ডবিøউসিআইটি সভায় বলেছেন, বর্তমানে বাংলাদেশের আইসিটি খাতের আয় ১০০ কোটি ডলার। ২০২১ সাল নাগাদ এ আয় ৫০০ কোটি ডলারে উত্তীর্ণ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। আমরা প্রযুক্তির বিকেন্দ্রীকরণ করছি। এ জন্য দেশব্যাপী ২৮টি হাইটেক পার্ক করা হয়েছে। এডিবি’র ‘বাংলাদেশ : কম্পিউটার অ্যান্ড সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং টারশিয়ারি এডুকেশন ইন ২০১৮’ শীর্ষক প্রতিবেদন মতে, বাংলাদেশে প্রচলিত শিক্ষায় স্নাতক পাশ করা শিক্ষার্থীদের মাত্র ৪০% চাকরিতে নিয়োগ পেলেও কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং অথবা তথ্যপ্রযুক্তি খাতে শিক্ষিতদের চাকরিতে নিয়োগের হার ৭৭%। প্রচলিত শিক্ষায় উচ্চ শিক্ষিত এক-তৃতীয়াংশ তরুণ যেখানে এক থেকে দুই বছর বেকার থাকছেন, সেখানে কম্পিউটার সায়েন্সে পড়া ২০.৬% শিক্ষার্থী স্নাতক সম্পন্ন করার এক থেকে তিন মাসের মধ্যে চাকরি পেয়ে যাচ্ছেন। এসব ভাল উদ্যোগ। কিন্তু দেশে এই খাতে দক্ষ লোকের প্রচন্ড অভাব রয়েছে। বিশ্ব ব্যাংকের গ্লোবাল কম্পিটিটিভনেস রিপোর্ট-২০১৯ মতে, মোবাইল, টেলিফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহারসহ ইত্যাদি ক্ষেত্রে ১৪১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৮ (স্কোর ৩৯.১)। অথচ গত বছর এ অবস্থান ছিল ১০২ (স্কোর ৩৯.৮)। অর্থাৎ এক বছরে ছয় ধাপ পিছিয়েছে। তাই প্রয়োজন মোতাবেক দেশে দক্ষ লোক তৈরি করা আবশ্যক এবং তা স্বল্প সময়ের মধ্যেই। অপরদিকে, স¤প্রতি প্রকাশিত ‘বাংলাদেশে সাইবার অপরাধের প্রবণতা’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন মতে, ইন্টারনেটের সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী নারীদের ৬৮% সাইবার হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এছাড়া, প্রতিনিয়তই নানা ধরনের গুজব, প্রতারণা ও কুৎসা রটানোও ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। শিশুরা ইন্টারনেটে আসক্ত হয়ে নানা জটিল ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। গত ১০ অক্টোবর ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী বলেছেন, আমরা ২২ হাজার পর্নো সাইট বন্ধ করেছি। একই সঙ্গে ভুয়া সাইটও বন্ধ করেছি। উপরন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করেছে সরকার। এই আইনে সাইবার ক্রাইমের জন্য কঠিন শাস্তির বিধান রয়েছে। ইতোমধ্যেই এ আইনে কিছু মানুষের সাজাও হয়েছে। তবুও সাইবার ক্রাইম হ্রাস পাচ্ছে না। ওদিকে, দেশে ইন্টারনেট ভিত্তিক অর্থনীতির নিরাপত্তার প্রচন্ড অভাব রয়েছে। তাই প্রায়ই ব্যাংকের টাকা চুরি হয়ে যায়। বিজনেস সফটওয়্যার অ্যালায়েন্সের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৮ সালে বাংলাদেশের কম্পিউটারে ৮৪% নকল বা পাইরেটেড সফটওয়্যার ব্যবহৃত হয়। এ ক্ষেত্রে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। তাই সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা দরকার। এছাড়া, সাইবার অপরাধ দমন, পর্নো ছবি বন্ধ করা প্রয়োজন। সায়েন্স ফিকশনভিত্তিক শিল্প-সাহিত্য ব্যাপকভাবে চর্চা করা দরকার। শিশুদের ইন্টারনেট ভিত্তিক কর্ম থেকে যত দূরে রাখা যায় ততই কল্যাণ।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন