পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বর্বর জাতি মধ্যযুগে বিভিন্ন জনপদ আক্রমণ করে সেখানকার মানুষদের উপর অকথ্য অত্যাচারে জর্জরিত করতো আর সুযোগ পেলে তাদের যথাসর্বস্ব লুণ্ঠন করে নিতো। তাদের একমাত্র নীতি ছিল, জোর যার মুল্লুক তার। আজকের শিক্ষিত দুনিয়া এ বর্বর জাতির কার্যকলাপকে অসভ্যতার চরম নিদর্শন বলে অভিহিত করেছে। বর্বর জাতি কবেই অবলুপ্ত হয়ে গেছে। কিন্তু মনে হয়, তাদের মূল ধর্ম বর্বরতা যেন পরবর্তীকালের মানুষের রক্তে সঞ্চারিত করে দিয়ে গেছে। যুগে যুগে তাই দেখা গেছে, যখনই কিছু মানুষ তার বিকৃত স্বার্থ চরিতার্থ করতে বাধা পেয়েছে, তখনই সে তার প্রবৃত্তিতে পরিণত হওয়া বর্বরতার চরম প্রকাশ ঘটিয়েছে। আমাদের আশে পাশে মাঝে মাঝেই যেমন ছোটখাটো বর্বরকে দেখতে পেয়ে থাকি, তেমনি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তেও মস্ত সব বর্বরকে আমরা সময়ে সময়ে দেখেছি। চেঙ্গিস খাঁনকে দেখেছি, হিটলার-মুসোলিনীকেও দেখেছি। ইদানীংকালে অর্থাৎ প্রায় অর্ধশতক ধরে বিশ্ববাসী এমন এক মহাশক্তিকে দেখে আসছে যে, বিশ্বের নিরীহ শান্তিকামী ছোটখাটো দেশের উপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে হামলার মাধ্যমে সেসব জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার প্রয়াস চালিয়েছে। সে শক্তির নাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তারা ইরাকের উপর হামলা করে নিরীহ নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধকে হত্যা করে উল্লাস করেছে, ইরাক সভ্যতাকে ধ্বংস করেছে। আফগানিস্তানেও একই পরিণতি করেছে। অসংখ্য নারীকে করেছে বিধবা, পুত্রকন্যাকে করেছে পিতৃমাতৃহারা। মা-বাবার সামনে যুবতীদের ধর্ষণ করা ছাড়াও শারীরিক নির্যাতন করে হত্যা করেছে। মা-বাবা-ভাই-বোনদের সামনে যুবকদের বুকে গুলি করে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে। তার পরোক্ষ সহযোগিতায় ইসরাইল ফিলিস্তিনকে নিশ্চিহ্ন করার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। সেই ইসরাইলকে দিয়ে লেবানন আক্রমণ করিয়ে সে দেশের নিরীহ মানুষদেরকে হত্যা করেছে। তার প্রত্যক্ষ মদদে লিবিয়া ধ্বংস হয়েছে, গাদ্দাফী নিহত হয়েছেন। এসব মর্মান্তিক নির্যাতন ও হত্যায় আমেরিকা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। কিন্তু বিশ্বসংস্থা জাতিসংঘ নীরব।
অথচ, বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সাম্য এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। দেশে দেশে বিদ্যমান সংঘাত, সংঘর্ষ এবং যুদ্ধকে স্থায়ীভাবে বন্ধ করে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার জন্য জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠা হলেও বাস্তবতার নিরিখে জাতিসংঘ তার সেই সব উদ্দেশ্য পূরণে পুরোপুরি সফল হতে পারেনি। পরিমাপ করলে হয়তো ব্যর্থতার ভাগই বেশি হবে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে জাতিসংঘ ব্যবহৃত হয়েছে বৃহৎ রাষ্ট্রসমূহের আধিপত্য বিস্তারের হাতিয়ার হিসেবে। তাই যুদ্ধ-বিগ্রহ বন্ধ করার জন্য ১৯৪৫ সালে জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠা হলেও বিশ্ব থেকে যুদ্ধ বিগ্রহ বন্ধ হয়নি বরং বেড়েছে। বেড়েছে হিংসা, বৈষম্য, যুদ্ধ, সংঘাত, হানাহানি এবং প্রাণহানি। রাষ্ট্রসমূহের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা রক্ষার জন্য জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠা হলেও অনেক দেশ হারিয়েছে স্বাধীনতা, বরণ করেছে পরাধীনতা। ক্ষুদ্র এবং দুর্বল রাষ্ট্রসমূহ বৃহৎ রাষ্ট্রসমূহের পক্ষ থেকে আগ্রাসনের শিকার হয়েছে। এক্ষেত্রে জাতিসংঘ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। তাই বিশ্ব এখনো অশান্তি এবং অস্থিরতায় ভরা। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, যুদ্ধ এবং সংঘাতে জর্জরিত বিশ্ব এখন অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি নিরাপত্তাহীন। নিরপেক্ষ এবং যথাযথ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার কারণে জাতিসংঘের প্রতি বিশ্ববাসীর সৃষ্টি হয়েছে আস্থাহীনতা। জাতিসংঘ মূলত আস্থা সংকটে ভূগছে। তাই এর সংস্কার ও সম্প্রসারণের দাবি উঠছে। জাতিসংঘের কাছ থেকে বিশ্ববাসী আরো বেশি দায়িত্বশীল এবং গঠনমূলক ভূমিকা আশা করে।
বিশ্বেও বিভিন্ন দেশে চলমান যুদ্ধ-বিগ্রহ, জাতিগত নির্মূল অভিযানসহ নানা মাত্রার রাষ্ট্রীয় অপরাধের ঘটনা ঘটছে সেসব ঘটনা কিন্তু জাতিসংঘের নিষেধ উপেক্ষা করেই করা হচ্ছে। তালেবানদের শায়েস্তা বা নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে আফগানিস্তানে চালিয়েছে বর্বর হত্যাযজ্ঞ। আফগান সীমান্তের পাকিস্তান অংশে বার বার আক্রমণ চালিয়ে উস্কানি দিচ্ছে সে দেশকে। পাকিস্তানের অভ্যন্তরে বহুবার আক্রমণ চালিয়ে বেশ কিছু নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করেছে, ধ্বংস করেছে অনেক ঘর-বাড়ি, বিধ্বস্থ করেছে সাংস্কৃতিক অবকাঠামো, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। জাতিসংঘ কিন্তু এসব ব্যাপারে নীরব দর্শকের ভূমিকাই পালন করে চলেছে। ভাব দেখে মনে হয়, জাতিসংঘ মার্কিন প্রভ‚দের কাছে যেন অসহায় শিশুর মতোই। এদিকে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস পরিচালিত জনমত জরিপে লন্ডন থেকে রয়টার্স ও এএফপি এর পরিবেশিত এক খবরে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধ আল-কায়দাকে দুর্বল করতে পারেনি বরং তারা আরো শক্তিশালী করেছে। দেখা গেছে, খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই ৩৪ শতাংশ মানুষ মনে করে আল কায়দা দুর্বল হয়েছে, ২৬ শতাংশ মনে করছেন সন্ত্রাস বিরোধী এ যুদ্ধের কোনো কার্যকারিতা নেই এবং ৩৩ শতাংশ মনে করছে এ যুদ্ধ জঙ্গীদের আরো শক্তিশালী করছে। আবার ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, মেক্সিকো, ইটালি ও ব্রিটেনের ৪০ শতাংশ মানুষ মনে করে যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধ আল কায়দাকে শক্তিশালী করছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়েই মার্কিন প্রশাসনের চরিত্রের কুৎসিত রূপ সম্ভবত প্রথমবার স্পষ্টরূপে পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। লক্ষ লক্ষ জাপানির জীবন ও স¤পদ নিয়ে সেদিন ছেলেখেলা করেছিল মার্কিনীরা। তারপর থেকেই তারা অন্যের সর্বনাশের বিনিময়ে নিজের দেশের অস্বাভাবিক ধনতান্ত্রিক স্বার্থের খাতিরে দেশে দেশে গায়ের জোর প্রয়োগ করে চরম অসভ্যতা প্রকাশ করে এসেছে। পূর্ব এশিয়া, মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা, মধ্য ইউরোপ ও আফ্রিকার অনেক দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলিয়ে সেখানকার জনজীবনকে তছনছ করে দিয়েছে। এভাবেই তারা পারমাণবিক, রাসায়নিক ও জৈবিক অস্ত্রের যথেষ্ট প্রয়োগ করে হাজার হাজার শিশু ও বৃদ্ধসহ লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে, তাদের চিরপঙ্গু করেছে এবং স্বাভাবিক জীবনধারাকে বিধ্বস্ত ও বিপর্যস্থ করেছে। নৈতিকতার কোনো প্রশ্ন তাদের বিকৃত বাসনা তৃপ্ত করতে ও অসভ্য আচরণে বাধা দিতে পারেনি। ১৯৬৩ সালে কেনেডি প্রশাসনের উপদেষ্টা ডিন অ্যাচেসন ঠিকই বলেছিলেন, ‘আমেরিকার অবস্থান, স¤মান ও প্রভূত্বের প্রতি যে কোনো প্রত্যাহানের মোকাবিলার প্রশ্নে আমাদের কাছে নৈতিকতার কোনো মূল্য নেই।’ সারা বিশ্বের উপর প্রভূত্ব স্থাপন করার কথাটাই আসলে তার কাছে মূল প্রশ্ন।
আজ বিশ্বের আবাল বৃদ্ধবণিতা জেনে গেছে, আমেরিকা ব্রিটেনকে সঙ্গী করে ইরাক আক্রমণ করছে তার তেল ভান্ডারের দখল নিতে। ইরাক বিশ্বের মোট তেলের ষাট শতাংশের মালিক। আরব দুনিয়ার তেল উৎপাদক অধিকাংশ দেশ যেখানে আমেরিকার বগলদাবা হয়ে তাকে সস্তায় তেল রফতানি করতে বাধ্য হয়েছে, সেখানে ‘সমাজবাদী’ বা ‘বিলাসী’ সাদ্দাম প্রায় দেড় দশক ধরে তাকে এ ব্যাপারে বাগড়া দিয়ে আসছিলেন। তাই পুঁজিবাদ ও নব্য ঔপনিবেশিকতাবাদের প্রতিভ‚ যুদ্ধবাজ আমেরিকার এ বর্বরোচিত ইরাক আক্রমণ। সাদ্দামের উদারনীতির ফলে ইরাকের মেয়েরা যেখানে শিক্ষার অধিকার পাচ্ছিল, সরকারি বিভিন্ন চাকরিতেও তারা নিযুক্ত হচ্ছিল, আজ আমেরিকা তাদের পছন্দের ক্রীড়নক সরকারের সহযোগিতায় সেখানকার জনমানসকে ভোঁতা করে দিচ্ছে। আজ তেল সমৃদ্ধ ইরাক আমেরিকার দখলে। দুনিয়ার যে কোনো রাষ্ট্রের উপর সে এখন ছড়ি ঘোরাতে পারে। যে কোনো রাষ্ট্রের উপর সে আক্রমণও হানতে পারে, যেমন করে চলেছে আফগানিস্তানে। হয়ত তার পরবর্তী টার্গেট ইরান, কিউবা, উত্তর কোরিয়া, পাকিস্তান বা তেল সমৃদ্ধ ভেনেজুয়েলা। তাকে আজ আটকাবার ক্ষমতা কারও নেই?
জাতিসংঘ আজ এক কাকতাড়–য়ায় অবনমিত। দুর্বল দেশগুলোই আজ তাকে মান্য করে। এ সংস্থাটির প্রাধান্য বজায় রাখতে মরিয়া তার মহাসচিবের প্রয়াস নখ-দন্তহীন ব্যাঘ্রের গর্জন বলে প্রতিভাত হচ্ছে। আমাদের মনে আছে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকা থেকে পৃথিবীকে বাঁচাতে ‘লিগ অব নেশনস’ গঠিত হয়েছিল (১৯২০)। কিন্তু এর দুর্বল নেতৃত্বের পরিণতিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীভৎসতা পৃথিবীকে গ্রাস করেছিল। পুনরায় আতঙ্কিত মানুষ জাতিসংঘ গঠন করলো, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সর্বাত্মক’ ধ্বংসের হাত থেকে পৃথিবীকে বাঁচাতে। কিন্তু আজ তার অস্তিত্বেরই সংকট দেখা দিয়েছে। বলিষ্ঠভাবে এর টিকে থাকার জন্য দৃঢ়তার সঙ্গে তাকে সদর্থক ভ‚মিকা পালন করতে হবে। অন্যথায় মানব জাতির একমাত্র বাসস্থান আমাদের এ পৃথিবী এক অরাজকতাময় স্থানে রূপান্তরিত হয়ে পড়তে বাধ্য। দেশে দেশে জাতি-দাঙ্গা হয়ে উঠবে রোজকার ঘটনা। কিন্তু সভ্যতা শুরুর পূর্বের আদিমতা আর আজকের ‘আদিমতায়’ রাত-দিনের ফারাক হয়ে গেছে। পারমাণবিক, রাসায়নিক, জৈবিক ইত্যাদি হাতিয়ারে বলীয়ান আধুনিক ‘আদিমতা’ সৌরমন্ডলের এ গ্রহটিকে এক লহমায় নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে। বার্ট্রান্ড রাসেল তাঁর ‘মানুষের কি কোনো ভবিষ্যৎ আছে’ শীর্ষক গ্রন্থে সম্ভাব্য এ ধ্বংসলীলার বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে গেছেন। তাছাড়া পারমাণবিক অস্ত্র-প্রসার নিরোধক চুক্তির হয়তো আর কোনো মূল্যই থাকবে না। যার যেমন খুশি অস্ত্র বানিয়ে যাবে আর তার ব্যবহারও করবে। সব দেখে মনে হয়, পৃথিবী আজ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে এবং মারণাস্ত্র প্রয়োগের পরীক্ষাগার হয়ে উঠেছে। এ সম্ভাব্য যুদ্ধ শেষে আর কারও কিছু বলার হয়তো থাকবে না। এ গ্রহে তখন বিরাজ করবে শুধু শূন্যতা ও নিস্তব্ধতা। পৃথিবী আজ সত্যিই বড় বিপন্ন।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।