পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
হজরত শায়খ আবদুল হক মোহাদ্দেস দেহলভী (রহ.) তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আখবারুল আখিয়ার ফি আসরারিল আবরার’-এ উপমহাদেশের মাশায়েখ-উলামার যে স্তর গুলো বিন্যস্ত করেছেন, তাতে প্রথম স্তরে তৃতীয় নম্বরে উল্লেখ করেছেন হজরত বাহাউদ্দীন (মতান্তরে বাহাউল হক) আবু মোহাম্মদ জাকারিয়া মুলতানী (রহ.) এর নাম। প্রথম স্তরে দুই জনের নাম যথাক্রমে হজরত খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী আজমিরী (রহ.) এবং হজরত খাজা কুতুবুদ্দীন বখতিয়ার কাকী(রহ.)। হজরত বাহাউদ্দীন (রহ.)কে প্রচলিত সুবিখ্যাত তরিকা চতুষ্টয়ের অন্যতম সোহরাওয়ার্দিয়া তরিকার প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে গণ্য করা হয়। এ মহান সাধকের ওফাত বার্ষিকী মোহাদ্দেস দেহলভীর বর্ণনা অনুযায়ী, হিজরী ৬৬১ সালের ৭ সফর। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল শতবর্ষ। এ সম্পর্কে ভিন্ন মতও রয়েছে। কেউ কেউ তার ওফাতের তারিখ হিজরী ৬৬৬ সালের ১৭ সফর লিখেছেন। কোনো কোনো রচনায় দেখা যায় ৭৭১ হিজরী সালে তিনি ইন্তেকাল করেন।
ঈসায়ী তারিখ অনুযায়ী, হজরত বাহাউদ্দীন জাকারিয়া (রহ.) এর যুগ ১১৮২-১২৬২ পর্যন্ত বলা হয় এবং তিনি বাহাউল হক নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি সোহরাওয়ার্দিয়া তরিকার আওলিয়ায়ে কেরামের অন্যতম এবং তিনি বাগদাদে হজরত শায়খ শাহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দি (রহ.) এর খলিফা ছিলেন বলে একটি বর্ণনা হতে জানা যায়। তিনি শায়খ কামালউদ্দীন ইয়েমেনী (রহ.) এর নিকট হাদীস শিক্ষা লাভ করেন, পাঞ্জাব ও সিন্ধুতে তথা উত্তর ভারতে তিনি ইসলাম প্রচার করেন।
প্রাসঙ্গিকভাবে এখানে একটি বিভ্রান্তির অবসান করা প্রয়োজন এবং তা এই যে, কেউ কেউ মনে করেন যে, বর্ণিত আবু মোহাম্মদ বাহাউদ্দীন জাকারিয়া (রহ.) এবং নকশবন্দিয়া তরিকার প্রবর্তক হজরত শায়খ বাহাউদ্দীন মোহাম্মদ ইবনে আহমদ আল ফারুকী (রহ.) এক ও অভিন্ন। আসলে উভয়ই ছিলেন ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তিত্ব। শেষোক্তের যুগ ৭৯১ হি: মোতাবেক ১৩৮৯ খৃষ্টাব্দ। তিনি বোখারার অধিবাসী ছিলেন এবং সেখানেই তার কবর অবস্থিত। নকশবন্দিয়া তরিকার তিনিই ছিলেন প্রবর্তক। তার প্রচারিত তরিকা চীন, তুর্কিস্তান, ভারত ও তুরস্ক পর্যন্ত বিস্তৃত এবং বাংলাদেশেও এ তরিকার ব্যাপক প্রভাব বিদ্যমান। তার রচনাবলীর মধ্যে ‘আল-আওরাদুল বাহায়িয়া’ এবং ‘সিলকুল আনওয়ার ওয়া হাদিয়াতুস-সালেকীন’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
আমাদের এ আলোচনা হজরত শায়খ আবু মোহাম্মদ বাহাউদ্দীন জাকারিয়া (রহ.) এর ইসলাম প্রচারের ভ‚মিকা নিয়ে।
হজরত শায়খ বাহাউদ্দীন জাকারিয়া (রহ.) বায়তুল মোকাদ্দাস হতে যখন বাগদাদে গমন করেন, তখন সেখানে হজরত শায়খ শাহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দী (রহ.) এর সুনাম-খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। হাজার হাজার জ্ঞানপিপাষু তার খেদমতে উপস্থিত হতো, তার কাছ থেকে হেদায়েত ও মারফতের জ্ঞান লাভ করে ধন্য হতো। এ সময় হজরত বাহাউদ্দীন জাকারিয়া (রহ.)ও তার খেদমতে উপস্থিত হয়ে তার মুরিদ হয়ে যান এবং মাত্র ১৭ দিনের মধ্যে পীর-মুর্শিদ তাকে খেলাফতের ‘খেরকা’ (সূফিদের বিশেষ পোশাক) দান করেন। এরপর হজরত শায়খ শাহাবুদ্দীন (রহ.) তাকে মুলতানে গিয়ে সেখানে অবস্থান করার নির্দেশ দেন। পীর-মুর্শিদের নির্দেশ অনুযায়ী তিনি নিশাপুর হয়ে মুলতানে এসে পৌঁছেন এবং লোকদেরকে হেদায়েত ও ইসলাম প্রচারের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তার এখানে আগমনের ফলে উত্তর ভারতের সিন্ধু ও পাঞ্জাবের লোকেরা বিশেষভাবে উপকৃত হতে থাকে। মুলতানে তাঁর প্রতিষ্ঠিত খানকাহ জাহেরী ও বাতেনী ইলমের কেন্দ্রে পরিণত হয়ে যায়। তাঁর তবলীগ প্রচারের ফলে এসব এলাকা ইসলামের আলোকে আলোকিত হয়ে উঠে।
তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থে হজরত বাহাউদ্দীন মুলতানী (রহ.) সম্পর্কে অতি মূল্যবান মন্তব্য করেছেন। ভারতবর্ষে তাকে ‘তাজুল আওলিয়া’ (ওলীগণের মুকুট) আখ্যায়িত করে তার গুণাবলীর যে চিত্র তুলে ধরেছেন, তাতে আন্দাজ করা যায় যে, হজরত বাহাউদ্দীন জাকারিয়া (রহ.) কত উচ্চ স্তরের আধ্যাত্মিক সাধক ছিলেন। তাঁর উপাধি ও পূর্ণ নাম, তাজুল আওলিয়া, শায়খুল ইসলাম, গাওস বাহাউল হক অদ্দীন জাকারিয়া মুলতানী (রহ.)। তাঁর ইসলাম প্রচারের গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা স্মরণীয় হয়ে আছে। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ এবং চতুর্দশ শতাব্দীর প্রথম দিকে তিনি এবং হজরত বাবা ফরিদুদ্দীন গঞ্জেশকর (রহ.) এবং তাদের মুরীদানের ব-দওলতে পাঞ্জাব এলাকার কয়েকটি সম্প্রদায় ইসলাম গ্রহণ করে। হিজরী ৬৬৫ সালে হজরত গঞ্জেশকর যখন মুলতানে পৌছেন, তখন সেখানে হজরত বাহাউদ্দীন জাকারিয়া (রহ.) এরশাদ তলকীনের মসনদে সমাসীন ছিলেন।
তাঁর মুলতানে আগমনের পটভ‚মিকার উল্লেখযোগ্য ঘটনা এই যে, খোরাসানে তিনি সাত বছর বিভিন্ন উলামার নিকট শিক্ষা লাভ করার পর বোখারায় গিয়ে সকল বিষয়ে শিক্ষা সমাপ্ত করেন, তখন তাঁর বয়স কুড়ি বছরেরও কম। অত:পর তিনি হজ¦ করার উদ্দেশ্যে মক্কা মোয়াজ্জমায় গমন করেন। ফের মদীনা মোনাওয়ারায় গমন করেন, সেখানে তিনি রওজা শরীফের খেদমতে পাঁচ বছর নিয়োজিত থাকেন এবং একই সমযে তিনি যুগের সেরা মোহাদ্দেস মাওলানা কামাল উদ্দীন মোহাম্মদ ইয়েমেনির নিকট হাদীস শিক্ষা লাভ করেন। মদীনা মোনাওয়ারায় অবস্থান কালে তিনি আত্মশুদ্ধি ও আধ্যাত্মিক সংস্কার তথা বাতেনী ইলম লাভ করার পর বায়তুল মোকাদ্দাসে গমন করেন।
শেখ মোহাম্মদ নূর বখশের মন্তব্য উদ্ধৃত করে ‘আখবারুল আখিয়ার’ গ্রন্থে বলা হয়; হজরত শায়খ বাহাউদ্দীন জাকারিয়া মুলতানী (রহ.) হিন্দুস্থানে ‘তাজুল আওলিয়া’ ছিলেন। তিনি জাহেরী সব ইলমের উঁচু মর্যাদার আলেম এবং ইলমে মোকাশাফা ও ইলমে মোশাহাদার সকল অবস্থার পূর্ণ মর্যাদা লাভ করেছিলেন। তাঁর কাছ থেকে অধিকাংশ আওলিয়ার ধারা বের হয়েছে। তিনি লোকদের হেদায়েত করেন, সত্যের পথ প্রদর্শণ করেন এবং তাদেরকে কোফর হতে ঈমানের দিকে, পাপ থেকে পূণ্যের দিকে এবং নফসানিয়ত হতে (অহংকার-বিলাসিতা) রুহানিয়তের দিকে (আধ্যাত্মিকতার) নিয়ে আসেন। তিনি উচ্চ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন।
শায়খ আবদুল হক (রহ.) খোদ বলেন, ‘হজরত শায়খ বাহাউদ্দীন জাকারিয়া (রহ.) হিন্দুস্থানের সর্বশ্রেষ্ঠ ওলীগণের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তিনি বহু কারামতের অধিকারী ও উচু মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। মীর হোসাইন এবং শায়খ ফখরুদ্দীন ইরাকীর ন্যায় ব্যক্তিত্ব তাঁর কাছ থেকে আধ্যাত্মিক শিক্ষা লাভ করেন।’
মুলতানে তাঁর অবস্থানকালে সেখানকার শাসনকর্তা ছিলেন নাসেরুদ্দীন কাবাচা। কুতুবুদ্দীন আইবেকের ইন্তেকালের পর সুলতান আলতামাশ যখন ভারত বর্ষের বাদশাহ হন, তখন কাবাচা দিল্লির বাদশাহর আনুগত্য অস্বীকার করে নিজেই সায়ত্ব শাসন ঘোষণা করেন এবং আলতামাশের প্রতিপক্ষ হয়ে যান। হজরত শায়খ বাহাউদ্দীন জাকারিয়া (রহ.) সুলতান আলতামাশের পক্ষ অবলম্বন করেন। উল্লেখ্য, হজরত খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী (রহ.) এর খলিফা হজরত বখতিয়ার কাকী (রহ.) এর বরকতময় সংশ্রবে এসে সুলতান শামসুদ্দীন আলতামাশ এতই সংশোধিত হয়ে গিয়েছিলেন যে, কোনো কোনো লেখক তাকে আল্লাহর ওলীদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছেন। হজরত বখতিয়ার কাকী (রহ.) তার প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘ফুয়াদুস্ সালেকীন’ এ খোদ আলতামাশ সম্পর্কে লিখেছেন, তাঁর আকীদা বিশ্বাস সহি ছিল। তিনি রাতে জাগ্রত থাকতেন, কেউ তাকে নিদ্রিত দেখেনি। রাতে তিনি দরবেশ পোশাক (গুডড়ী) পরিধান করতেন যাতে কেউ জানতে না পারে। তাঁর হাতে স্বর্ণ মুদ্রার একটি থলে থাকত। তিনি প্রত্যেক মুসলমানের দরজায় গমন করে তার অবস্থা অবগত হতেন, তাকে সাহায্য করতেন। আলতামাশ তার দরজায় ইনসাফের (ন্যায় বিচারের) শিকল লটকে রেখেছিলেন এবং লোকদের প্রতি নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন, যদি তোমাদের নিকট আহার করার কিছু না থাকে অথবা তোমাদের ওপর কেউ জুলুম, নির্যাতন চালায় তা হলে তোমরা এ শিকল নাড়াবে, যাতে তাদের সাথে ইনসাফ করা যায়, নতুবা কেয়ামতের দিন তাদের ফরিয়াদের বোঝা উহার শক্তি বহন করতে পারবে না। সুলতান আলতামাশ কীভাবে খাজা বখতিয়ার কাকী (রহ.) এর প্রিয় পাত্র হতে পেরেছিলেন, তিনি সে ঘটনার কথাও উল্লেখ করেছেন। তাঁর ভাষ্য, ‘এক রজনিতে আলতামাশ আমার নিকট আসেন এবং আমার পদযুগল ধরে বসেন। আমি বললাম, কতক্ষণ আমাকে কষ্ট দিতে থাকবে? কি প্রয়োজন তা ব্যক্ত করুন।’ আলতামাশ বললেন, ‘আল্লাহ তাআলা আমাকে সাম্রাজ্য দান করেছেন, কিন্তু কিয়ামতের দিন যখন আমাকে জিজ্ঞাসা করা হবে তখনো আপনি আমাকে ত্যাগ করবেন না (এই প্রতিশ্রুতি দিতে হবে)।’ ‘তিনি ততক্ষণ পর্যন্ত প্রত্যাবর্তন করলেন না যতক্ষণ না আমি তার কথা মেনে নেয়নি।’
আলতামাশের ন্যায় এমন সৎ গুণাবলির অনন্য অধিকারী সুলতানের সমর্থকদের ভাগ্য নিয়ে নাসিরুদ্দীন কাবাচার ন্যায় জালেম অত্যাচারী শাসক ছিনিমিনি খেলবে এবং তাদের প্রাণ নাশের মত নৃশংসতা প্রদর্শণ করবে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
আগেই বলা হয়েছে যে, হজরত শায়খ বাহাউদ্দীন জাকারিয়া (রহ.) সুলতান আলতামাশের সমর্থক ছিলেন। ইসলামী শরীয়তের একজন খাঁটি অনুসারী, পরহেজগার সাধক, সুলতানের প্রতি ভক্তি-ভালবাসা, কোনো অপরাধ নয়, যাকে আল্লাহর অলীগণের মধ্যে গণ্য করা হয়ে থাকে। নাসিরুদ্দীন কাবাচা সুলতান আলতামাশের ক্রমবর্ধমান শক্তি ও প্রভাব লক্ষ্য করে বিচলিত হয়ে পড়ে এবং তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। (চলবে)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।