চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
ড. মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান
॥ তিন ॥
রোযা অন্যদের প্রতি মানুষকে সদয় হওয়া শিক্ষা দেয় এবং সহমর্মিতার গুণে গুণান্বিত করে। রোযা আমাদের বিরত রাখে সকল অন্যায়, পাপাচারিতা ও কলুষতা থেকে। নিয়ন্ত্রণ করে সমাজের অন্যায়-অশ্লীলকর্মকে। আর সকল গুণাহ-খাতাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাঁটি মুমিনে পরিণত করে রোযাদারকে।
রোযা এমন একটি ইবাদত যার পূর্ণ পালন রোযাদারের সততার ওপর নির্ভর করে। এখানে আল্লাহ ছাড়া তার খবরদারী করার কেউ নেই। সে যখন আল্লাহ প্রেমে উজ্জীবিত হয়ে দিনের বেলায় তার সকল সাধের খাদ্য দ্রব্য ত্যাগ করে এবং একটি মাসব্যাপী এ অনুশীলন করে তখন তার মধ্যে সৃষ্টি হয় পূর্ণ ঈমান ও নৈতিকতা। আর এ নৈতিকতাই পরবর্তী এগারটি মাসে তাকে বাধা দেবে সকল প্রকার অন্যায় কাজ থেকে। বাধা দেবে তাকে সুদ, ঘুস, কালো বাজারী, রাহাজানী, ছিনতাই, মাদকাসক্তি, ব্যভিচার এবং সকল প্রকার সামাজিক অন্যায় আচরণ থেকে। রোযা পালনের মাধ্যমে মানুষের মধ্যকার এ সকল খারাপ ও কুপ্রবৃত্তিগুলোকে কঠোরভাবে দমন করে মানুষকে শারীরিক, আধ্যাত্মিক ও নৈতিক উৎকর্ষ সাধনে প্রবলভাবে সাহায্য করে থাকে।
মাহে রমযান আমালে সালিহ শিক্ষা দেয়
রমযান মাস হচ্ছে আমালে সালিহ অর্থাৎ নেক আমলের মাস। পৃথিবীব্যাপি সৃষ্টি হয় নেক আমলের অভূতপূর্ব এক পরিবেশ। শুধু মুসলিম অধ্যুষিত ভূখ- নয় অমুসলিম প্রধান দেশেও এর প্রভাব পড়ে দারুণভাবে। সমাজের প্রতিটি স্তরেই দেখা যায় মানুষ ভালো কাজের প্রতি সচেষ্ট হয়। যেন রমযান নেক আমলের একটি মৌসুম। এ মাস আগমনের সাথে সাথেই আসমান এবং জান্নাতের দ্বারসমূহ খুলে দেয়া হয়। জাহান্নামের দরজাগুলোকে বন্ধ করে দেয়া হয়। শয়তানগুলো বেড়িতে বাঁধা পড়ে। ফলে মুমিনগণ নেক আমলে ঝুঁকে পড়ে। মাহে রমযানে প্রতিটি নেক আমলের সাওয়াব দশ থেকে সাতশত গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। আল্লাহ্র পক্ষ থেকে প্রতিটি মুহূর্তে আহ্বানকারী ডেকে ডেকে বলেন, ‘হে নেক আমল অন্বেষণকারী। অগ্রগামী হও, হে বদ আমল অন্বেষণকারী! রুখে যাও, থেমে যাও।’ (জামি‘উত্-তিরমিযী, হাদীছ নং ৬১৮; সুনানু ইব্ন মাজাহ্, হাদীছ নং ; ১৬৩২; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৩৪৪৬)।
মাহে রমযানে ব্যক্তিগত নেক আমল বৃদ্ধির এক মহাসুযোগ এনে দেয় আমাদের দ্বারপ্রান্তে। কুরআন মাজীদের একটি অক্ষর তিলাওয়াত করলে কমপক্ষে দশটি নেকী পাওয়া যায়। কিন্তু এ মাসে পাওয়া যায় এর সত্তরগুণ বেশি। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) এ মাসে পুরো রাত ধরেই কোরআন তিলাওয়াতে মাশগুল থাকতেন। কারণ পবিত্র কোরআন এ মাসে অবতীর্ণ হয়েছে। তাই এ মাসে বেশি বেশি করে কোরআন তিলাওয়াত করা প্রয়োজন। তারাবীহ নামাযের মাধ্যমে কোরআন খতম-এর ফযীলাত অপরিসীম। রাসূলুল্লাহ্ তারাবীর নামায আদায়ের পর তিনি জিবরাঈল (আ.)-এর সাথে পরস্পর কোরআন তিলাওয়াতে নিয়োজিত হতেন।
মাহে রমযানে রাসূলুল্লাহ্ (সা.) কোরআন তিলাওয়াতকে সর্বোৎকৃষ্ট নফল ইবাদত হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। আলী (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম সেই ব্যক্তি যিনি কোরআন শিক্ষা করেন এবং শিক্ষা দেন’ (সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৪৬৫৩, পৃ. ৬৪৯; সুনানু আবী দাউদ, হাদীছ নং ১৪৫২, পৃ. ৩০৮; জামি‘উত্-তিরযিমী, হাদীছ নং ২৯০৯, পৃ. ৮০২)।
কোরআন তিলাওয়াতের ফযীলত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ্র কিতাব হতে একটি অক্ষর পাঠ করবে তার বিনিময়ে সে সাওয়াব পাবে আর প্রতিটি সাওয়াব হবে দশগুণ পরিমাণের’ (জামি‘উত্-তিরযিমী, হাদীছ নং ২৮৩৫)
এ সাওয়াব অন্য যে কোন মাসে পাওয়া যাবে। মাহে রমযানে প্রতিটি নফলের মর্যাদা ফরযের সমান। প্রতিটি ফরযের মর্যাদা সত্তরটি ফরযের সমপরিমাণ। তাই এ মাসে পবিত্র কোরআনের বিশুদ্ধ তিলাওয়াত করা, শিক্ষা দেয়া, এর সঠিক মর্ম অনুধাবন এবং সে অনুযায়ী আমল করার জন্য আমাদের সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।
নেক আমলের এ অহ্বানের ফলে ব্যক্তি, সমাজ এবং পরিবেশের সকল স্তরেই নেমে আসে নেক আমলের প্রতিযোগিতা। সালাম দেয়া একটি নেক কাজ। আস্-সালামুআলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ্ বললে দশ নেকী পওয়া যায়। ওয়াআলাইকুমুস্-সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহি বলে উত্তর দিলে অন্য মাসে ত্রিশ নেকী পাওয়া যায়। রমযান মাসে সত্তরগুণ বেশি সাওয়াব পাওয়া যাবে। এ সহজ নেক আমলটি নবীর একটি অনন্য সুন্নাত। এ সুন্নাতের প্রচলনের ফলে পরস্পরের ভালবাসা বৃদ্ধি পায়।
হাটে-বাজারে, অফিস-আদালতে এবং সকল স্থানে সুবিচার, সুআচরণ ও ন্যায়-নীতির একটি পরিবেশ সৃষ্টি হওয়া বাঞ্ছনীয়। আজ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্ব গতিতে জনজীবনে অস্বস্তিকর অবস্থা বিরাজ করছে। ব্যবসায়ী মহল পারেন এর অবসান ঘটাতে। কম লাভে তারা যদি ভোক্তাদের হাতে পণ্য তুলে দেন, মাপে কম না দেন, ঠকানোর মানষিকতা পরিহার করেন তবে এতে যেমন তাদের আমলনামায় যুক্ত হবে অনেক অনেক সাওয়াব, অনুরূপভাবে তারা যুক্ত হবেন নেক্কার ঈমানদারদের কাতারে।
মাহে রমযানের রাতে ইবাদাত আমলে সালেহ লাভের এক মহাসুযোগ। প্রতিটি রাতে আল্লাহ্ মুক্ত করেন বহু লোককে জাহান্নাম থেকে। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ্ অনেককে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করেন। আর এটা হচ্ছে রমযানের প্রতিটি রাত।’ অপর হাদীসে রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেন, ‘এটা এমন একটি মাস, যার প্রথম ভাগে আল্লাহ্র রহমত, মধ্যভাবে গুনাহের মাগফিরাত এবং শেষভাগে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তিলাভ রয়েছে’ (সুনানু বায়হাকী, হাদীছ নং ৩৪৫৫; মিশকাতুল মাসাবীহ্, হাদীছ নং ১৯৬৫)। হযরত আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেন, ‘রমযান মাস এলে জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়, জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয় এবং শয়তানকে শিকল লাগিয়ে বন্দী করা হয়’ (সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৩৬২, ২৩৬৩)।
মাহে রমযানের শেষ দশকে নেক আমল করার জন্য একটি উত্তম রাত লুকায়িত রয়েছে। এ রাতকে ‘লায়লাতুল কদর’ বলা হয়। লায়লাতুন শব্দের অর্থ রাত্রি। কদরের অর্থ মাহাত্ম্য ও সম্মান। এ রাতের মাহাত্ম্য ও সম্মান সকল রাতের চেয়ে অধিক বলে একে কদরের রাত বলা হয়। আবূ বকর ওয়াররাক বলেন, ‘এ রাত্রিকে কদরের রাত বলার কারণ এই, আমল না করার কারণে এর পূর্বে যার কোন সম্মান ছিল না; সে এ রাত্রে তওবা, ইসতিগফার ও ইবাদতের মাধ্যমে সম্মানিত হতে পারে।’ এ ফযীলতপূর্ণ রাতটিও এ মাসের মধ্যে রয়েছে। এ রাতের ফযীলত সম্পর্কে আল্লাহ্ তাআলা বলেন, ‘আমি কদরের রাতে কোরআন নাযিল করেছি। আপনি কি জানেন কদরের রাত কি? কদরের রাত এক হাজার মাসের চেয়েও অনেক উত্তম।’ (সূরা আল-কদর, ৯৭ : ১-৩)।
কদরের রাতে ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা আমাদের গুণাহ মাফ করে দেন। হযরত আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (সা.) বলেন, ‘ঈমানের সাথে এবং সওয়াব লাভের আশায় যে ব্যক্তি লায়লাতুল-কদরে ইবাদত করবে তার পূর্বের গুণাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে’ (সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ১৭৬৮; সুনানুন্-নাসাঈ, হাদীছ ২১৬৪; মুসনাদু আহমাদ, হাদীছ নং ৮২২২)।
মাহে রমযানে ইতিকাফের মাধ্যমে নেক আমল করা সম্ভব। ইতিকাফ অর্থ রমযানের শেষ দশকে সাওয়াবের নিয়্যাতে মাসজিদে অবস্থান করা। পবিত্র রমযানের আমলের মধ্যে এটি অন্যতম। পরিবারের মোহ ত্যাগ করে আল্লাহ্র সাথে গভীর সম্বন্ধ স্থাপনের উদ্দেশ্যে রাতদিন মাসজিদে অবস্থান করা, সর্বদা তাসবীহ্ তাহলীল পাঠ করা, কোরআন তিলাওয়াত করা, যিক্র করে হৃদয়কে নূরানী করে আল্লাহ্র অবর্ণনীয় নৈকট্য লাভ করাই এ ইবাদতের মূল লক্ষ্য। তাই বলা যায় মাহে রমযান আমালে সালিহ শিক্ষা করার সর্বোত্তম সময়। পরিশেষে বলা যায় রোযা মানুষকে সকল প্রকার অন্যায়, অত্যাচার, নির্যাতন, ব্যভিচার, চুরি-ডাকাতি, সুদ-ঘুষ, দুর্নীতি, ছিনতাই, রাহাজানী তথা সকল প্রকার পাপ কাজ থেকে রক্ষা করে। রোযার যাদু স্পর্শে ন্যায়নীতি, ন্যায়বিচার, ন্যায়পরায়ণতার গুণে সে গুণান্বিত হয়। রোযাদারের অন্তরে অন্যের প্রতি দরদ, প্রেম-প্রীতি ও ভালবাসার সৃষ্টি হয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।