পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বৃষ্টির পানিতে রাজধানী ঢাকা এবং বন্দরনগরী চট্টগ্রাম ডুবে যায়। সামান্য বৃষ্টিতেই নগরজীবন অচল হয়ে পড়ে। জলাবদ্ধতার সঙ্গে নিত্য পাওনা যানজটও আছে। যানজটের কারণে কেবল রাজধানী ঢাকায় বছরে বাণিজ্যিক ক্ষতি ২১ হাজার কোটি টাকার বেশি। প্রতিদিন এর পরিমাণ ৮৩ কোটি টাকা। এছাড়া প্রতি কর্মদিবসে নষ্ট হচ্ছে ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা, যা একজন মানুষের ক্ষেত্রে তিন ঘণ্টা।
এভাবে কি নগর জীবন চলে? কি বৈশাখ, কি আষাঢ় জলাবদ্ধতা ডোবে ঢাকা। আর চট্টগ্রাম নগরীও থাকে পানির তলায়। ভরসা কোথায়? আদৌ কি এই দুই নগরের জলাবদ্ধতা দূর হবে? ঢাকা এবং চট্টগ্রামের নাগরিকদের সেবায় বর্তমানে তিনজন নগর পিতা আছেন। নগর পিতারা জলাবদ্ধতা নিরসনে কী করছেন? প্রতি বছরইতো খোঁড়াখুড়ি হয়; ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়নে কোটিকোটি টাকা ব্যয় হয়। তবুও কেন জলাবদ্ধতা? কেবল পরিকল্পনার অভাব। পরিকল্পিত নগরায়ন হলে জলাবদ্ধতা থাকবে না। নগরের খালগুলো দখলমুক্ত হলে জলাবদ্ধতা থাকবে না- এসব কথা প্রায়ই শোনা যায়। কিন্তু বাস্তবে ফল পাওয়া যায় না।
ক’য়েক মাস ধরে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় নতুন করে ড্রেনেজ নির্মাণ কাজ করছে ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি কর্পোরেশন। এসব ড্রেন পরিকল্পনা মাফিক হলে রাজধানী ঢাকার জলাবদ্ধতা কিছুটা কমতো। কিন্তু তা হয়নি। জলাবদ্ধতা বেড়েছে। সামান্য বৃষ্টিতেই রাজধানী ঢাকা ডুবে যায়। বন্দও নগরী চট্টগ্রামেরও এই একই অবস্থা। রাজধানী ঢাকা এবং চট্টগ্রামে পর্যাপ্ত খাল আছে; কিন্তু অস্তিত্ব নেই। খালগুলো কোথায় আছে তাই জানে না নগরবাসী। দখল হয়ে গেছে অনেক আগেই। সে কারণে জলাবদ্ধতাই যেন নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সামান্য বৃষ্টিতেই স্থবির হয়ে পড়ছে কর্মব্যস্ত এই দুই শহরের জনজীবন।
জলাবদ্ধতা আর যানজটে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতি হচ্ছে, সেই সাথে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে নগরবাসীকে। বছরের পর বছর ধরে এ অবস্থা চলে আসছে। গত দেড়-দুই দশকে অনেক আশার বাণী শোনানো হয়েছে এই দুই নগরের বাসিন্দাদের। কিন্তু কাজের কাজ তেমন একটা হয়নি। এ জলাবদ্ধতাকে সারা দেশের বাস্তবতা হতে বিচ্ছিন্ন করে দেখার উপায় নাই। তবে সামগ্রিক বিচারে দেশের গুরুত্বপূর্ণ এই দুই নগরীর অবস্থা যে খুবই উদ্বেগজনক তা অনস্বীকার্য।
এটাও সত্য, আমরা যারা নগরে বাস করি তারাও সচেতন নই। রাজধানী এবং বন্দরনগরীর সৃষ্ট জলাবদ্ধতার পেছনে দায়ী বিষয়গুলো সম্পর্কে সবাই কমবেশি জানি, বুঝি এমনকি নিয়মিত দেখিও। কিন্তু কারো মধ্যে সচেতনতা কাজ করে না। ফলে দেখা গেছে, এখনো মানুষ ঘরের জানালা দিয়ে পলিথিনের ব্যাগে করে রাতের আঁধারে ময়লা-আবর্জনা রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলেন, যেগুলো গিয়ে স্থান নেয় কোনো একটি পয়োনিষ্কাশন পাইপ কিংবা নালার মুখে। এতে পানি নিঃসরণের স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ হয়ে সৃষ্টি হয় নানা জটিলতা। জলাবদ্ধতা সৃষ্টির পেছনে আরেক অভিশাপ বলা যেতে পারে নির্মাণাধীন ভবনগুলো থেকে তৈরি উপজাতগুলোকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, ভবন তৈরির কাঁচামাল এনে জড়ো করা হয় রাস্তার ওপর। তার পর সেখান থেকে নিয়ে তৈরি করা হয় স্থাপনা।
বর্ষাকাল চট্টগ্রাম ও ঢাকা মহানগরীর জনগোষ্ঠির জন্যে এক মহা দুর্ভোগের কাল হিসেবেই আভির্ভ‚ত হয়। বর্ষাবাদে অন্য যেকোন সময় বৃষ্টি হলে জলাবদ্ধতার একই রূপ থাকে। ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) এবং চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক) নগরবাসীকে জলাবদ্ধতাজনিত দুঃষহ কষ্ট থেকে রেহাই দিতে এখনও কোনো আন্তরিক উদ্যোগ নেয়নি। উপরন্তু এসব সেবাদানকারী সংস্থার কিছু তৎপরতা জলাবদ্ধতাকে দীর্ঘস্থায়ী করছে। চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতাজনিত দুর্ভোগ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে এর আগে মেয়র নির্বাচনে জনগণ বিএনপির প্রার্থী মঞ্জুকে বিপুল ভোটে নির্বাচিত করেছিল। কিন্তু চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে সফল হতে পারেননি। এরপর আওয়ামীলীগের ব্যানার থেকে নির্বাচিত হয়েছেন বর্তমান মেয়র নাছির। তিনিও অনেক সময় পার করেছেন। কিন্তু এখনও দৃশ্যমান কোনো উন্নতি লক্ষ করা যাচ্ছে না। ফলে সামান্য বৃষ্টিতেও নগরবাসীকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। এই পরিস্থিতির জন্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন দায় এড়াতে পারে না। সিডিএ’র অপরিকল্পিত নগরায়ন এবং সিটি কর্পোরেশনের খালগুলোর প্রয়োজনীয় সংস্কার না করা এবং নালা-নর্দমার ময়লা অপসারণে ব্যর্থতাই এই দুর্দশার প্রধান কারণ। নগরে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন হওয়ার জন্য মূল খাল রয়েছে ১৬টি। কিন্তু নগরের প্রাথমিক ১৬টি খালের সব কটির অধিকাংশ ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ বেদখল হয়ে গেছে। এ ছাড়া এসব খাল সময়মতো সংস্কার ও খনন করা হয়নি। কিছু কিছু খালের মাটি তোলা হলেও তা রাখা হয়েছিল পাড়ে। পরে বৃষ্টির পানিতে ওই মাটি আবার খালে পড়ে। নগরীতে অপরিকল্পিত ফ্লাইওভার নির্মাণের কারণে এমনিতেই বহু নালা-নর্দমা খাল ভরাট হয়ে গেছে, তার উপর সংস্কার নেই পুরনো খাল ও নালার। পানি ধারণক্ষম বহু পুকুর ভরাট করে দালানকোঠা ও দোকানপাট গড়ে তোলা হয়েছে। ফলে বৃষ্টির পানি সরতে পারছে না। সহজে পানি সরে যাওয়ার ব্যবস্থা না থাকায় ভারী বৃষ্টিতে হঠাৎ এমন জনদুর্দশার সৃষ্টি হয়েছে। পানি নিষ্কাশনের পথগুলো উন্মুক্ত রাখলে এ জন-দুর্ভোগের সৃষ্টি হতো না।
এ বিষয়ে ডিসিসি ও চসিকসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। আমরা মনে করি, এ দুই মহানগরে পানি নিষ্কাশনের নাজুক অবস্থার কারণেই এমনটি হয়েছে। পুকুর-জলাশয়, নদী-নালা ভরাট ও বেদখল হয়ে যাওয়ার সাথে যোগ হয়েছে মহানগরের পয়ঃনিষ্কাশনের খাল দখলের প্রতিযোগিতা। চট্টগ্রামের প্রধান খাল চাক্তাই খালের বিভিন্ন অংশ ভ‚মিগ্রাসীদের দখলে চলে যাওয়া এবং ময়লা-আবর্জনায় ভরাট হয়ে যাওয়া। তাছাড়া, বর্তমানে নিষিদ্ধ ঘোষিত পলিথিন ব্যাগ ব্যবহারে তেমন বাধা না থাকায় পরিবেশ ধ্বংসকারী পলিব্যাগে সয়লাব হয়ে গেছে পুরো মহানগর। পলিথিনগুলো নালা-নর্দমা ভরাট করে পানি নিষ্কাশনে বাধার সৃষ্টি করে। ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাও নালা-নর্দমা পরিষ্কারের দায়িত্ব পালন করেনি। তাদের গাফিলতির কারণেই নগরের বিভিন্ন এলাকা সামান্য বৃষ্টিতেই ডুবে যায়। মানুষ অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার হয়। ক্ষতি হয় কোটি কোটি টাকার সম্পদের।
পৃথিবীর বহু দেশে নগরায়নের পরও নদীরক্ষা ও পয়ঃনিষ্কাশন সুব্যবস্থার নজির আছে। তাহলে আমরা কেন পারছি না? এজন্য আমাদের সিটি কর্পোরেশনের পাশাপাশি, সরকার, স্থানীয় প্রশাসন, স্থানীয় সরকার, ওয়াসা প্রভৃতি সংস্থারও দায়ভার আছে। তবে এটাও সত্য যে, এসব সংস্থার কাজের মধ্যে সমন্বয়ের ব্যবস্থা নেই। ঢাকা ও চট্টগ্রামে ‘নগর সরকার’ গড়ার বিষয়টি নিয়ে বহু বছর ধরে আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু নগর সরকারের দেখা মিলছে না। নগর সরকরার গঠন করে সকল নগরের জলাবদ্ধতাসহ নাগরিক সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে। কিন্তু রাজনৈতিক নেতাদের সদিচ্ছার অভাবে তা যেন ক্রমেই অসম্ভব হয়ে উঠছে। তাই প্রশ্ন জাগে, জলাবদ্ধতা নিরসনের কাজটি কি আদৌ হবে?
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।