পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে আল্লাহপাক ও রাসূল সা. এর প্রতি কটুক্তি করার জের হিসাবে ভোলার বোরহানউদ্দিনে ‘সর্বস্তরের মুসলিম তৌহিদী জনতার’ প্রতিবাদ সমাবেশে পুলিশের গুলিবর্ষনে চারজন নিহত ও তিন শতাধিক লোক, যাদের মধ্যে পুলিশও আছে, আহত হওয়ার ঘটনা শুধু অনভিপ্রেত ও অনাকাঙ্খিত নয়, অত্যন্ত দু:খজনক। আমরা এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবরে যতদূর জানা যায়, গত শুক্রবার বোরহানউদ্দিন উপজেলার কাচিয়া ২নং ওয়ার্ডের চন্দ্রমোহন বৈদ্যের ছেলে বিপ্লব চন্দ্র শুভর ফেসবুক আইডি থেকে তার ফেসবুক বন্ধুদের কাছে আল্লাহ ও রাসূল সা. এর প্রতি বিষোদগার ও কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য সম্বলিত মেসেজ পাঠানো হয়। তার বন্ধুরা এর স্ক্রিনশট নিয়ে ফেসবুকে দিলে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষ প্রতিবাদ জানানো শুরু করে। এনিয়ে বিভিন্ন মসজিদ থেকে প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। বিষয়টি পুলিশের নজর এড়ায় না। এদিকে ওইদিন সন্ধ্যার দিকে অভিযুক্ত বিপ্লব চন্দ্র শুভ বোরহানউদ্দিন থানায় গিয়ে জানায় তার ফেসবুক আইডি হ্যাক হয়েছে। এই মর্মে একটি ডায়েরিও করে। এ সময় বিষয়টি তদন্ত ও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ তাকে আটক করে। শনিবার তার কথা ধরে পটুয়াখালি থেকে আরেকজনকে পুলিশ গ্রেফতার করে। এ নিয়ে সেদিনও প্রতিবাদ ও মিছিল বের হয় দায়ী ব্যক্তির বিচারের দাবিতে এবং রোববার ৯টায় একই দাবিতে বিক্ষোভের ডাক দেয়। এব্যাপারে শনিবার রাতে মাইকিংও করা হয়। যথারীতি রোববার বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। এ মিছিল না করার জন্য ঈদগাহ ও বাজার মসজিদের দুই ইমামকে পুলিশের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয়। দুই ইমাম সেই অনুরোধ মতো ১০টার দিকে যেসব লোক এসেছিল তাদের নিয়ে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য ও মোনাজাতের মাধ্যমে বিক্ষোভ মিছিল সমাপ্ত করেন। ততক্ষণে অনেক লোক জমা হয়ে যায়। তারা প্রশাসন ও দুই ইমামের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে এবং সেখানে থাকা পুলিশের প্রতি ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। এক পর্যায়ে পুলিশ আত্মরক্ষার্থে মসজিদের ইমামের কক্ষে আশ্রয় নেয় এবং ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতপ্রাপ্ত প্রতিবাদরত বিক্ষুব্ধ জনতার উদ্দেশে গুলিবর্ষণ করে, যার পরিণাম চারজনের মর্মান্তিক মৃত্যু এবং শত শত লোকের আহত হওয়া।
ঘটনার এ পরস্পরা বিশ্লেষণ করলে প্রতীয়মান হয়, উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দেয়ার ক্ষেত্রে পুলিশ চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। শুক্রবারেই যখন প্রতিবাদ-বিক্ষোভ দেখা দেয় তখন পুলিশের আন্দাজ করা উচিৎ ছিল এ ধরনের সেনসেটিভ ইস্যুতে জনসম্পৃক্ততা বাড়তে পারে। কাজেই শুরুতেই পুলিশের উচিৎ ছিল স্থানীয় প্রভাবশালীও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ করা এবং পরিস্থিতির যে কোনো অবনতিরোধে সহায়তা কামনা করা। দ্বিতীয়ত : বিপ্লব চন্দ্র শুভ ও অন্য যাকে গ্রেফতার করা হয়েছে তার বিষয়ে দ্রুত তদন্তের ব্যবস্থা করা এবং আইনগত পরবর্তী প্রক্রিয়া শুরু করা। রবিবার পর্যন্ত বিলম্ব করা ঠিক হয়নি। তৃতীয়ত : দুই মসজিদের ইমাম পুলিশকে যথেষ্ট সহযোগিতা করেছেন। সর্বজনমান্য একজন পীর সাহেবের কথাও শোনা গেছে, তিনিও প্রশাসন ও পুলিশকে আপ্রাণ সহযোগিতা করেছেন। তারা নিজেরাও ঝুঁকি নিয়েছেন। এমতাবস্থায়, পুলিশের আরো ধৈর্যধারণ করা উচিৎ ছিল। সরাসরি প্রাণঘাতী গুলি না চালিয়ে কাঁদানে গ্যাস, রাবার বুলেট ও ছররা গুলির মধ্যে তাদের এ্যাকশন সীমিত রাখলে নিহত ও মারাত্মক আহত হওয়ার অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটতে পারতো না। প্রসঙ্গক্রমে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনাও বিশেষভাবে আলোচনাযোগ্য। মনে রাখতে হবে, তৌহিদী জনতা অভিযুক্ত বা দায়ী ব্যক্তির বিচার চেয়েছে, পুলিশের ওপর হামলা চালানো তাদের উদ্দেশ্য নয় বা ছিলনা। কোনো কুচক্রী মহল তৌহিদী জনতার মধ্যে অনুপ্রবেশ করে হামলার এ ঘটনা ঘটিয়েছে কিনা সেটা বিশেষভাবে দেখার বিষয়।
পুলিশের-ভূমিকা ও আচরণ কতটা প্রশ্নবিদ্ধ ছিল এবং তাদের ব্যর্থতা কোথায় সেটা অনুপুংখ তদন্তের দাবী রাখে। একই সঙ্গে পুলিশের ওপর হামলা ও পরিস্থিতি নাজুক করে তোলার ক্ষেত্রে অনুপ্রবিষ্ট কোনো চক্র জড়িত কিনা সেটাও তদন্ত করে দেখা উচিৎ। দু:খজনক হলেও বলতে হচ্ছে, আমাদের কোনো কোনো মিডিয়া যথাযোগ্য ভূমিকা পালন করতে পারেনি। ‘তৌহিদী জনতা’ নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হওয়ার কিছু নেই। তৌহিদী জনতা কোনো দল নয়। এর মানে ধর্মপ্রাণ মানুষের সমষ্টি। নবীপ্রেমিক মুসলমানমানেই তৌহিদী জনতার অংশ। মহান আল্লাহপাক ও বিশ্বনবী মুহম্মাদুর রাসূলূল্লাহ সা. এর বিরুদ্ধে কেউ কুৎসা রটালে বা তাদের প্রতি কটুক্তি করলে কোনো মুসলমানের পক্ষে তা বরদাশত করা সম্ভব নয়। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হবেই। প্রতিবাদ করাটা তাদের ঈমানের অঙ্গীকার। বোরহানউদ্দিনে যা হয়েছে, সেটাই স্বাভাবিক ও ঈমানী চেতনায় সঙ্গত। এর আগেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আল্লাহ-রাসূল সা. সম্পর্কে একই ধরনের কুৎসা ও কটুকাটব্য করা হয়েছে। এর স্বাভাবিক ও সঙ্গত প্রতিবাদ হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অঘটনও ঘটতে দেখা গেছে। কোনো কোনো সম্প্রদায়ের লোকদের আক্রান্ত হতে দেখা গেছে। এ প্রসঙ্গে স্পষ্টই একথা বলা দরকার যে, মুসলমানেরা কোনো ধর্ম-সম্প্রদায় বা তার ধর্মীয় নেতা, পবিত্র গ্রন্থ ইত্যাদি সম্পর্কে কোনো কটুক্তি করে না। এসব তাদের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে। একই সঙ্গে কোনো ধর্মীয়-গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের ওপর হামলা করাও তাদের জন্য নিষেধ করা হয়েছে। আমাদের দেশে অতীতে দুয়েকটি ঘটনা এমন ঘটেছে, যার জন্য প্রকৃত মুসলমানদের দায়ী করা যায় না। এধরনের প্রায় প্রতিটি ঘটনাও ক্ষেত্রে মুসলমানরাই জুলুমের শিকার হয়েছে। বোরহানউদ্দিনের ঘটনাও তা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পুলিশের গুলিতে হতাহত হওয়া ছাড়াও এখন এলাকার হাজার হাজার লোক মামলায় মুখে পড়েছে। এতে পুলিশের ভালো বাণিজ্য হতে পারে। এও বলা আবশ্যক, দেশের মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেও পার পেয়ে যাওয়া যায়। এ ধরনের অপরাধের বিচার এ পর্যন্ত কমই হয়েছে। বোরহানউদ্দিনের ঘটনা ইতোমধ্যেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নজরে এসেছে তিনি একে অনাকাঙ্খিত বলে অভিহিত করেছেন। তিনি সবাইকে ধৈর্য ধারনের আহ্বান জানিয়েছেন এবং ঘটনার সঙ্গে যারাই জড়িত থাক, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সহমত পোষণ করে আমরাও বলতে চাই, এমুহূর্তে ধৈর্য ধারণের বিকল্প নেই। তবে বিচারের দাবিও জানিয়ে যেতে হবে শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ায়। কারণ, দ্রুত ও যথাযথ বিচার এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলেই কেবল কেউ সাহস পাবে না এ ধরনের অপরাধ করতে। আমরা আশা করতে চাই প্রধানমন্ত্রী প্রয়োজন বোধ করলে ঘটনার বিচারবিভাগীয় তদন্তের ব্যবস্থা করবেন। তাতে প্রকৃত দোষীদের শনাক্ত করা ও কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা সহজ হবে। পরিশেষে আল্লাহ-রাসূল সা. মর্যাদার শানে যারা নিহত হয়েছে, আমরা পদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। তাদের পরিবার-পরিজনের প্রতি জানাই গভীর সমাবেদনা। একই সঙ্গে যারা আহত হয়েছে, তাদের দ্রæত আরোগ্য এবং তাদের পরিবার-পরিজনের প্রতি জানাই আন্তরিক সহানুভূতি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।