পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
গত সোমবার দৈনিক ইনকিলাব-এর প্রথম ও শেষ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত দু’টি খবর। দু’টি খবরেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে শাসক দল আওয়ামী লীগের স্ব-বিরোধী ভূমিকা। প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত খবরের শিরোনাম ছিল: ‘আ’লীগে কোনো দূষিত রক্ত রাখব না’। এ বক্তব্য দেন শাসক দল আওয়ামী লীগের দু’নম্বর নেতা সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। রাজশাহীতে প্রদত্ত এক ভাষণে জনাব ওবায়দুল কাদের বলেন, আওয়ামী লীগের সকল পর্যায়ে বিশুদ্ধ রক্ত সঞ্চালন করতে হবে। খারাপ লোকের আমাদের দরকার নেই।
আওয়ামী লীগের দু’নম্বর নেতার এ বক্তব্যের অর্থ কী? অর্থ হচ্ছে, আওয়ামী লীগে এত বেশি খারাপ লোকের সমাবেশ ঘটেছে যে, আর বেশি খারাপ লোকের দরকার নেই। এত বেশি খারাপ লোক আওয়ামী লীগে প্রবেশ করার পর আরও খারাপ লোককে আওয়ামী লীগে প্রবেশ করতে দিলে এককালের জনপ্রিয় দল আওয়ামী লীগের যে সামান্যতম গ্রহণযোগ্যতা বর্তমানে রয়েছে, তাও থাকবে না।
এর প্রতিকার হিসাবেই আওয়ামী লীগের দু’নম্বর নেতা ওবায়দুল কাদের যে নোসখা দিয়েছেন, তা হচ্ছে আওয়ামী লীগ থেকে দূষিত রক্ত বের করে দিতে হবে। আওয়ামী লীগে আর দূষিত রক্ত রাখা চলবে না। কিন্তু কীভাবে আওয়ামী লীগে দূষিত রক্ত ঢুকেছে সে পথ তিনি বাতলাননি বা বাতলাতে পারেননি।
আওয়ামী লীগে কিভাবে দূষিত রক্ত ঢুকেছে, তা জানতে হলে ইতিহাসের আশ্রয় নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। এ ইতিহাস আওয়ামী লীগের জন্ম থেকে অদ্যাবধি তার সাংগঠনিক উত্থানপতনের ইতিহাস। আওয়ামী জন্ম কীভাবে কোন রাজনৈতিক পটভূমিতে হয়েছিল, তার সন্ধান না নিলে পরবর্তীকালে তার পতন কীভাবে কোন পটভূমিতে শুরু হয়, তা বুঝা যাবে না।
বর্তমান আওয়ামী লীগের দু’নম্বর নেতা ওবায়দুল কাদের তো ন’নই, এমন কি বর্তমান আওয়ামী লীগের এক নম্বর নেতা (নেত্রী) শেখ হাসিনাও আওয়ামী লীগের জন্ম হয় যে সম্মেলনে, সে সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন না। শুধু তাই নয়। বর্তমানে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে যে শেখ মুজিবুর রহমানের নাম বলা হয়, সেই শেখ মুজিবুর রহমানও আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন না। এসব কথা আমি বলছি, ঐ সম্মেলনে একজন সাংবাদিক (ভাষা আন্দোলনের মুখপত্র সাপ্তাহিক সৈনিক-এর সহকারী সম্পাদক) হিসাবে উপস্থিত থাকার সুযোগ আমার হয়েছিল।
যে সম্মেলনে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা হয় সে সম্মেলনের নাম ছিল: ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলন’। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঐ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ঐ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, যিনি উপমহাদেশে ব্রিটিশ রাজত্বের শেষ বছরে আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন। মওলানা ভাসানী পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্ব আসামে বঙ্গাল খেদা-বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে বিশেষ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই মওলানা ভাসানী তদানীন্তন পাকিস্তানে (পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন এবং টাঙ্গাইলের সন্তোষে নিজের বাসস্থান ঠিক করে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ শুরু করেন। ঢাকায় এলে তিনি কখনও আওয়ামী লীগের প্রথম দিকের অন্যতম নেত্রী আনোয়ারা খাতুনের বাসায় অথবা ইয়ার মুহম্মদ খানের বাস ভবনে উঠতেন।
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন যে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলনে আওয়ামী লীগের জন্ম হয়, একথা আগেই বলা হয়েছে। ঐ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সে কথাও আগেই বলা হয়েছে। ঐ সম্মেলনে সঞ্চালকের ভূমিকা পালন করেন টাঙ্গাইলের উদীয়মান তরুণ নেতা জনাব শামসুল হক। আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার আদর্শিক গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ‘মূল দাবী’ শীর্ষক একখানি মুদ্রিত পুস্তিকা পাঠ করাতে বেশ দীর্ঘ সময় নেন তিনি। এতে ‘অন পয়েন্ট অফ অর্ডার’ প্রতিবাদ করতে উঠে দাঁড়ান চট্টগ্রাম থেকে আগত অন্যতম ডেলিগেট জনাব ফজলুল কাদের চৌধুরী।
প্রতিবাদ করতে দাঁড়িয়ে জনাব ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, আমরা এসেছি এখানে একটি বিরোধী রাজনৈতিক দল গঠন করতে। এখানে এত আদর্শের কচকচানি কেন? এতে মওলানা ভাসানী ক্রুদ্ধ হয়ে বলে উঠেন, খামোস, মুসলিম লীগ আদর্শের পথ ত্যাগ করায় জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পকেট লীগে পরিণত হয়েছে। তাই আমরা আদর্শের ভিত্তিতে পুনরায় আম জনগণকে নিয়ে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করতে এসেছি। কারো যদি সে আদর্শ (ইসলাম) হজম না হয় সে চলে যেতে পারে, তেমন লোকের আমাদের না হলেও চলবে। এতে ক্রুদ্ধ হয়ে জনাব ফজলুল কাদের চৌধুরী রাগে গটগট করতে করতে সম্মেলন থেকে ওয়াক আউট করে বেরিয়ে যান।
শেষ পর্যন্ত সম্মেলনে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি আতাউর রহমান খান প্রমুখকে সহ-সভাপতি, জনাব শামসুল হককে সাধারণ সম্পাদক, শেখ মুজিবুর রহমানকে যুগ্ম-সম্পাদক, ইয়ার মুহম্মদ খানকে কোষাধ্যক্ষ, এ. কে. এম রফিকুল হোসেনকে সহসম্পাদক করে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে দেশের প্রথম বিরোধীদল আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম হয়। পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগের মধ্যে শুরু হয় চক্রান্ত, যার ফলে প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা ভাসানী, প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক প্রমুখ চক্রান্তের শিকার হিসাবে নেতৃত্ব থেকে বাদ পড়ে যান।
শুধু তাই নয়। ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশ গ্রহণের অপরাধে জনাব শামসুল হক যখন দীর্ঘ কারাবাসের পর মুক্তিলাভ করেন, তাঁকে দেখা যায় কঠিন মানসিক রোগে আক্রান্ত হিসাবে। এরপর দলের সাধারণ সম্পাদক হিসাবে দলের নেতৃত্বে আসেন যুগ্ম-সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান। অনেকে মনে করেন, আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক শামসুল হকের এ রোগের পেছনে তদানীন্তন সরকারের হাত ছিল। অন্যদিকে অনেকে মনে করেন, এর পেছনে আওয়ামী লীগেরই নেতৃত্বাকাক্সক্ষী কোনো নেতার হাত ছিল। তবে একথা তদানীন্তন রাজনীতি সচেতন জনগণ সাক্ষ্য দেবেন সে সময় শামসুল হক এতই জনপ্রিয় ছিলেন যে, অনেকেই তাকে পূর্ব পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মনে করতেন।
যে আওয়ামী লীগের জন্ম হয়েছিল জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া তদানীন্তন শাসক দল মুসলিম লীগের আদর্শিক পতনের প্রেক্ষাপটে, সে আওয়ামী লীগ পরবর্তীকালে বাংলাদেশ আমলে শুধু ক্ষমতায় থাকার স্বার্থে গণতন্ত্রের টুটি চেপে ধরে দেশের সকল রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে একটি মাত্র সরকারি দল রেখে দেশে বাকশালী শাসন ব্যবস্থা কায়েম করে একই পথের অনুসারী হয়।
বর্তমানে যে সরকার বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রয়েছে, তার মধ্যে যে প্রচুর দূষিত রক্ত ঢুকে গেছে, তার স্বীকৃতি দানে বাধ্য হয়েছেন আওয়ামী লীগের দু’নম্বর নেতা সাধারণ সম্পাদক জনাব ওবায়দুল কাদেরও। কিন্তু তিনি বলেননি, কবে থেকে এবং কোন কারণে আওয়ামী লীগের এ দুরবস্থা শুরু হয়েছে। তবে তিনি না বললেও জনগণ জানেন, আওয়ামী লীগের এই দুরাবস্থা শুরু হয়েছে যখন আওয়ামী লীগ এমন এক নির্বাচনী মহড়ার মাধ্যমে বর্তমানে ক্ষমতাসীন হয়েছে, যাকে জনগণ বাস্তবতার প্রেক্ষিতে নাম দিয়েছিল ‘ভোটারবিহীন নির্বাচন’। এসব কারণে আওয়ামী লীগ জনগণের কাছে তার অতীতের সকল মর্যাদা তো হারিয়েছেই, অদূর অতীতের সে মর্যাদা ফিরে পাবার কোনো সম্ভাবনাই দেখতে পাওয়া যাচেছ না।
এই প্রেক্ষাপটে অদূর ভবিষ্যতের আওয়ামী লীগ যে পুনরায় সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারবে না, এ ধারণা এখন দেশের বাইরে, বর্হিবিশ্বেও ছড়িয়ে পড়েছে। আওয়ামী লীগের ছাত্র ফ্রন্ট ছাত্র লীগ আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকার সুযোগে বাংলাদেশ প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের হত্যাকান্ড নিয়ে বিবৃতি দেওয়ায় বাংলাদেশে নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারীকে ডেকে নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে সরকার।
এর অর্থ কী? এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে গত সোমবারের দৈনিক ইনকিলাব এর শেষ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত একটি খবরে, যার প্রধান শিরোনাম ছিল: ‘জাতিসংঘের বিবৃতিতে সরকারের অসন্তোষ’। আর উপ-শিরোনাম ছিল: ‘ছাত্রলীগ নেতাদের আবরার হত্যা’। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সূত্রে বলা হয়েছে, সরকার মনে করে এই বিবৃতি দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ।
অর্থাৎ বাংলাদেশে যতদিন বর্তমান সরকার ক্ষমতায় থাকবে, ততদিন ক্ষমতাসীন সরকারের কোনো অন্যায় বা অত্যাচারের কেউ বিরোধিতা করতে পারবে না। কেউ যদি এরকম অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে সাহস দেখায়, তাকে হত্যা করতে পারবে ক্ষমতাসীন সরকারি দল বা তার কোনো ফ্রন্ট।
প্রশ্ন আসে, এটাই কি সেই আওয়ামী লীগের নমুনা, যার প্রতিষ্ঠা হয় দেশের আম জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে? শুধু তাই নয়, দেশে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকার সুযোগে আওয়ামী লীগের বিরোধী কেউ যদি স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে সরকারের কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধাচরণ করে, তাকে তার জন্য হত্যাও করা চলবে এবং সে হত্যাকান্ডের কোনো প্রতিবাদও করা চলবে না। এর পরও কি বলতে হবে ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সরকার যা করছে, তা ঠিকই করছে? এবং এর প্রতিবাদ করাই অন্যায়?
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।