Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হলে অপরাধ কমে যাবে

জুবায়ের আহমেদ | প্রকাশের সময় : ১৬ অক্টোবর, ২০১৯, ১২:০২ এএম

১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে একটি নতুন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্মের পর সময়ে সময়ে ক্ষমতায় থাকা সরকারদের অধীনে উল্লেখ করার মতো উন্নয়ন ঘটলেও বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী শেখ হাসিনার সরকারের চলমান তৃতীয় মেয়াদসহ দীর্ঘ ১১ বছরে যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক মাধ্যমেই উন্নয়ন হচ্ছে নিয়মিত। এ সরকারকে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে আখ্যায়িত করা গেলেও সুশাসনে ব্যর্থতা, আইন শৃঙ্খলার অবনতি, ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থতা সহ সরকার দলীয় নামমাত্র নেতা-কর্মীদের ক্ষমতার প্রভাবের কাছে জিম্মি দেশের মানুষ।

দেশের সাধারণ নাগরিকরা সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে মুগ্ধ হলেও তারা শুধু উন্নয়ন বুঝে না, বুঝে দ্রব্যমূল্যের দাম কেমন যাচ্ছে, দেশে সুশাসন আছে কিনা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কেমন এবং সর্বোপরি ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারছে কিনা সরকার, এই বিষয়গুলোর উপরই সাধারণ নাগরিকদের সবচেয়ে বেশি দৃষ্টি থাকে। মূলত একটি সরকারকে তখনই সফল বলা যায় যখন সুশাসন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, ঘুষ বাণিজ্যের নির্মূল এবং ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা হয়, কিন্তু বরাবরের মতোই দেশ স্বাধীনের পর প্রতিটি সরকারের মতোই চলমান সরকারের ব্যর্থতার জায়গাও এগুলো। সুশাসন ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় সরকারের আন্তরিকতার কমতি না থাকলেও ক্ষমতার লোভে অন্ধ হয়ে যারা নিজেদের আখের গুছাতে ব্যস্ত এবং প্রভাব বিস্তারে ব্যস্ত তাদের কারনেই মূলত সরকার বাধাগ্রস্থ হয় বারবার, নীতি নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে, ক্ষমতাকে দেশ ও জাতির কল্যাণে ব্যবহার না করে ভোগ বিলাসে মত্ত থাকা এবং তৃণমূল নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার কারণেই সারাদেশের আনাচে-কানাচে খুন, গুমসহ ত্রাসের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ভালো কাজ এখন এতোই সোনার হরিণ হয়ে গেছে যে, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা ও ব্যবস্থা গ্রহণ ব্যতীত কোনো কাজই হচ্ছে না দেশে। ছোট্ট একটি দেশে প্রয়োজনের চেয়েও বেশি মন্ত্রণালয়, কর্মকর্তা-কর্মচারী থাকলেও নেই সুশাসন, নেই ন্যায় বিচার, নেই মানুষের স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুর অধিকার, নেই পরিবার পরিজন নিয়ে শান্তিতে বসবাসের অধিকার।
সময়ে সময়ে বাংলাদেশ সব সরকারের আমলেই এমন কিছু হত্যাকান্ড হয় যার বিচার করা সম্ভব হয় না। জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যার বিচার পর্যন্ত সঠিক সময় হয়নি বাংলাদেশে, সাবেক রাষ্ট্রপ্রতি জিয়াউর রহমানের হত্যার বিচারও হয়নি। এছাড়াও সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনী হত্যাকান্ডসহ সময়ে সময়ে বহু হত্যাকান্ডের বিচার না হওয়ার পর সা¤প্রতিক সময়ে বহু আলোচিত নির্মম হত্যাকান্ডের দ্রুত বিচার হয়নি, কোনো কোনো হত্যাকান্ডের বিচার হলেও পরবর্তীতে আসামীরা বিভিন্নভাবে পার পেয়ে যায়, কখনো কখনো আসল আসামীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়।

ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় প্রতিটি সরকার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। যার ফলে হত্যাকান্ডের শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ, মেধাবী ছাত্র। শুধুমাত্র সাধারণ মানুষ কিংবা বিরোধী দলগুলোর নেতাকর্মী-সমর্থকই নয় স্বয়ং ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী-সমর্থকদের হত্যাকান্ডের বিচার করাও সম্ভব হচ্ছে না। কোনো কোনো মামলার আসামি সনাক্ত করতেই বছরের পর বছর চলে যায়, তদন্ত প্রতিবেদনে চলে যায় বহু বছর।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বাংলাদেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠলে প্রতিটি হত্যাকান্ডের তীব্র প্রতিবাদ ও আন্দোলন গড়ে তোলা হয়। কথা হলো হত্যাকান্ড কিংবা যেকোন জঘন্য অপরাধ সংঘটিত হলে প্রতিবাদের কিংবা আন্দোলনের প্রশ্ন আসবে কেনো? অপরাধের জন্য আইন আছে, আইনের স্বাভাবিক গতিতে অপরাধীদের বিচারের আওতায় এনে বিচার কার্যক্রম সম্পন্ন হলেই তো আর প্রতিবাদ, আন্দোলনের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু বাংলাদেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি এতোটাই প্রকট আকার ধারণ করেছে যে, এখানে হত্যাকান্ড কিংবা যেকোন ধরনের জঘন্য অপরাধ সংঘটিত হলে মানুষ ধরেই নেয়, ন্যায় বিচার হবে না, তাই মানুষকে প্রতিবাদ করতে হয়, আন্দোলন করতে হয়। আবার কখনো কখনো এই ধরনের প্রতিবাদ ও আন্দোলন করতে গিয়েও নির্মম মৃত্যুর শিকার হতে হয়, যার বহু নজির বাংলাদেশে রয়েছে। বাংলাদেশে যে আইনের শাসন নেই, এর বড় প্রমাণ হলো অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পরই মানুষের আন্দোলন, প্রতিরোধ ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার দাবি জানানো যেকোন ধরনের কার্যক্রমগুলো।

বিচার বিভাগ ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকারবদ্ধ হলেও অপরাধীরা ক্ষমতাসীন দলের লোক হওয়ায়, দলের ছত্রছায়ায় থাকায় কিংবা প্রভাবশারী রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী কিংবা তাদের কাছের লোক হওয়ায় অপরাধী সনাক্ত করা গেলেও স্বাভাবিক ন্যায় বিচার লঙ্ঘিত হয়। অপরাধীরা প্রভাবশালী হলেই ন্যায় বিচারের বাণী নিভৃতে নিরবে কাঁদে, মানুষজনের প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, আন্দোলনেও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা পায় না। এই সংস্কৃতি থেকে বের হওয়ার বড্ড প্রয়োজন, না হয় ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশ ভালো থাকবে না, ভালো থাকতে পারে না।

বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদের নির্মম হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে উত্তাল সারা দেশ। প্রতিবাদ আর আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে। এর আগে কুমিল্লায় তনু, ফেনীতে নুসরাত হত্যাকান্ড নিয়েও এমন পরিস্থিতি তৈরী হয়েছিল। কিন্তু তনু হত্যা মামলায় দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই, নুসরাত হত্যা মামলায় কাউকে কাউকে আসামীদের গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি করলেও সময়ক্ষেপণ হচ্ছে বিচার কার্যে। আবরার হত্যায় জড়িত কয়েকজন আসামিকে গ্রেফতার করা হলেও আরো আসামি এখনো পলাতক।
ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা ব্যতীত একটি দেশ আগাতে পারে না, দেশের মানুষ ভালো থাকতে পারে না। বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে দেশ আচ্ছন্ন হয়ে যাওয়ার কারণে সঠিক বিচারের জন্য মানুষ রাস্তায় নামছে। আইন ও প্রভাবশালীদের উপর অনাস্থার কারণে মানুষকে প্রতিবাদ করতে হচ্ছে ঘর থেকে বের হয়ে, যার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী নষ্ট হচ্ছে দেশের সুনাম। দেশের মানুষও এই উত্তাল পরিস্থিতিতে ভালো নেই। ন্যায় বিচার না থাকার কারণে শিক্ষা, চিকিৎসা, ক্রীড়া, ব্যবসা বাণিজ্যসহ প্রত্যেকটি সেক্টরের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়। কাজেই হত্যাকান্ড ও ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধগুলোর বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করুন। ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা পেলে দেশ ভালো থাকবে, দেশ এগিয়ে যাবে, দেশের মানুষ ভালো থাকবে, তাই অপরাধী যেই হোক তাকে বিচারের আওতায় আনুন, দ্রুততম সময়ে শাস্তি কার্যকর করুন। তাহলেই আর কোন অপরাধী হত্যাকান্ড ও ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ করার আগে পরিণতির কথা দশবার ভেবে অপরাধ করা থেকে বিরত থাকবে, শান্ত হবে দেশের মাটিতে, শান্তিতে থাকবে দেশের মানুষ, সর্বোপরি ন্যায় বিচারের সুফল ভোগের কারনে এগিয়ে যাবে দেশ।
লেখক: শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব জার্নালিজম অ্যান্ড ইলেকট্রনিক মিডিয়া (বিজেম)



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন