পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বহু বছর পর ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ৬০ ও ৭০ দশকের আদলে কিছু স্লোগানশুনলাম এবং পত্রিকার পাতায় পড়লাম। তখন আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ ছিল বিরোধী দলে এবং সরকারি দলে ছিল হয় মুসলিম লীগ সামরিক কর্তৃপক্ষ। তখন তারা সরকার বিরোধী যে ধরনের স্লোগান দিতো কয়েক দশক পর সে ধরনেরই স্লোগান শুনলাম আবরার হত্যার পর আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মুখে। তবে পক্ষ বদলে গেছে। তখন বিরোধী পক্ষে ছিল আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, ভাসানী ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়ন প্রভৃতি দল। এখন সরকারি পক্ষে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ এবং বিরোধী পক্ষে ছাত্রলীগ ছাড়া অন্যান্য সাধারণ ছাত্র। যেসব স্লোগান নিয়ে এখন কথা বলছি, সেই সব স্লোগানকে ঘিরে বিএনপি বা জামায়াতকে এই মুহূর্তে বিরোধী দল বলছি না। কারণ তারা ঐ ধরনের স্লোগান বিগত এক দশক হলো দেয়নি। এদের মধ্যে বিএনপি বিরোধী দল হলেও হোয়াইট কলার্ড পার্টি।
যেসব স্লোগান সেদিন বুয়েটের ছাত্র আন্দোলনে এবং ডাকসুর ভিপি নুরুর নেতৃত্বাধীন সভা ও মিছিলে উচ্চারিত হয়েছিল সেগুলো হলো, ‘আমার নদী ফিরিয়ে দে, নইলে গদি ছেড়ে দে’; ‘দিল্লি না ঢাকা!, ঢাকা ঢাকা!’ ‘খুন হয়েছে আমার ভাই, খুনি তোদের রক্ষা নেই’; ‘দেশবিরোধী চুক্তি, মানি না মানব না’; ‘বুয়েট তোমার ভয় নাই, আমরা আছি লাখো ভাই’; ‘আর নয় প্রতিরোধ, এবার হবে প্রতিশোধ’; ‘দালালী না রাজপথ, রাজপথ রাজপথ’; ‘হই হই রই রই ছাত্রলীগ গেলি কই?’; ‘আমার ভাই আবরার আর কত লাশ চাই’; ‘আমার ভাই মরলো কেনো, প্রশাসন জবাব চাই’ প্রভৃতি।
শিক্ষার্থীদের মিছিলে এমন স্লোগান শুনে পথচারীরা দাঁড়িয়ে স্লোগান উপভোগ করেন। কেউ কেউ গাড়ি থামিয়ে স্লোগান সঙ্গে গলা মেলান। কেউ ফুটপাথ দিয়ে হাটার সময় নিজেরাও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে স্লোগান দেন ‘আমার নদী ফিরিয়ে দে, নইলে গদি ছেড়ে দে’। বহুদিন পর এমন দৃশ্য পথচারীদের হতবাক করে (ইনকিলাব ১১ অক্টোবর ২০১৯)।
বুয়েটে মেধাবী ছাত্র আবরারকে পিটিয়ে হত্যার পর সারাদেশে যে প্রচন্ড ছাত্রলীগ তথা আওয়ামী বিরোধী আন্দোলন শুরু হয় সেটি সাম্প্রতিককালে আর দেখা যায়নি। বুয়েট আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনা বিশ^বিদ্যালয়ে। জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়েও আন্দোলন হয় তবে ছাত্রলীগ তাদের অতি পরিচিত চরিত্র মোতাবেক সাধারণ ছাত্রদের মিছিলে হামলা করে। এর আগে তারা ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে ছাত্রদলের মিছিলে হামলা করেছিল। কিন্তু পরদিন ছাত্রদল আবার ঘুরে দাঁড়ায় এবং ক্যাম্পাসে মিছিল করে। এক কথায় বলা যায়, বাংলাদেশ প্রায় দুই যুগ পর গণঅভ্যুত্থান না দেখলেও গণজাগরণ দেখলো।
দিল্লীতে অতি সম্প্রতি অফিসিয়াল সফর (রাষ্ট্রীয় সফর নয়। স্টেট ভিজিট এবং অফিসিয়াল ভিজিটের মধ্যে তফাৎ রয়েছে। সেটা একটু পরে বলছি) কালে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে যে ৫৩ দফা যৌথ চুক্তি ইশতেহার প্রকাশিত হয়েছে সেই ইশতেহারের প্রতিবাদে গত শনিবার ঢাকায় বিএনপির নয়া পল্টন অফিসের সামনে একটি গণসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। বিএনপি কয়েক দিন আগেই এই সমাবেশের জন্য সরকারের নিকট অনুমতি প্রার্থনা করে। ঢাকায় সমাবেশটি হওয়ার কথা ছিল শনিবার। শুক্রবার রাতে পুলিশ বিএনপির আবেদন প্রত্যাখ্যান করে। পরদিন অর্থাৎ শনিবার বেলা ১২টায় বিএনপি আবার পুলিশের কাছে যায় এবং সমাবেশের অনুমতি দেওয়ার জন্য অনুরোধ করে। কিন্তু তার পরেও অনুমতি মেলেনি। তখন বিএনপি মুখে মুখে এবং মোবাইল টেলিফোনে তাদের নেতা ও কর্মীদের মাঝে বলে যে, তারা অনুমতি ছাড়াই নয়া পল্টন অফিসের সামনে সমাবেশ করবে। শুধুমাত্র এতটুকু অনুল্লেখযোগ্য প্রচারণার ফলে বিএনপি অফিসের সামনের রাস্তা লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। সমাবেশের একটি কর্নার ছিল ফকিরাপুলে, অপর কর্নারটি ছিল নাইটিঙ্গেল মোড়ে। এই সমাবেশের ছবি অনেক পত্রিকাই ছাপায়নি। তবে রবিবারের ‘ডেইলি স্টারের’ শেষ পৃষ্ঠায় ছবিটি ছাপা হয়েছে। সেই ছবিটি আমরা ইনসেটে দিলাম। ছবিতে দেখুন কি বিপুল জনসমাগম।
মুখে মুখে বলার ফলে যদি এত বিপুল জনসমাগম হয় তাহলে ৩/৪ দিন ধরে যদি সারা ঢাকায় মাইকে পাবলিসিটি দেওয়া হয়, মিটিংয়ের জন্য সারা ঢাকায় পোস্টার মারা হয় এবং ব্যানার ও ফেস্টুন ছাপা হয় তাহলে বিএনপির মিটিং কত বিশাল হতে পারে সেটি কল্পনা করুন। আর যদি অবিসংবাদিত নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া জেলের বাইরে থাকেন এবং তিনিই যদি সেই জনসভার প্রধান বক্তা থাকেন, তাহলে সারা ঢাকা সেই জনসমাবেশে উপচে পড়বে, এতে কোনো সন্দেহ নাই।
দুই
আমরা কিছুক্ষণ আগেই বলেছি যে, ঢাকায় গণজাগরণ সৃষ্টি হয়েছে, কিন্তু গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি হয় নাই। অথচ, এর মধ্যেই গণঅভ্যুত্থান হতে পারতো। কেন হয় নাই? সেটিই আজ বড় প্রশ্ন। আজ যদি বিএনপি তাদের লাখো লাখো সমর্থক নিয়ে রাজপথ কাঁপিয়ে দিতে পারতো তবে পরিস্থিতি ভিন্নতর হতো। কিন্তু বিএনপি মুখে যতই বলুক বাস্তবে দেখা যাচ্ছে রাস্তায় নামতে তার দারুণ অনীহা। এটি কি ভয় ভীতি ও ত্রাসের জন্য? নাকি তার ফাইটিং স্পিরিট একেবারে শূন্যের তলায় এসে ঠেকেছে? এসম্পর্কে আমরা ইতোপূর্বেও আলোচনা করেছি। তবে যতই দিন যাচ্ছে ততই আওয়ামী লীগ এবং সরকারের জুলুম বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিএনপি সেই যে ৩/৪ বছর আগে বলেছিল সে ঘর গোছাচ্ছে, সে ৩/৪ বছর ধরেই ঘর গুছিয়েই চলেছে। এই ঘর গোছানো আর শেষ হয় না। বিগত ১ বছর ৯ মাস হলো বলছে যে, আইনী প্রক্রিয়ায় বেগম জিয়ার মুক্তি আসবে না। কারণ সরকার লাগামহীনভাবে শুধু নিম্ন আদালতকে নয়, উচ্চ আদালতকেও প্রভাবিত করছে। তাই বিএনপি নেতারাও বলছেন যে, রাজপথের আন্দোলন ছাড়া বেগম খালেদা জিয়াকে জেল থেকে বের করা যাবে না। এখন পর্যন্ত তাদের আন্দোলন সাংবাদিক সম্মেলন এবং মানব বন্ধনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। প্রতিদিনই মানব বন্ধন হচ্ছে এবং প্রতিদিনই তারা জনগণকে বলছেন, আপনারা রাজপথে নামার জন্য প্রস্তুত হন। জনগণ তো প্রস্তুত হয়েই আছে। এখন জনগণ বিএনপিকে বলতে চাচ্ছে, ‘আমরা তো প্রস্তুত হয়েই আছি। এখন আপনারাই প্রস্তুত হন, রাজপথে নেমে আসুন এবং আমাদেরকে ডাক দিন। দেখবেন কত হাজারে হাজারে লোক রাজপথে নামেন।’ কিন্তু বিএনপির নেতারা রাজপথের কথা শুধুমাত্র মুখে বলেই খালাস। কবে তারা রাজপথে নামবেন এবং কবে বেগম জিয়া মুক্ত হবেন, অথবা কবে তারা রাজপথে নামবেন এবং কবে গণতন্ত্র মুক্তি পাবে, সেটি একমাত্র আল্লাই মালুম। এ যেনো অনেকটা সেই প্রবাদ বাক্যের মতো, ‘কবে নয় মণ তেল জুটবে, আর কবে রাধা নাচবে।’
তিন
আমরা আগেই বলেছি যে, এবারে শেখ হাসিনার দিল্লি সফরটি ছিল অফিসিয়াল ভিজিট, স্টেট ভিজিট নয়। স্টেট ভিজিটে রাষ্ট্র প্রধান বা সরকার প্রধান অপর দেশের রাষ্ট্র প্রধান বা সরকার প্রধানকে বিমান বন্দরে রিসিভ করেন। কিন্তু অফিসিয়াল ভিজিটে তাকে রিসিভ করেন একজন মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী। এবার শেখ হাসিনাকে দিল্লি বিমান বন্দরে রিসিভ করেছেন একজন প্রতিমন্ত্রী। কারণ এটি ছিল অফিসিয়াল ভিজিট। তার পরেও এই সফরকালে বাংলাদেশ ফেনী নদী থেকে ভারতের ত্রিপুরায় পানি নেওয়ার জন্য ভারতকে অনুমতি দিয়েছে। বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলে পর্যবেক্ষণের জন্য ভারতকে ২০টি রাডার স্থাপনের অনুমতি দিয়েছে। বঙ্গপোসাগরে যে দুটি চীনা সাবমেরিন রয়েছে সেই সাবমেরিন দু’টির ওপর এই রাডার নজরদারি করবে। যৌথ ইশতেহারে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরে ভারতীয় জাহাজ আসা যাওয়ার জন্য স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর তৈরির কথা বলা হয়েছে, উত্তর পূর্ব ভারতে লিকুফাইড পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) রপ্তানি করতে সম্মত হয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের রামকৃষ্ণ মিশনে স্বামী বিবেকানন্দ ভবন তৈরির অনুমতি দিয়েছে।
এত সব কিছু দেওয়ার পর বাংলাদেশ তিস্তার এক ঘটি পানিও আনতে পারেনি। যৌথ ইশতেহারে তিস্তা নাই, নাগরিক পঞ্জির ফলে বাংলাদেশে ভারতীয় মুসলমানদেরকে ঠেলে দেওয়ার কোনো কথা নাই। তিস্তা সম্পর্কে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। ভারতীয়দের এই আশ্বাসে বিশ্বাস করার কোনো কারণ নাই। কারণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যখন ক্ষমতায় ছিলেন তখন ১৯৭৪ সালের ১৬ মে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি বলে বেরুবাড়ি ভারতকে প্রদান করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার দুই মাসের মধ্যেই বেরুবাড়ি ভারতের নিকট হস্তান্তর করা হয়। কথা ছিল যে বেরুবাড়ি ভারতকে প্রদানের বিনিময়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সংযুক্ত ৩ বিঘা করিডোর বাংলাদেশকে দেওয়া হবে। বেরুবাড়ি ঠিকই ভারতকে দেওয়া হয়, কিন্তু ভারতীয় সংবিধান সংশোধনের দোহাই দিয়ে তিন বিঘা করিডোর আর বাংলাদেশকে দেওয়া হয়নি। প্রায় ৪০ বছর পর ভারত ৩ বিঘা করিডোর বাংলাদেশকে দেয়। মাত্র ৩ বিঘার জন্য বাংলাদেশকে ৪০ বছর অপেক্ষা করতে হয়।
অনুরূপভাবে ভারত বাংলাদেশকে বলে যে তারা পরীক্ষামূলকভাবে ফারাক্কার পানি প্রত্যাহার করতে চায়। সেই যে পরীক্ষামূলক প্রত্যাহারের কথা বলা হয় সেই পরীক্ষামূলক প্রত্যাহার আর শেষ হয়নি। তারা পানি প্রত্যাহার করতেই থাকে। ২৬ বছর ধরে প্রত্যাহার করার পর তারা গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি করে। এর আগে ১৯৭৭ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলে প্রথম চুক্তি হয়। কিন্তু ঐ চুক্তিতে বাংলাদেশ লাভবান হয়েছিল বলে সেই চুক্তি বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যে গঙ্গা চুক্তি হয় সেই চুক্তিতে আগেকার গ্যারান্টি ক্লজ রাখা হয়নি এবং বাংলাদেশ আগের তুলনায় পানি কম পায়। এখন তো চুক্তি মোতাবেক পানিও ভারত বাংলাদেশকে দিচ্ছে না।
এই পটভূমিতে তিস্তা নিয়ে আবারও আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। ৪৮ বছর হয়ে গেলো শুধু আশ্বাস আর আশ্বাস। আর কত ৪৮ বছর লাগবে চুক্তি করতে সেটি কেউ জানে না।
Email: journalist [email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।