Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অপরাধ নির্মূলে এক চুলও ছাড় নয়

জালাল উদ্দিন ওমর | প্রকাশের সময় : ১৫ অক্টোবর, ২০১৯, ১২:০৩ এএম

রাজনৈতিক প্ল্যাটফরম ব্যবহার করে এক শ্রেণির মানুষ দেশে আজ নানা ধরনের অপরাধে লিপ্ত হয়েছে। রাজনৈতিক পরিচয় এবং পদবি ব্যবহার করে তারা সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি এবং দুর্নীতিসহ নানা ধরনের অপরাধ করছে। তারা ক্যাসিনো ব্যবসায় জড়িত রয়েছে। এ সবের মাধ্যমে তারা আজ অভাবনীয় টাকা ইনকাম করছে। অনেকেই এখন আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ। এক সময়ের বিত্তহীন এসব মানুষ আজ রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে নানা অপরাধের মাধ্যমে বিলাসবহুল বাড়ি গাড়ির মালিক। তারা লাগামহীন বিলাসী জীবনযাপন করছে এবং দেহরক্ষী পরিবেষ্টিত হয়ে চলাফেরা করছে। সরকার এখন এই সব অপরাধে জড়িতদের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান শুরু করেছে। এ অভিযানে ইতোমধ্যেই অনেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন এবং অনেকে গ্রেপ্তারের ভয়ে পালিয়ে গেছেন। এই অভিযানে যে সব চিত্র বেরিয়ে এসেছে, তা রীতিমত ভয়ংকর, হতাশাজনক এবং উদ্বেগের বিষয়। কারণ একজন ব্যক্তির কাছে যখন শত কোটি টাকার ব্যাংক ডিপোজিটের রশিদ পাওয়া যায়, একজন ব্যক্তির বাড়িতে যখন সিন্দুক ভর্তি টাকা এবং কয়েক শত ভরি স্বর্ণ পাওয়া যায়, তখন তারা কী পরিমাণ দুর্নীতিতে জড়িত তা সহজেই অনুমেয়। দেশের প্রায় এক কোটি মানুষ বিদেশের মাটিতে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে দেশে টাকা পাঠায় আর এই সব ব্যক্তি রাজনৈতিক পরিচয় বহন করে নানা ধরনের অপকর্মের মাধ্যমে টাকা আয় করে তা বিদেশে পাচার করে। দেশের অতি সাধারণ মানুষও এই দুর্নীতির মাত্রা এবং গভীরতা সম্পর্কে বুঝতে পেরেছেন। সুতরাং, অপরাধ এবং অপরাধীর বিরুদ্ধে কোনো ছাড় দেয়া যাবে না। যে কোনমূল্যে এই অপরাধের মূল উৎপাটন করতেই হবে। অপরাধ নির্মূলে অভিযান শুরু করার জন্য আমরা প্রধানমন্ত্রীকে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানাই। আমরা আশা করবো, সরকার সকল ধরনের অপরাধ নির্মূলে কাজ করবে এবং অপরাধ নির্মূলের এই অভিযান অব্যাহত রাখবে এবং এক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করবে। 

আইন এবং নিয়ম বহির্ভূত যে কোনো কাজই অপরাধ। ঘুষ, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডার বাজি এবং নারী নির্যাতন সবই অপরাধ। দুর্নীতি শত ধরনের অপরাধের মাঝে একটি অপরাধ মাত্র। যেই দুর্নীতিকে নির্মূল করাই ছিল আমাদের স্বপ্ন, সেই দুর্নীতিই এখন এদেশে বেশি প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। বর্তমানে দেশের এমন কোনো সেক্টর নেই, যেখানে অপরাধ নেই। অপরাধ আজ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো ভিন্ন মতাবলম্বী ছাত্রদের জন্য নির্যাতন সেলে পরিণত হয়েছে। হলে সহাবস্থানের কোনো পরিবেশ নেই। সচেতন নাগরিক মাত্রই দেশের অপরাধের ভয়াবহ অবস্থা সম্পর্কে অবহিত এবং ইচ্ছা করলেই অবহিত হতে পারবেন। অপরাধের কোনো সুনির্দিষ্ট সীমারেখা নেই এবং এর পরিধি অত্যন্ত ব্যাপক ও বিস্তৃত। ঘুষ ছাড়া কাজ না করা এবং কলমের মাধ্যমে অন্যায়ভাবে কারো জন্য সুপারিশ করাটা অপরাধ। অন্যায়ভাবে চাকরি নেওয়া, ন্যায় বিচার না করা, অন্যায়ভাবে টেন্ডার আয়ত্ত করা, ওজনে কম দেওয়া, খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল দেওয়া, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অবৈধভাবে ভর্তি হওয়া, দায়িত্বে ফাঁিক দেওয়া এবং অবহেলা, অপরকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা সবই অপরাধ। যথাযথ ট্যাক্স না দেওয়া, ট্যাক্স যথাযথ আদায় না করা, সত্য কথা না বলা, মিথ্যা কথা বলা এবং মিথ্যা রিপোর্ট লেখা, ওয়াদাসমূহ যথাযথভাবে পালন না করা এবং আমানতদারিতা ভঙ্গ করাও অপরাধ। একইভাবে ক্যাসিনো ব্যবসার মাধ্যমে অর্থ উপার্জনও একটি অপরাধ। নারী নির্যাতন এবং নারীকে উত্যাক্ত করাও অপরাধ। মাদক দ্রব্য গ্রহণ করা এবং মাদকের ব্যবসাও অপরাধ। মানুষকে নির্যাতন করা এবং বিনা বিচারে হত্যা করা আরো জঘন্য অপরাধ। অতএব আসুন, সমাজের সর্বক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত এসব অপরাধ, অনিয়ম এবং দুর্নীতি থেকে জাতিকে রক্ষার জন্য আমরা সম্মিলিত প্রয়াস শুরু করি।
এসব অপরাধ সুশাসনের পথে বিরাট বাধা এবং শান্তির পথে অন্তরায়। এসব অপরাধ মানুষের জীবন থেকে সুখ এবং শান্তি বিদায় করে। ফলে সমাজে অশান্তির জন্ম নেয়। সুতরাং, সমাজের সর্বস্তর থেকে সকল প্রকার অপরাধ দূর করতে হবে। তার জন্য সরকারের পাশাপাশি সবাইকে তার নিজ নিজ অবস্থান থেকেও কাজ করতে হবে। আইন যদি তার নিজস্ব গতিতে চলে এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থা যদি নিরপেক্ষভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করে, তাহলে অপরাধী যেই হোক না কেন তার শাস্তি হবেই। আর একজন অপরাধী যদি তার অপরাধের জন্য শাস্তি পায়, তাহলে অন্যরা কিন্তু অপরাধ করতে সাহস করবে না। ফলে সমাজে অপরাধ কমে আসবে। কিন্তু অপরাধীরা তার অপকর্মের জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না পাওয়ায় বেপরোয়া হয়ে উঠছে। আজ এক শ্রেণির মানুষ অবৈধ পথে অর্থ উপার্জনের জন্য রাজনীতিকে সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করছে। তারা রাজনৈতিক পরিচয় দিয়ে দেশে প্রভাব সৃষ্টি করছে এবং সেই প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে চাঁদাবাজি করছে, টেন্ডারবাজি করছে, সন্ত্রাস করছে এবং যখন যা খুশি তাই করছে। এর মাধ্যমে তারা রাতারাতি কোটিপতি হয়ে যাচ্ছে। এসব ব্যক্তি যেহেতু রাজনৈতিক পরিচয়ে সমাজে পরিচিত, সেহেতু সবাই তাদেরকে ভয় পায়। ফলে তারা হয়ে উঠে আরো বেপরোয়া।
এসব রাজনৈতিক সন্ত্রাসীর ছত্রছায়ায় আজ এক শ্রেণির কিশোর পড়াশোনা না করে বিভিন্ন ধরনের অপকর্মে লিপ্ত হচ্ছে। এসব কিশোর পড়াশোনার পরিবর্তে এখন মাদক দ্রব্য গ্রহণ করে, ইয়াবা পাচার করে, সন্ত্রাস করে, চাঁদাবাজি করে। এরা বড় অপরাধীর সহযোগী হিসেবে কাজ করে। বড় অপরাধীরা কিশোর মনের তারুণ্যকে ব্যবহার করে এসব কিশোরদেরকে কৌশলে অপরাধী হিসাবে গড়ে তুলছে এবং তাদের অপকর্ম সংঘটিত করার কাজে সহযোগী হিসেবে ব্যবহার করছে। এসব কিশোররা দলবেঁধে রাস্তার মুখে, মার্কেটের সামনে এবং খেলার মাঠে আড্ডা মারে আর বড় সন্ত্রাসীদের লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে কাজ করে। এরা স্কুল-কলেজ পড়–য়া মেয়েদেরকে উত্যাক্ত করে। এরা হচ্ছে উঠতি সন্ত্রাসী। এদের অপকর্মে জনজীবন অতিষ্ঠ এবং ভীত-সন্ত্রস্ত। এভাবে কিশোর, তরুণ, যারা হবে আগামী দিনের দেশ ও জাতির কান্ডারী, তারা আজ নিজের অজান্তেই অপধারী হিসেবে গড়ে উঠছে। এভাবে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সরকারের প্রতি বিনীত অনুরোধ জানিয়ে বলছি, এসব কিশোর গ্যাংয়ের প্রতি কঠোর হতে হবে। আশার কথা, সরকার কিশোর গ্যাংগুলোর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে। আশা করব, সরকারের এ পদক্ষেপ অব্যাহত থাকবে। পাশাপাশি অভিভাবকদের বলব, আপনার কিশোর বয়সের ছেলেটি ঠিক মতো স্কুলে যাচ্ছে কিনা, পড়াশোনা করছে না তা মনিটরিং করুন। কোনো অবস্থাতেই আপনার স্কুল এবং কলেজ পড়–য়া সন্তানটি যেন কিশোর গ্যাংয়ের অন্তর্ভুক্ত না হয় এবং কোনো অপরাধে জড়িয়ে না পড়ে, সেই বিষয়টি অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে।
সরকারের অপরাধ বিরোধী অভিযানে ইতোমধ্যে অনেক বড় বড় অপরাধী গ্রেপ্তার হয়েছে। এসব ব্যক্তির অপরাধের মাত্রা দেখে সত্যিই অবাক হতে হয়। দেশে খেলাধুলার চর্চা এবং ক্রীড়াবিদ সৃষ্টির জন্য যে ক্লাবগুলোর জন্ম, সেই ক্লাবগুলো আজ ক্যাসিনো খেলার স্থানে পরিণত হয়েছে। এসব ক্লাবে নিয়মিতভাবে জুয়া খেলার আড্ডা বসত। সুতরাং এসব অপরাধীকে তাদের কৃতকর্মের জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। পাশাপাশি যেসব অপকর্মের হোতারা পালিয়ে গেছে অথবা আত্মগোপন করে আছে তাদেরকেও গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। আর অপকর্ম বিরোধী এই অভিযান সবসময় অব্যাহত রাখতে হবে এবং এটি হতে হবে একটি চলমান প্রক্রিয়া। কারণ এই অভিযানে বিরতি দিলে অপরাধীরা আবার আপন জায়গায় ফিরে আসবে এবং পুনরায় আবার অপকর্ম শুরু করবে। এদিকে অপরাধী ধরতে পরিচালিত এই অভিযানের পাশাপাশি পুলিশ এবং প্রশাসনসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহে ও শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করতে হবে। কারণ সরকারি প্রতিষ্ঠানের অনেক কর্মকর্তা ও দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত হয়ে পড়েছে। থানার পাশে কীভাবে জুয়ার আসর বসত সেটি তো রহস্যময় একটি ব্যাপার। প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তা যে এসবে জড়িত, সে ব্যাপারে সন্দেহ থাকার কথা নয়। আর প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকতার যোগসাজস ছাড়া অবৈধভাবে টেন্ডার আয়ত্ত করাটা যে সম্ভব নয়, তা দেশের সাধারণ মানুষও আজ বুঝে। শুধুমাত্র ভিন্ন মত প্রকাশের কারণে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ এবং মেধাবীদের স্থান বুয়েটে একজন ছাত্রকে যেভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হল, তা কোনো সভ্য সমাজে হতে পারে না। এ ধরনের বর্বরতাকে কল্পনাও করা যায় না। এর নিন্দা জানানোর ভাষা নেই এবং এর সাথে জড়িতদের ঘৃণা করতেও ঘৃণা হয়। অথচ হত্যাকারীরা বুয়েটেরই ছাত্র। এই শিক্ষা এবং রাজনীতি দিয়ে জাতির কোনো কল্যাণ হবে না এবং এই ছাত্র রাজনীতির কোনো দরকার নেই। এই হত্যাকারীদেরকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ বিশ^বিদ্যালয়সমূহে আজ শিক্ষিকদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপকর্মের অভিযোগ উঠছে, যা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক এবং লজ্জাজনক।
অতীতের অনেকগুলো দিনকে আমরা নষ্ট করেছি। এবার অন্তত আসুন, ভবিষ্যতকে সুন্দর করার জন্য আমরা কাজ শুরু করি। একটি অপরাধমুক্ত সুন্দর সমাজ নির্মাণের জন্য আসুন আমরা সবাই মিলে একটি সৎ এবং চরিত্রবান প্রজন্ম গড়ে তুলি; আমরা মাদককে না বলি এবং একটি মাদক মুক্ত সমাজ গঠন করি; আমরা দুর্নীতিকে পরিহার করি এবং একটি দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠন করি; আমরা নারী নির্যাতন বন্ধ করি এবং নারী নির্যাতন মুক্ত একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা করি এবং শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করি। কারণ, একটি জাতিকে রক্ষার জন্য একটি প্রজন্মকে রক্ষা করতে হবে। একটি জাতিকে গঠনের জন্য একটি প্রজন্মকে গঠন করতে হবে। আমরা যদি একটি সৎ এবং দুর্নীতি মুক্ত প্রজন্ম গড়ে তুলতে পারি তাহলে সেই প্রজন্ম তার পরবর্তী প্রজন্মকে সৎ এবং দুর্নীতি মুক্ত হিসেবে গড়ে তুলবে। এভাবে ধারাবাহিকতায় ভবিষ্যতে একদিন পুরো জাতিটাই সৎ এবং দুর্নীতিমুক্ত হিসেবে গড়ে উঠবে। অতএব আসুন, আমরা প্রত্যেকেই সৎ হই, অপরকে সৎ হিসেবে গড়ে তুলি এবং নির্মাণ করি একটি দুর্নীতিমুক্ত এবং অপরাধমুক্ত সমাজ। তাহলেই আমাদের জীবন সুন্দর এবং সুখের হবে।
লেখক: প্রকৌশলী ও উন্নয়ন গবেষক



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন