Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিম্নস্তরই শিক্ষার মানোন্নয়নে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ

সরদার সিরাজ | প্রকাশের সময় : ১৪ অক্টোবর, ২০১৯, ১২:০২ এএম

শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড, এই বহুল প্রচলিত প্রবাদ বাক্যটির প্রচলন আদিকালেই। ইসলামের নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) বলেছেন, ‘জ্ঞান অর্জনের জন্য সুদূর চীনে যেতে হলেও যাও।’ শিক্ষা ছাড়া জ্ঞানার্জন সম্ভব নয়। আর সে জ্ঞান হচ্ছে চতুর্মুখী জ্ঞান। এটা ব্যক্তি পর্যায়ে যেমন সত্য, তেমনি রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও। তাই শিক্ষার গুরুত্ব সর্বাধিক এবং তা সকলের জন্যই। এটি সকলের মৌলিক অধিকারও। তাই প্রতিটি দেশেই শিক্ষাখাতে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়। আধুনিক যুগের শিক্ষা হচ্ছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক। এর সাথে নেতিকতাও আবশ্যক। কারণ, নৈতিকতাহীন শিক্ষায় মানুষ ‘মানুষ’ হতে পারে না। আর অনৈতিক মানুষ যতই দক্ষ হোক, সে অকল্যাণকর।

এ দেশে অসংখ্য মানুষ এখনো অশিক্ষিত-নিরক্ষর। অনেক চেষ্টা করার পর সরকারি তথ্য মতে, ২০১৯ সালে সাক্ষরতার হার ৭৩.৯% দাঁড়িয়েছে। সাক্ষরতার সাথে যুক্ত বেসরকারি সংস্থাগুলোর দাবি, সাক্ষরতার হার ৫১%। আর ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউ সাক্ষরতার হার নিয়ে যে বৈশ্বিক তালিকা-২০১৯ প্রকাশ করেছে, তাতে বাংলাদেশে সাক্ষরতার হার ৬১.৫% (১৩৯তম)। এসডিজি অর্জনের জন্য সাক্ষরতার হার শতভাগ নিশ্চিত করা আবশ্যক এবং তা অবশ্যই আন্তর্জাতিক মান অনুসারে। কারণ, বর্তমানে সাক্ষরতার মানদন্ড পাল্টেছে। আগে বলা হতো নাম স্বাক্ষর করতে পারলেই সে সাক্ষর। কিন্তু এখন বলা হচ্ছে চিঠি লিখতে, পড়তে ও বুঝতে এবং অংক কষতে হবে। তবেই সে সাক্ষর। সম্প্রতি প্রযুক্তি জ্ঞানকেও সম্পৃক্ত করার কথা বলছে অনেকেই। এসব বিবেচনায় দেশে সাক্ষর লোকের সংখ্যা বেশি নয়। দ্বিতীয়ত: যাদেরকে সাক্ষর করা হয়, তারাও কিছুদিন পর তা ভুলে যায় চর্চার অভাবে।
দেশে যারা শিক্ষিত, তাদের মান নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন আছে। স¤প্রতি বিবিসি’র খবরে প্রকাশ, ‘বাংলাদেশের প্রাথমিকের ৬৫% শিক্ষার্থী বাংলাই পড়তে পারে না। ইংরেজি ও গণিতে দুর্বলতা তার চাইতেও বেশি।’ গণসাক্ষরতা অভিযানের পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী জানিয়েছেন, প্রাথমিক শিক্ষার মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০’ প্রবর্তন করা হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। তবুও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব বলেছেন, ‘শিক্ষার মান উন্নয়নে প্রতিটি স্কুলে গণিত অলিম্পিয়াড চালুর ব্যাপারেও আমরা উদ্যোগ নিয়েছি। এছাড়া শিশুদের রিডিং ও রাইটিং এর উন্নয়নে ‘ওয়ান ডে ওয়ান ওয়ার্ড’ কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে। যেখানে প্রতিটি শিশুকে একদিন একটা ইংরেজি শব্দ এবং একটি বাংলা শব্দ শেখানো হবে। সব মিলিয়ে ২০২০ সাল নাগাদ প্রাথমিক পর্যায়ের প্রতিটি শিশুকে দক্ষ করে গড়ে তোলা হবে।’ কিছুদিন আগের সম্ভবত: জাতিসংঘের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা একাদশ পর্যন্ত যা শিখে, অন্য দেশের শিক্ষার্থীরা তা থি পর্যন্ত পড়েই শিখে।’ উচ্চ শিক্ষার অবস্থাও তথৈবচ! অর্থাৎ সার্বিকভাবে দেশে শিক্ষার মান কমতে কমতে এখন তলানীতে এসে পৌঁছেছে! অনৈতিকভাবে শিক্ষার হার বৃদ্ধি করতে গিয়ে এই সর্বনাশ ঘটেছে বলে পন্ডিতদের অভিমত। এই হচ্ছে দেশের সেকেলে শিক্ষার হালহকিকত। অথচ সেকেলে শিক্ষা আধুনিক যুগে অচল। কারণ, এই শিক্ষা কর্মহীন। তাই সেকেলে শিক্ষা দেশ-বিদেশের সর্বত্রই অচল। তবুও সে শিক্ষা ব্যবস্থাই আমরা আঁকড়ে ধরে পড়ে আছি। আর সে শিক্ষার জন্য নার্সারি থেকে উচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত গাদা গাদা বইখাতা এবং কোচিংয়ের বিপুল ব্যয় নির্বাহ করতে হচ্ছে অভিভাবকদের। এতে করে দেশের সাধারণ মানুষ সর্বস্বান্ত হচ্ছে। বিনিময়ে অভিভাবক ও দেশ তেমন সুফল পাচ্ছে না। আর ধনী ঘরের আলালের দুলালরা বিপুল অর্থ ব্যয় করে বিদেশে আধুনিক শিক্ষা গ্রহণ করছে এবং সেখানে সেটেল্ড হচ্ছে।

আধুনিক শিক্ষা হচ্ছে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি নির্ভর ও কারিগরি শিক্ষা। সে শিক্ষা দেশে তেমন নেই বললেই চলে। কারিগরি শিক্ষার অবস্থাও তথৈবচ। সরকারের দাবি মতে, বর্তমানে দেশে কারিগরি শিক্ষার হার ১৬.১%। কিন্তু গত ২ অক্টোবর প্রকাশিত এক দৈনিকে প্রকাশ, ‘দেশে বর্তমানে কারিগরি শিক্ষার হার ৮.৪৪%।’ অথচ বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে কারিগরি শিক্ষার হার ৬০-৭০%। জার্মানিতে এই হার ৭৩%। কারিগরি শিক্ষার উপর ভিত্তি করেই বিভিন্ন দেশ ব্যাপক উন্নতি করেছে। আমরা তার বিপরীত পর্যায়ে রয়েছি। উপরন্তু দেশে যে কারিগরি শিক্ষা আছে, তারও মান খুব খারাপ। কারণ, প্রয়োজনীয় শিক্ষক ও ল্যাবরেটরি নেই। এই করুণ দশা সরকারি প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেই বেশি। এই অবস্থায় ২০২১ সাল হতে ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত কারিগরি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে সরকার। সাধারণ ক্যাটাগরির পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও একটি ট্রেড কোর্স খোলার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও এ কোর্স চালু হবে। এ ব্যাপারে খুব শিগগিরই তাদের চিঠি দেয়া হবে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগের সচিব জানিয়েছেন। তিনি আরও বলেছেন, এটা হলে একজন শিক্ষার্থীকে শিক্ষাজীবন শেষ করে তাকে আর বসে থাকতে হবে না। এসব সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা দরকার ছিল অন্ততঃ আরও দশ-পনের বছর আগে। তা করা হয়নি। যাক লেট বেটার দ্যান নাথিং। এসব সিদ্ধান্ত খুবই প্রয়োজনীয়। কিন্তু এটা বাস্তবায়ন করার জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষক পাওয়া যাবে কি-না সন্দেহ রয়েছে। অন্ততঃ ৫-৭ বছর পর্যন্ত। কারণ, শিক্ষকের প্রচন্ড অভাব ও বেতন খুব কম। অবশ্য কারিগরি শিক্ষকদের বেলায় ‘আকর্ষণীয় বিশেষ ভাতা’ দেওয়া হলে সংকট হয়তো কিছুটা মিটতে পারে। স্মরণীয় যে, সরকার কারিগরি শিক্ষা হার ২০২১, ২০৩০ ও ২০৪০ সালের মধ্যে যথাক্রমে ২০, ৩০ ও ৪০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এজন্য দেশে জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়ন ও তার আলোকে জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠনসহ নতুন নতুন কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করছে বলে জানা গেছে। এ ব্যাপারে স¤প্রতি শিক্ষা উপমন্ত্রী এক দৈনিককে বলেছেন, ‘কারিগরিতে যেটুকু উন্নয়ন তা গত ১০ বছরে হয়েছে। বর্তমানে এই শিক্ষায় শিক্ষার্থীর হার ১৬ শতাংশ। তবে আমরা কারিগরি ও সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষার্থীর হার সমান সমান করতে চাই। ৩১৪টি উপজেলায় কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ১০০টি উপজেলায় টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ স্থাপন করা হচ্ছে। প্রকল্পের অস্থায়ী শিক্ষকদের স্থায়ী করা হচ্ছে। ২০২১ সালের মধ্যে আমরা সব স্কুলে অন্তত একটি করে হলেও কারিগরি ট্রেড খুলতে চাই। কম্পিউটার সায়েন্সকে আপডেট করার চিন্তাও আমাদের আছে। বর্তমানে কারিকুলাম আপডেট এবং শিক্ষকদের দক্ষ করা আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। আর বেসরকারি কারিগরি প্রতিষ্ঠানের মানেও উন্নয়ন ঘটাতে হবে।’ খুব ভালো উদ্যোগ। তবে মনে রাখতে হবে, এ দেশে কোনো কিছুই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারে না। এছাড়া, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি-অনিয়ম ইত্যাদি ব্যাপক।

দেশের শিক্ষকদের মধ্যে বিরাট অংশ তেমন দক্ষ নয়। তাই সৃজনশীল পদ্ধতি কি তা দীর্ঘদিনেও বুঝতে পারেননি অনেক শিক্ষক। তবুও সে উদ্ভট থিউরি চালু রাখা হয়েছে। শিক্ষকদের অদক্ষতার প্রধান কারণ, নিয়োগ প্রক্রিয়া অস্বচ্ছ। বেশিরভাগ শিক্ষক নিয়োগ পান দলীয় প্রীতি, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে! উপরন্তু তাদের বেশিরভাগই উপযুক্ত প্রশিক্ষণ পান না। ইউনেস্কোর সা¤প্রতিক গবেষণা রিপোর্ট মতে, ৫০% প্রাথমিক শিক্ষকের বছরের পর বছর কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ হয় না। বাংলাদেশে প্রশিক্ষিত শিক্ষকের এই হার এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে কম।’ দলীয়করণের কারণে সরকারি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দূষিত হয়ে পড়েছে। অপরদিকে, দেশের বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় শিক্ষক নেই। বিশেষ করে ইংরেজি, আইটি, পদার্থ বিজ্ঞান, অংক বিষয়ে। ফলে এসব বিষয়ে শিক্ষা খুবই ব্যাহত হচ্ছে। শিক্ষার মান হ্রাস পাওয়ার আরও কারণ হচ্ছে পরীক্ষায় অবাধ নকল ও প্রশ্নপত্র ফাঁস।

এ দেশে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার ব্যাপক। গত ২৪ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত শেভ দ্য চিলড্রেনসহ ৬টি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিবেদন মতে, বাংলাদেশে মাধ্যমিক পর্যায়ে ৪১% মেয়ে ও ৩৩% ছেলে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে। প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার আরও বেশি। দারিদ্র্যের কারণেই এটা হচ্ছে। তাই শিক্ষা ব্যয় হ্রাস করা দরকার। সরকার ২০২৬ সালের মধ্যে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষা চালু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এ প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হবে ধাপে ধাপে। প্রাথমিকভাবে আগামী বছর অবৈতনিক শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত হবে ষষ্ঠ শ্রেণি। পরের বছর সপ্তম শ্রেণি। এভাবে প্রতি বছর একটি শ্রেণি অবৈতনিক শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত হবে। এর পাশাপাশি শিক্ষার অন্যান্য ব্যয় বহনের জন্য শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি কার্যক্রম অব্যাহত রাখা হবে। উপরন্তু উপবৃত্তির আওতা ৪০% থেকে বাড়িয়ে ৬০% করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে বলে গত ৪ অক্টোবর এক দৈনিকে প্রকাশ। এসব ভালো উদ্যোগ। তাই সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা দরকার।

দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেরও মান নিয়ে প্রশ্ন আছে। যেমন: এখনো দেশের বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঝুঁকিপূর্ণ। কিছু ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে। তাই খোলা মাঠে, গাছে নিচের ক্লাস করাতে হয়। যার সচিত্র প্রতিবেদন প্রায়ই মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়। এটা একবিংশ শতকে কল্পনাতীত বিষয়, অন্তত: উন্নত দেশে। সর্বোপরি দেশে আন্তর্জাতিক মানের তেমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই। স¤প্রতি প্রকাশিত টাইমস হায়ার এডুকেশন রিপোর্ট-২০২০ মতে, ‘বিশ্বের এক হাজার শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে এ দেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ও নেই।’ অথচ এ অঞ্চলের অনেক দেশের কয়েকটি করে বিশ্ববিদ্যালয় উক্ত তালিকায় স্থান পেয়েছে। এর আগে অন্য এক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের রিপোর্ট মতে, ‘এশিয়া অঞ্চলে একশ শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে এ দেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ও নেই, হাজারের মধ্যে কয়েকটি আছে।’ দেশের শিক্ষা খাতে ব্যয় খুব কম। জিডিপির দুই শতাংশের মতো। অথচ বেশিরভাগ দেশে শিক্ষা খাতের ব্যয় আমাদের দেশের শিক্ষা খাতের ব্যয়ের তিনগুণ-চারগুণ বেশি। ইউনেস্কো শিক্ষা খাতে জিডিপি’র ৬% বরাদ্দের বেঞ্চমার্ক নির্ধারণ করেছে। এসব কারণে দেশের শিক্ষা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মান আন্তর্জাতিক মানের নয়। বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় খেলা-ধূলা ও বিনোদনের ব্যবস্থা নেই।

দেশের সেকেলে শিক্ষা ব্যবস্থা এবং তার মানহীনতার রেশ পড়েছে দেশের প্রতিটি কর্মেই এবং উৎপাদনশীলতায়। বিশ্ব ব্যাংকের তথ্য মতে, ব্যবসা সহজীকরণ সূচকে এ দেশের অবস্থান বিশ্বে তলানিতে। গত ২ অক্টোবর বিশ্ব উৎপাদনশীলতা দিবসে ঢাকায় আয়োজিত এক সভায় আলোচকরা বলেন, ‘উৎপাদনশীলতার দিক দিয়ে এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মধ্যে বাংলাদেশ খুব পিছিয়ে আছে।’ এই অবস্থায় পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় আরও নিচে। অবশ্য উক্ত সভায় শিল্প সচিব বলেছেন, ‘উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য সরকার ১০ বছর মেয়াদী ‘ন্যাশনাল প্রোডাক্টিভিটি মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করেছে। এটা বাস্তবায়নের পর্যায়ে আগামী চার বছরে দেশে উৎপাদনশীলতা দ্বিগুণ করা সম্ভব।’ যা’হোক, উৎপাদনশীলতা নিম্ন হওয়ার কারণে দেশের প্রতিটি কর্মেরই আউট পুট খুব কম। যেটুকু আছে, তারও মান খুব খারাপ। ফলে পণ্য ও সেবামূল্য অধিক। বিশ্বায়ন মোকাবেলায় একারণেই আমরা সফল হতে পারছি না। এদিকে একের পর এক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থায় টিকে থাকার জন্য কিছু প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে গার্মেন্ট মালিকরা বিদেশ থেকে দক্ষ লোক এনে কাজ করছে। এভাবে দেশে ১০ লাখের অধিক অবৈধ বিদেশি দক্ষ শ্রমিক কাজ করছে এবং তারা বছরে ৫ বিলিয়ন ডলার স্বীয় দেশে নিয়ে যাচ্ছে বলে মিডিয়ায় প্রকাশ। বর্তমান বিশ্বে আউট সোর্সিংয়ের বিরাট বাজার সৃষ্টি হয়েছে। তবুও ২০১৮ সালে আমাদের এ খাতে অর্জন মাত্র ১০ কোটি ডলার হয়েছে। অথচ এ খাতে ভারতের আয় বছরে একশ’ বিলিয়ন ডলারের বেশি। অভিবাসীর দিক দিয়ে আমরা বিশ্বে ৬ষ্ঠ। কিন্তু রেমিটেন্সের দিক দিয়ে ৯ম। কারণ, বিদেশে আমাদের শ্রমিকের বেতন খুব কম অন্য দেশের তুলনায়। আমাদের শ্রমিকের বেশিরভাগই অদক্ষ। স¤প্রতি অর্থমন্ত্রীও বলেছেন, দক্ষতার অভাবে আমরা বড় প্রকল্প সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারছি না। অর্থাৎ দেশের শিক্ষার মান অতি নিম্নমানের এবং তা টপ টু বটম। মানহীন শিক্ষা মূল্যহীন। তাই শিক্ষার মানোন্নয়নের দিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। সেটার উপযুক্ত স্তর হচ্ছে নিম্নস্তর। কারণ, উচ্চ স্তর শিক্ষার মান বৃদ্ধি করার জায়গা নয়। সেটা গবেষণা ও আবিষ্কার করার স্তর। তাই শিক্ষার মান বটম লেবেল ভালো না হলে হায়ার লেবেলে ভালো করা সম্ভব নয়। বৃক্ষের কান্ড যদি দুর্বল হয়, তাহলে সে বৃক্ষ সবল হয় না। তেমনি অবস্থা শিক্ষার ক্ষেত্রেও। তাই শিক্ষার মানোন্নয়ন ঘটাতে হবেই এবং তা নিম্নস্তরেই। এছাড়া, আধুনিক ও কারিগরি তথা কর্মমুখী শিক্ষা পদ্ধতি চালু করে সব শিক্ষাঙ্গনে বাস্তবায়ন বাধ্যতামূলক করতে হবে। প্রতিটি শিক্ষাঙ্গনে প্রয়োজনীয় আধুনিক অবকাঠামো ও শিক্ষকসহ জনবল এবং আনুষঙ্গিক বিষয়ের ব্যবস্থা করা আবশ্যক। শিক্ষকদের নিয়োগ প্রক্রিয়াও খুবই স্বচ্ছ হওয়া প্রয়োজন। শিক্ষাঙ্গনে দলীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করা দরকার। নকল, প্রশ্নপত্র ফাঁস, দুর্নীতি-অনিয়মও বন্ধ করা প্রয়োজন। উপরন্তু, শিক্ষকের বেতন ও মর্যাদা বৃদ্ধি করা দরকার। তাহলে মেধাবীরা শিক্ষকতায় উৎসাহী হবেন। তদ্রুপ কারিগরি শিক্ষার ক্ষেত্রে মেয়েদের ন্যায় ছেলেদেরও উপবৃত্তি প্রদান করা দরকার। তাহলে এই শিক্ষার হার অটোমেটিক বৃদ্ধি পাবে। অভিভাবকদেরও উচিৎ সন্তানদের কারিগরি শিক্ষায় উৎসাহিত করা। কারণ, চাকরির বাজার খুবই মন্দা দেশ-বিদেশের সর্বত্রই। ওদিকে ধীরে ধীরে মানুষের স্থান দখল করে নিচ্ছে রোবট ও অটোমেশন। তাই শিক্ষা অর্জনের পর নিজেকেই উদ্যোক্তা হতে হবে, যার উত্তম পথ হচ্ছে কারিগরি শিক্ষা।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন