Inqilab Logo

সোমবার ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

শিক্ষাঙ্গনে সহিংসতা নয় চাই সুষ্ঠু পরিবেশ

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ১২ অক্টোবর, ২০১৯, ১২:০২ এএম

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবরার ফাহাদের মা-বাবার বুক খালি। আবরার নেই। গত ৭ অক্টোবর বুয়েটের ছাত্র নামধারী কিছু যুবক আবরারকে নির্মমভাবে হত্যা করে। ইতোমধ্যে তাকে কবরস্থ করা হয়েছে। সে আর কোনদিন ফিরে আসবে না। আর বলবে না মা ভাত দাও, বাবা পড়তে যাচ্ছি ভার্সিটিতে। এ আবদার চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল। শোকে কাতর মা-বাবা আর কোনদিন আবরারকে দেখতে পাবেন না। দীর্ঘ ২১-২২টি বছর যাকে লালন পালন করে মানুষ হয়ে গড়ে উঠার জন্য, ভার্সিটিতে পাঠিয়েছিলেন। আশা ছিল, সে উপযুক্ত মানুষ হয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভের মাধ্যমে মা-বাবার মুখ উজ্জ্বল করবে। তা আর হলো না। আবরারকে নিষ্ঠুর নির্মম এবং নির্দয়ভাবে হত্যা করার পর স্বীয় ভার্সিটিসহ দেশের বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হরতাল, ধর্মঘট, বিক্ষোভ, মানববন্ধনসহ প্রতিরোধ গড়ে উঠছে। ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষয়িত্রী, পেশাজীবী সংগঠনসহ সমাজের সকল স্তরের লোকজন এ নির্মম হত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার। তাদের সকলের দাবি নির্মম এ হত্যাকান্ডে যারা জড়িত তাদের দৃষ্ঠান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক। আমরাও একমত। এটা করা না হলে দেশের বিশেষ করে শিক্ষাঙ্গনগুলোতে নৈরাজ্যের সৃষ্টি হবে তাতে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হবে এবং পরিস্থিতি সামাল দেয়া হবে একটা কঠিন কাজ। ইতোমধ্যে সরাসরিভাবে হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত ক’জন ছাত্র নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশ প্রদান করেছেন। 

প্রশ্ন হচ্ছে, দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে পড়–য়া ছাত্রদের এ আচরণ আমাদের দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভাবর্মযাদাকে দেশে শুধু নয় বিদেশেও মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত করেছে তা নিশ্চিত বলা যায়। মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ছাত্রদের বেপরোয়া মনোভাব এবং ছবি দেখে শুধু দেশের নয় অন্যান্য দেশের মানুষও আমাদের দেশের ছাত্রদের সম্বন্ধে কি ধারণা পোষণ করবে, এটা ভেবে দেখার বিষয়। এতে কি দেশের বাইরে আমাদের ভাবর্মযাদা নষ্ট হচ্ছে না? সচেতন নাগরিক বুদ্ধিজীবী এবং ক্ষমতাসীন সরকারের নেতা-নেত্রীদের এসব ভেবে দেখার বিষয়।
দেশের জনসাধারণ ছাত্র রাজনীতির এ নমুনা দেখে বলতে গেলে হতাশ। সাধারণ মানুষও এসব ঘটনায় উদ্বিগ্ন। তারা সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সহাবস্থানের মাধ্যমে শিক্ষার সুন্দর পরিবেশ প্রত্যাশা করে। তারা দেখতে চায়, তাদের সন্তানরা নিরাপদে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। দেশ পরিচালনার দায়িত্বে আছে সরকার। আইনশৃংখলা রক্ষার দায়িত্বে আছে বিভিন্ন বাহিনী। কাজেই সন্ত্রাসীদের রশি টেনে ধরার চেষ্টা করে দায়িত্ব এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই কারো। এসব কর্মকান্ডের দায় দায়িত্ব বর্তাবে বর্তমান সরকারের উপরই।
শিক্ষাঙ্গনে ছাত্ররাজনীতি নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতি বাঞ্চনীয় বা বর্জনীয়, এ নিয়ে বিতর্ক মোটেই নতুন নয়। তবে সা¤প্রতিককালে এ বিতর্ক এক ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। একদিকে ছাত্র রাজনীতির বিরুদ্ধাচারীরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করার পক্ষে সরব, অপরদিকে এর পক্ষাবলম্বীরা ছাত্র রাজনীতির পরিসর বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজের গন্ডি ছাড়িয়ে স্কুলস্তর অবধি সম্প্রসারণের পরিকল্পনায় সচেষ্ট।
বর্তমান ছাত্র ভবিষ্যতের রাষ্ট্রচালক। সুতরাং রাষ্ট্র চালনার নীতি অর্থাৎ রাজনীতি বিষয়ে সচেতনতা ও জ্ঞানের অনুশীলন ছাত্রাবস্থায় হওয়া আবশ্যক। তাই ছাত্র রাজনীতির অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য। রাজনৈতিক ঘটনাস্রোত ও ছাত্রসমাজ এই দুয়ের সংশ্লিষ্টতা অবশ্যই সাম্প্রতিককালের ব্যাপার নয়, ইতিহাস এর সাক্ষ্যবাহক। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এরূপ অনেক উদাহরণ লিপিবদ্ধ আছে। স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে সংঘটিত অনেক আন্দোলনে ছাত্র সমাজের জড়িত হবার ঘটনা সম্পর্কে আমরা অবহিত। ভাষা আন্দোলনে ছাত্রদের সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে দেখা গেছে। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে পুরোভাগে থেকে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন ছাত্রছাত্রীরা। এছাড়া আরো অনেক গঠনমূলক আন্দোলনে ছাত্রছাত্রীদের সক্রিয় ভূমিকা প্রশংসনীয় ছিল। কাজেই ছাত্র রাজনীতি বা ছাত্রছাত্রীদের রাজনৈতিক আন্দোলন-ঘটনাবলীতে জড়িত হওয়া নিন্দনীয় বা সমালোচনার বিষয় হিসেবে গণ্য হওয়া ঠিক নয় যদি তা সঠিক পথে হয়ে থাকে।
ছাত্র রাজনীতির সমর্থকদের বক্তব্য, রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রেখে রাজনীতির পাঠগ্রহণ ও সচেতনতা বৃদ্ধির কাজটি করতে হবে ছাত্রাবস্থাতে। রাজনীতিতে অনীহা ছাত্রদের ভবিষ্যৎ রাজনীতিক হবার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে। তাই ছাত্র রাজনীতির আবশ্যকতাকে মোটেই খাটো করে দেখা যাবে না। এ জন্য ছাত্র রাজনীতির পরিসর বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের গন্ডি ছাড়িয়ে স্কুলস্তর অবধি প্রসারিত হবার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন এর প্রবক্তারা। তবে স্কুল পর্যন্ত এটিকে নিয়ে আসা উচিত নয়। কারণ স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোতে ব্যাঘাত ঘটবে, তারা বয়সের দিক থেকে অনেক ছোট।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতির বাড়বাড়ন্ত লক্ষিত হলে তথাকথিত ছাত্র নেতারা ছাত্রকূলের প্রকৃত হিতার্থে ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পঠন পাঠনের মানোন্নয়ন ঘটিয়ে সুস্থ শৈক্ষিক পরিবেশ সৃষ্টিতে একেবারে বীতস্পৃহ। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতির কদর্যরূপ দীর্ঘদিন ধরে প্রতীত হচ্ছে। স্থানীয় বা জাতীয় স্তরের দলীয় রাজনীতির ক্ষুদ্র সংস্করণ হিসেবে ছাত্র রাজনীতি পরিচিতি লাভ করেছে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতির লাগাম এ দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মুঠোয়। কলেজগুলোতে ইউনিয়ন দখলের লড়াইয়ে ছাত্রছাত্রীর নিজস্ব মতামতের চেয়ে দলীয় কর্মী তথা পেশী ও অর্থবলধারীদের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ ও দাপট অধিক নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করে। এতে ছাত্রস্বার্থ চূড়ান্তরূপে উপেক্ষিত হয় এবং রাজনৈতিক দলগুলো কৌশলে তাদের দলীয় প্রভাব বৃদ্ধির কাজটি সেরে নিতে সক্ষম হয়। রাজনৈতিক দলের ক্যাডার বাহিনী তৈরির কারখানা হয়ে উঠে কলেজগুলো। রাজনৈতিক দলগুলো ছাত্র রাজনীতির সপক্ষে নানা আদর্শবাদ, ছাত্রসমাজে রাজনৈতিক সচেতনতার জাগৃতি তথা তাদের মধ্যে ভবিষ্যতের রাষ্ট্রনেতার গুণাবলীর অনুশীলন ইত্যাদির কথা বলেন, কিন্তু আসল উদ্দেশ্য যে ছাত্রদের মধ্যে নিজ নিজ দলের প্রভাববৃদ্ধি, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে অর্থের ছড়াছড়ি, মার-দাঙ্গা, অপহরণ, খুনখারাবি কিছুতে আপত্তি নেই তাদের। স্বভাবত ছাত্রনেতা হিসেবে তারা এমন প্রার্থীকে অগ্রাধিকার দেন-যারা উপরোক্ত কর্মকান্ডে সিদ্ধহস্ত বা সামান্য প্ররোচনাতে তা অবলীলাক্রমে করতে সক্ষম। যারা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার চেয়ে দাদাগিরিকে প্রাধান্য দেয়, তারা ছাত্র রাজনীতির যোগ্যতা অর্জনে বহু যুগ এগিয়ে থাকে। এ ধরনের ব্যাপার প্রায় সর্বত্র ঘটছে। এখন অবধি কূটদলীয় রাজনীতির কুৎসিত অবয়ব দর্শনে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন অভিভাবক-নাগরিক শঙ্কিত হয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতির অবসান চান। সুশীল কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের দলীয় রাজনীতির সংস্রবমুক্ত রাখা উচিত। তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের প্ররোচনায় বিপথগামী হতে পারে। যে ছাত্রজীবন ভবিষ্যতে শিষ্ট নাগরিক হবার গুণাবলী অধ্যয়ন ও আয়ত্বের সময়, সেটা কলুষিত হতে পারে যদি তারা এ অবস্থায় অর্থশক্তি-পেশীশক্তি নির্ভর রাজনীতির পাঠগ্রহণ করে। সর্বোপরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীর মধ্যে সৌভ্রাতৃবোধে চিড় ধরিয়ে শৈক্ষিক পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতিসাধিত হবে। অবশ্য এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, এরূপ পরিস্থিতি থেকে সব রাজনৈতিক দল যে সমানভাবে স্বার্থসিদ্ধিতে সমর্থ হবে তা নয়। মূলত ভ্রষ্টাচার আশ্রিত দল এতে সর্বাধিক লাভবান হবে।
বর্তমানে দেশের বিভিন্ন কলেজে এ ধরনের ছাত্র রাজনীতি কেন্দ্রিক ইউনিয়নের দখলদারি ও খবরদারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য পঠন-পাঠনের ব্যাপারটিকে প্রহসনে পরিণত করছে। কলেজে দলবাজি-ইউনিয়নবাজিতে শতকরা বড়জোর যদি ৫ ভাগ ছাত্র জড়িত থাকে, কিন্তু তাদের দাপট ও দৌরাত্ম্যে বাকি ৯৫ ভাগ ছাত্রের পড়াশোনায় মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এর ফলে অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষক-শিক্ষিকার দায়িত্ব পালনে দায়সারা ভাব পরিলক্ষিত হয়। সুশীল ছাত্র ও সচেতন অভিভাবক নোংরা রাজনীতির সংক্রমণ-ক্লিষ্ট শৈক্ষিক পরিবেশ নিয়ে চরম হতাশাগ্রস্থ হন। অর্থ ও বাহুবলে বলীয়ান রাজনৈতিক দলের মদতপুষ্টে ছাত্র রাজনীতিতে অনৈতিকতা, হিংসা, উন্মত্ততা, জবর আধিপত্য বিস্তারের মনোভাব প্রকট হওয়ায় ছাত্র হত্যা-শিক্ষক হত্যার মতো নিকৃষ্ট ঘটনা শিক্ষাঙ্গনের পবিত্রতাকে কালিমালিপ্ত করছে। এ সর্বনাশা ছাত্র রাজনীতি থেকে পরিত্রাণ ও উত্তরণের জন্য ছাত্র রাজনীতির অবসান চাইছেন অনেকে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতি বিভীষিকাময় রূপ ধারণ করেছে।
ছাত্র রাজনীতিকে কালিমালিপ্ত করার জন্য এককভাবে দায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কদর্য দলীয় রাজনীতির অনুপ্রবেশ। কাজেই যেটা বন্ধ হওয়া দরকার সেটা ছাত্র রাজনীতি নয়, ছাত্র রাজনীতিতে দলীয় রাজনীতির অনুপ্রবেশ। ছাত্র রাজনীতির প্রচলিত ধারণার সংশোধন আবশ্যক। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে সীমিত থাকা আবশ্যক। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতি থাকবে, ছাত্ররা নিজেদের মধ্যে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা করবে- এতে আপত্তির কিছু থাকতে পারে না। প্রতিযোগিতার মাধ্যমে অন্তর্নিহিত ব্যক্তিত্ব তথা নেতৃত্ব শক্তির বিকাশ ঘটবে যা পরবর্তীতে সমাজ ও রাষ্ট্রচালনায় সহায়ক হবে। এটিকে সার্বিক শিক্ষার এক অঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। রাজনীতি শব্দকে সংকীর্ণ অর্থে ব্যাখ্যা না করে তার প্রকৃত অর্থ অনুধাবন করতে হবে। রাজনীতি নিছক কোনো রাজনৈতিক দলের নীতি নয়, রাজনীতি হল রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি। কাজেই ছাত্র রাজনীতি দল-নিরপেক্ষ রাজনীতি হওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে সমগ্র ছাত্রসমাজই একটি দল। এ ছাত্রসমাজকে নেতৃত্ব দেয়া ছাত্র নেতার কাজ আর ছাত্রসমাজকে পরিচালনা করার নীতি ছাত্র রাজনীতি। রাষ্ট্র রাজনীতির হাতেখড়ি হবে এ ছাত্র রাজনীতি।
কোনো রাজনৈতিক দলের স্তাবকতা বা তল্পিবহন করা ছাত্রসমাজের পক্ষে অমর্যাদাকর ও হানিকর। এটি ছাত্রনেতাদের অন্তর্নিহিত নেতৃত্ব গুণের বিকাশকে স্তিমিত ও বিকৃত করে তাদেরকে রাজনৈতিক নেতাদের ক্রীড়নকে পরিণত করে। রাজনৈতিক নেতারা তাদের ন্যস্ত স্বার্থ চরিতার্থ করতে ছাত্রদেরকে হাতিয়ারস্বরূপ ব্যবহার করেন। কাজেই ছাত্রাবস্থায় সক্রিয় দলীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হবার মোটেই ঔচিত্য বা আবশ্যকতা নেই। ছাত্রাবস্থা নেতৃত্ব গুণ অনুশীলন ও অর্জনের সময় দলগত রাজনৈতিক ক্রীয়াশীলতার সময় নয়। শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে জ্ঞানবৃদ্ধি ও ব্যক্তিদের বিকাশ ঘটিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নীতি-আদর্শের তুলনামূলক বিচার সাপেক্ষে পছন্দের দলে নিজের অন্তর্ভুক্তি কাম্য। এ ধরনের ছাত্র নেতা রাজনৈতিক দলকে সমৃদ্ধ করেন। অপরদিকে, ছাত্রাবস্থায় যারা রাজনৈতিক দলের ক্রীড়নকে পরিণত হয়, তারা ভবিষ্যত জীবনে কখনো সৎ ও দৃঢ় চরিত্রের অধিকারী হতে পারে না। দুর্নীতি দিয়ে যার হাতেখড়ি, সে ভবিষ্যতে চরম দুর্নীতিগ্রস্ত ও দুরাচারী হবে, এটি স্বাভাবিক। এটি যে বর্তমানে আমাদের দেশে রাজনৈতিক অবক্ষয় ও দেউলিয়াপনার এক প্রধান কারণ, তা-ও বলাবাহুল্য।
বর্তমানে এ দেশের গরিষ্ঠ সংখ্যক রাজনৈতিক দল বা নেতার চরিত্রে অনুকরণযোগ্য আদর্শের দৈন্যদশা চরমে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের চারিত্রিক চরম অবক্ষয় ও ক্রমবর্ধমান শৃঙ্খলাহীনতার প্রতিচ্ছবির বহিঃপ্রকাশ সংসদ থেকে শুরু করে সর্বত্র অতি নগ্নরূপে দৃষ্ট হচ্ছে। এরূপ দলনেতার সংস্রবমুক্ত থাকা ছাত্র সমাজের জন্য কল্যাণকর।
ছাত্রস্বার্থ তথা বৃহত্তর শিক্ষার স্বার্থে ছাত্র রাজনীতিকে দলীয় রাজনীতির কবলমুক্ত করার প্রয়াস ও তৎপরতা সা¤প্রতিককালে এক নতুন মাত্রা পেয়েছে। ছাত্র রাজনীতির শুদ্ধীকরণে অগ্রণী ভূমিকা পালনে ভারতের কেরালা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ্য। এ বিশ্ববিদ্যালয় কয়েক বছর পূর্বে এ মর্মে কিছু সদর্থক পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ইউনিয়নের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা ‘ক্লাস টপার’ বা ‘ফার্স্টবয়’ হবেন; শিক্ষা-সঙ্গীত-খেলাধুলা ও মেধা বিকাশের অন্যান্য বিষয়ে উৎকর্ষ সাধনের প্রয়াস হবে ইউনিয়নের কাজকর্মের বিষয়; দলীয় রাজনীতির হানিকর সংক্রমণ থেকে ইউনিয়নের কাজকর্মকে সম্পূর্ণ মুক্ত রাখতে হবে ইত্যাদি। অবশ্য এরূপ নির্দেশিকাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনধিকার চর্চা ও অন্যায় ‘ফতোয়া’ আখ্যা দিয়ে বিষয়টি মামলা আকারে সুপ্রিমকোর্টে নীত হয়। মহামান্য সুপ্রিমকোর্ট বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করেন এবং এ সম্পর্কিত যাবতীয় বিষয় খতিয়ে দেখে পরামর্শ প্রদানের জন্য একটি কমিটি গঠনের আবশ্যকতা অনুভব করেন। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউনিয়ন নির্বাচনে অর্থ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পেশীশক্তির দৌরাত্ম্য নিয়ন্ত্রণ করতে কমিটি গাইডলাইন তৈরি করবে যেখানে বিবেচ্য বিষয়ের মধ্যে থাকবে: নির্বাচনে প্রার্থী হতে গেলে আবশ্যকীয় যোগ্যতা: কী কী কারণে একজন ছাত্র নির্বাচনে প্রচারকার্যে খরচের সর্বোচ্চ পরিমাণ ও তার উৎস; রাজনৈতিক দলের প্রত্যক্ষ মদতপুষ্ট ছাত্রছাত্রীকে নির্বাচনে অংশগ্রহণে অযোগ্য ঘোষণা করা ইত্যাদি। এ বিষয় সুপ্রিমকোর্ট বলেছে ‘We have to fix some eligibility criteria for student candidates. It is found that some student leaders go on staying in the same institution not for studies but for some other political reasons.’
উল্লেখ্য, সুপ্রিমকোর্টের নির্দেশানুসারে ভারতের মানবসম্পদ বিকাশ মন্ত্রণালয় অবসৃত মুখ্য নির্বাচন কমিশনার জেএম লিংডো-র নেতৃত্বে এক কমিটি গঠন করে। ছাত্র ইউনিয়ন নির্বাচনের যাবতীয় দিক পর্যালোচনা করে লিংডো কমিটি যে রিপোর্ট জমা করে তার সুপারিশগুলো সুপ্রিমকোর্টের স্বীকৃতি লাভ করে। সুপ্রিমকোর্ট ২২ সেপ্টেম্বর ২০০৬ ইংরেজির এক আদেশে এ সুপারিশগুলোর সত্বর বাস্তবায়নের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারকে নির্দেশ দেন। লিংডো কমিটির সুপারিশগুলোর মধ্যে প্রধান কিছু এখানে উল্লেখ করা হলো:
১) ছাত্র ইউনিয়নের নির্বাচন এবং ইউনিয়নে প্রতিনিধিত্ব সম্পূর্ণরূপে রাজনৈতিক দল-নিরপেক্ষ হতে হবে। ২) কলেজস্তরে ১৭ থেকে ২২ বছর বয়সসীমার মধ্যকার ছাত্রছাত্রী নির্বাচনে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করতে পারবেন। ৩) নির্বাচনে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করার বছরে প্রার্থীর কোনো ‘অ্যাকাডেমিক এরিয়ার’ থাকতে পারবে না অর্থাৎ পূর্ববর্তী পাঠক্রম সফলভাবে সম্পূর্ণ করে আসা ছাত্রছাত্রীরা নির্বাচনে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করার জন্য যোগ্য বিবেচিত হবেন। ৪) প্রতিদ্ব›িদ্বতায় ইচ্ছুক ছাত্রের ক্লাসে উপস্থিতির হার বিশ্ববিদ্যালয় নির্ধারিত হার অথবা পঁচাত্তর শতাংশের মধ্যে যেটা অধিক সেটা হতে হবে। ৫) অতীতে যে কোনো ধরনের অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত ছাত্রছাত্রী নির্বাচনে প্রতিদ্ব›িদ্বতার ক্ষেত্রে অযোগ্য বিবেচিত হবেন। ৬) শুধুমাত্র কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত ও পূর্ণকালীন ছাত্রছাত্রী ইউনিয়ন নির্বাচনে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করতে পারবেন। ৭) ইউনিয়ন নির্বাচনে প্রতিদ্ব›িদ্বতাকারী প্রার্থীর নির্বাচনী ব্যয়ের পরিমাণ নির্ধারিত সীমার মধ্যে থাকতে হবে। ৮) নির্বাচনী প্রচারে কোনো ধরনের ছাপা পোস্টার, ব্যানার ইত্যাদির ব্যবহার তথা জনসভা নিষিদ্ধ। শুধুমাত্র হাতে লেখা পোস্টারের সীমিত ব্যবহার এবং নিয়ন্ত্রিত প্লাটফর্ম লেকচার অনুমোদনযোগ্য। ৯) পুরো নির্বাচনী প্রক্রিয়া দশ দিনের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে।
ছাত্র রাজনীতি নিয়ে চিন্তা ভাবনা করার সময় এসেছে আমাদেরও। আমাদের প্রিয় ছাত্রছাত্রীরা দেশের ভবিষ্যৎ কর্ণধার। তাদেরকে একটি সুন্দর নিয়ম শৃঙ্খলার ভিতর দিয়ে পরিচালিত করতে হবে। গঠনমূলক কাজে তাদেরকে উৎসাহ উদ্দীপনা দিতে হবে। তাদের মেধার বিকাশ ঘটাতে হবে। সব সময়ই সুপরামর্শ দিয়ে তাদের লালন করতে হবে। দলীয় রাজনীতির মোহ থেকে ছাত্র-ছাত্রীদের কল্যাণার্থে নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়ার কাজে মনোনিবেশে সহায়ক ভূমিকা রাখতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট



 

Show all comments
  • shaik ১২ অক্টোবর, ২০১৯, ৫:৪১ এএম says : 0
    Toder OVISHAP decche, toraa o jatay ai Vaby MORISH. ai PIGs Gula Dhongsho hok
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন