পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
গত সপ্তাহে বৃষ্টিতে ঢাকা শহরের কী অবস্থা হয়েছে তা সকলেরই জানা। মতিঝিল, ফকিরাপুল, শান্তিনগর, ধানমন্ডিসহ রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলো হাঁটু ও কোমর সমান পানিতে তলিয়ে যায়। এমনকি প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়ও পানি ঢুকে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। মনে হয় রাজধানী যেন পানিতে ভাসছে। কারুকাজ সমৃদ্ধ ভবনগুলো যেন পানির তলদেশ থেকে গড়ে তোলা হয়েছে। যানবাহনগুলো ডুবে ডুবে চলছে। অনেক যানবাহন অচল হয়ে পানির মধ্যেই ভাসতে থাকে। সব দেখে মনে হচ্ছে, রাজধানীতে এখন উভচর যানবাহন নামানো ছাড়া কোনো উপায় নেই। গত সপ্তাহে কয়েক ঘন্টার বৃষ্টিতে এমন দৃশ্য দেখা গেছে। বৃষ্টি এক-দুই ঘন্টা হলেও বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে থাকা সড়ক থেকে পানি নামতে লেগে যায় পাঁচ-ছয় ঘন্টা। এ এক ভয়াবহ দৃশ্য। এ চিত্র দেখে বোঝার উপায় নেই এটি কোনো রাজধানীর দৃশ্য। মনে হবে, বর্ষার পানিতে নিমজ্জিত গ্রামীণ কোন জনপদ। বিশ্বের আর কোন দেশের রাজধানীর রাস্তা-ঘাট বৃষ্টির পানিতে ঘন্টার পর ঘন্টা এভাবে তলিয়ে থাকে কিনা আমাদের জানা নেই। বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্নের শহর ঢাকার এ দুর্দশা যুগের পর যুগ ধরে চলছে। এ থেকে পরিত্রাণের কোন আশা তারা দেখছেন না। এভাবেই তাদের বসবাস করতে হবে এবং চলতে হবে, এ যেন তাদের নিয়তি।
দুই.
দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম মেগা সিটি ঢাকা। বিশ্বের ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলোর মধ্যে একটি। প্রায় চারশ’ বর্গকিলোমিটারের এই শহরের লোকসংখ্যা প্রায় দেড় কোটি। প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় পঁচিশ হাজার মানুষের বসবাস। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রতিদিন গড়ে আড়াই হাজার মানুষ এ শহরে প্রবেশ করছে। ঢাকামুখী মানুষের স্রোত প্রতিদিনই বাড়ছে। ঠেকানোরও উপায় নেই। সবারই ধারণা, একবার ঢাকায় যেতে পারলে জীবন বদলে যাবে। তাদের এই মনোভাব রাজধানীর সমস্যা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। সারা দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির গড় হার যেখানে দেড় শতাংশ, সেখানে ঢাকায় সাড়ে পাঁচ শতাংশ এবং তা ক্রমেই বাড়ছে। বলা হচ্ছে, আগামী দুয়েক-বছরের মধ্যে ঢাকা হবে বিশ্বের তৃতীয় জনবহুল শহর। নাইজেরিয়ার লাগোসের পর জনসংখ্যা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ঢাকা দ্বিতীয়। যতই দিন যাবে, জনসংখ্যার বৃদ্ধির সাথে সাথে ঢাকার পরিস্থিতি যেমন করুণ হবে, তেমনি সুযোগ-সুবিধাও অপ্রতুল হয়ে উঠবে। এমনিতেই মেগা সিটির যে বৈশিষ্ট্য এবং সুযোগ-সুবিধা থাকে, তার অনেক কিছুই ঢাকায় নেই। এর আমেজ কেমন হয়, এ অভিজ্ঞতা নগরবাসীর কোনদিনই হয়নি। অদূর ভবিষ্যতে হবে কিনা সন্দেহ। নগরবিদরা মনে করছেন, মেগা সিটি যেভাবে পরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠে, ঢাকা সেভাবে গড়ে উঠেনি এবং উঠছেও না। বলা বাহুল্য, একটি দেশের রাজধানী তার সভ্যতার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। চেহারায় যেমন মানুষের মনের ভাব প্রতিফলিত হয়, তেমনি রাজধানীর চিত্রের মাধ্যমে দেশের সার্বিক পরিস্থিতির চিত্র পাওয়া যায়। প্রখ্যাত আইরিশ ঔপন্যাসিক ও কবি জেমস জয়েস তার প্রিয় শহর ডাবলিনকে নিয়ে বলেছেন, ‘আমি যদি ডাবলিনের হৃদয় স্পর্শ করতে না পারি, তবে বিশ্বের আর কোন শহরের হৃদয় স্পর্শ করতে পারব না।’ প্রবাস জীবনে থেকেও ডাবলিনের প্রতি তার এই আকুতি ঝরে পড়েছিল। প্রিয় শহর ঢাকা নিয়ে এর সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তা ব্যক্তিদের মধ্যে এমন তাড়না যে নেই, তা ঢাকার দুর্দশা দেখেই বোঝা যায়। নগরবিদরা ঢাকাকে এখন সভ্য নগর হিসেবে মনে করেন না। ময়লা আবর্জনা ও ইট-পাথরের ডাম্পিং শহর হিসেবে বিবেচনা করেন। শুধু নগরবিদরা নন, বিশ্বের খ্যাতিমান জরিপ সংস্থা যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের জরিপে ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে বসবাস অনুপযোগী ও অযোগ্য শহর হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। সংস্থাটির জরিপে বেশ কয়েকবার বিশ্বের বসবাস অনুপযোগী ও অসভ্য নগরীর তালিকায় ঠাঁই পায়। ইকোনমিস্টের জরিপের সূচক তৈরি করা হয় ৩০টি মানদন্ডের ভিত্তিতে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য, রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা, অপরাধ সংঘটনের হার, স্বাস্থ্যসুবিধা, সংস্কৃতি ও পরিবেশ, শিক্ষা, পরিবহন ব্যবস্থা এবং অবকাঠামো। ১০০ নম্বরের মধ্যে ঢাকা পেয়েছিল ৩৮, অর্থাৎ ফেল। ঢাকা চিহ্নিত হয় অসভ্য বা বসবাস অনুপযোগী নগরী হিসেবে। এই অসভ্য নগরীতেই আবার জমির দাম ও বাড়িভাড়া পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি। এখানে এক শতাংশ জায়গার দাম গড়ে ২ কোটি টাকা এবং প্রতি বর্গফুট আবাসিক বাসাভাড়া ২০ থেকে ২৫ টাকা। যানজটে প্রতি বছর ক্ষতি হয় প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ২ শতাংশ। এ নিয়ে সরকার ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর কোন মাথাব্যথা আছে বলে প্রতিয়মান হচ্ছে না। সংকট উত্তরণে কার্যকর ও পরিকল্পিত পদক্ষেপ নেয়ার আশানুরূপ তৎপরতা দেখা যায় না। এমনকি বিদ্যমান সুবিধাটুকুও সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ধরে রাখতে পারছে না। ফলে অসভ্য নগরী হিসেবে চিহ্নিত ঢাকা আরও অসভ্যতার পথেই হাঁটছে।
তিন.
রাজধানীর সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর আচরণ এমন যে, বছরের পর বছর নগরবাসীকে সীমাহীন দুর্ভোগে রাখতে পারলেই যেন তাদের শান্তি। নগরবাসীকে তারা নাগরিক হিসেবেই মনে করে না। অথচ নগরবাসী ট্যাক্স দিচ্ছে এবং এই ট্যাক্সের পয়সাই সংস্থাগুলো পরিচালিত হচ্ছে। বিনিময়ে তারা ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে না। তাদের জীবন অতিষ্ঠ করার যতরকম সমস্যা আছে, তার সবকিছুই জিইয়ে রেখেছে। এর চেয়ে দুর্ভাগ্য ও পরিতাপের বিষয় আর কিছু হতে পারে না। বিগত ৪০ বছরেও পানিবদ্ধতা নিরসনে ওয়াসা একটি আধুনিক ড্রেনেজ সিস্টেম গড়ে তুলতে পারেনি। পঞ্চাশ-ষাটের দশকের ঢাকা উপযোগী যে ড্রেনেজ ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল, তার উপর নির্ভর করেই কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ঢাকা ওয়াসার বিপনন ও ব্যবস্থাপনা শাখার একজন নির্বাহী প্রকৌশলী বলেছেন, ঘন্টায় ২০ মিলিমিটার বৃষ্টি হবে বিবেচনায় নিয়ে ঢাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থা করা হয়। এর চেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হলেই পানিবদ্ধতা সৃষ্টি হবে। কিছু এলাকায় সিটি কর্পোরেশনের ১২০০ মিলিমিটার ব্যাসের পাইপ লাইন রয়েছে। ওয়াসার পাইপ লাইন ৯০০ মিলিমিটারের। ফলে সিটি কর্পোরেশনের পাইপ থেকে প্রবাহিত পানি ওয়াসার পাইপ লাইন ধারণ করতে পারে না। এতে অনেক জায়গায় পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। তার এই বক্তব্য থেকেই বোঝা যায়, ঢাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থা কতটা নাজুক অবস্থায় রয়েছে। অর্থাৎ বছরের পর বছর চলে গেলেও ওয়াসা এ পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটাতে পারছে না। পরিকল্পিত ড্রেনেজ সিস্টেম গড়ে তুলতে পারছে না। আবহাওয়া পরিবর্তনের সাথে বৃষ্টির হার যে প্রতি বছর বাড়ছে বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে না। গত সপ্তাহে ৬২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। আবহাওয়াবিদরা পূর্বাভাস দিয়েছেন ভবিষ্যতে বৃষ্টির হার আরও বাড়বে। তখন পানিবদ্ধতায় ঢাকা শহর অচল হয়ে পড়বে। এখনই সামান্য বৃষ্টিতে নগরীর অধিকাংশ রাস্তা পানির নিচে তলিয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টির পানি ও ড্রেনের পানি একাকার হয়ে অসহনীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। এর মধ্যেই সংস্কারের নামে চলছে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি। প্রতিনিয়ত চরম দুর্ভোগে পড়েছে নগরবাসী। পানিবদ্ধতার কারণে গর্তে পড়ে অনেক মানুষ যেমন আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করছেন, তেমনি তলিয়ে থাকা বিদ্যুতের ছেঁড়া তারে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। এর দায় কেউ নিচ্ছে না। বৃষ্টির মৌসুমে নির্বিচারে রাজধানীর অলিগলি থেকে শুরু করে মূল সড়ক খোঁড়াখুঁড়ির মহোৎসব কেন শুরু হয় এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো কেন এ সময়ে অনুমতি দেয়, এ নিয়ে নগরবাসীর প্রশ্ন ও ক্ষোভ দীর্ঘ দিনের। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো যে নগরবাসীর এ ক্ষোভের কোন তোয়াক্কা বা ভ্রুক্ষেপ করে না, বর্ষা মৌসুমে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির সংস্কৃতি বন্ধ না হওয়া থেকেই বোঝা যায়। নগরবাসীর এই ভোগান্তি কবে শেষ হবে, এ নিয়ে সিটি কর্পোরেশন ও ওয়াসা, এমনকি সরকারের পক্ষ থেকেও কখনো কোন নিশ্চয়তা পাওয়া যায়নি। কেউই নগরবাসীর চিরন্তন এই সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিচ্ছে না। সিটি কর্পোরেশন দুই ভাগ করেও কোন সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ একটু তৎপর ও সচেতন হলেই পানিবদ্ধতার সমস্যা নিরসন সম্ভব। সিডিউল পরিবর্তন করে শুষ্ক মৌসুমে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিলে অনেকাংশে ভোগান্তির অবসান হয়। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এই সিদ্ধান্ত নেয়ায় জনসাধারণের ভোগান্তি অনেকটাই লাঘব হয়েছিল। কঠোর সিদ্ধান্তের মাধ্যমে তখন বর্ষা মৌসুমে সব ধরনের রাস্তা খোঁড়ার কাজ বন্ধ করা হয়। ফলে নগরবাসীকে খুব বেশি ভোগান্তিতে পড়তে হয়নি। অর্থাৎ সদিচ্ছা থাকলে কোন কিছুই অসম্ভব নয়। গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে এ ধারা অব্যাহত থাকেনি। বর্ষা মৌসুমের কিছু দিন আগে থেকেই রাস্তা খোঁড়া সংস্কৃতি ফিরে আসে। জনসাধারণের ভোগান্তিও শুরু হয়। বিষয়টি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যেন জনসাধারণকে ভোগান্তিতে ফেলে আনন্দ পান। তাদের আনন্দিত হওয়ার অন্তর্নিহিত কারণ যে আছে, তাতে সন্দেহ নেই। বর্ষায় রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি হলে বৃষ্টির অজুহাতে কাজ বিলম্বিত হয়, কাজ বিলম্বিত হলে পুনরায় অর্থ বরাদ্ধ হবে এবং তা থেকে ঠিকাদারের যেমন লাভ, তেমনি সংশ্লিষ্ট অসৎ কর্মকর্তাদেরও কমিশন প্রাপ্তির লাভ রয়েছে। অর্থাৎ দুর্নীতির ক্ষেত্র প্রস্তুতের জন্যই বর্ষায় রাস্তা খোঁড়ার সংস্কৃতি শুরু হয়। ক্ষুদ্র ব্যক্তি স্বার্থে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সমস্যা সৃষ্টি এবং বিশ্বে রাজধানীর বদনাম হওয়ার মতো এমন কর্মকান্ড হয় কিনা আমাদের জানা নেই। এ সংস্কৃতি বন্ধ না হলে কোন দিনই নগরবাসীর ভোগান্তির অবসান হবে না। বৃষ্টিতে রাজধানীর আশপাশের শহরতলী এলাকাগুলোর অবস্থা শোচনীয় হওয়া নতুন কিছু নয়। বিশেষ করে ডিএনডি বাঁধের ভেতরের এলাকাগুলো সামান্য বৃষ্টিতে তলিয়ে যাওয়া এবং সেখানে বসবাসকারী মানুষের অবর্ণনীয় দুর্ভোগের কথা প্রতি বছরই উঠে আসে। বর্ষা ও বৃষ্টি এ এলাকার মানুষের কাছে অভিশাপ হয়ে আসে। এ বছরও এর ব্যতিক্রম হয়নি। একদিনের বৃষ্টিতেই এলাকার কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়ে। তাদের দুর্দশার অন্ত থাকে না। ষাটের দশকে নারায়ণগঞ্জের দুইটি ইউনিয়নসহ ঢাকা ও শহরতলীর ৮ হাজার ৩৪০ হেক্টর জমিতে সেচের জন্য ডিএনডি বাঁধ প্রকল্প নেয়া হয়েছিল। সেখানে ১০০ কিলোমিটার খালও খনন করা হয়। কালক্রমে অবৈধ দখলের কারণে প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম প্রায় সব খাল ভরাট হয়ে গেছে। এতে জমে থাকা পানি দ্রুত নিষ্কাশন হতে পারে না। ৫৭ কিলোমিটার দীর্ঘ ডিএনডি বাঁধের ভেতরের পানি সরাতে প্রতি সেকেন্ডে ১২৮ কিউসেক পানি নিষ্কাশন ক্ষমতার ৪টি এবং ৫ কিউসেক ক্ষমতার ২৫টিসহ রয়েছে ৩০টি পাম্প। এসব পাম্প দিয়ে পুরোপুরি পানি নিষ্কাশন সম্ভব নয়। ফলে বাঁধের ভেতর বসবাসকারীদের বৃষ্টি ও বর্ষায় পানিবদ্ধ অবস্থায় থাকতে হয়। শহরতলী মূল শহরের বাইরে হলেও দ্রুত ও অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে এগুলো শহরের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েছে। এসব এলাকার সমস্যা ও ড্রেনেজ সিস্টেম মূল নগরীর সাথে যুক্ত হওয়ায় এর প্রভাব রাজধানীতে পড়ছে। রাজধানীর ড্রেনেজ সিস্টেম সঠিকভাবে গড়ে না ওঠায়, শহরতলীর ড্রেনেজ সিস্টেমের সাথে যুক্ত হয়ে পানিবদ্ধতাকে আরও জটিল করে তুলছে। এ কথা অনস্বীকার্য, আশপাশের এলাকা ড্রেনেজ সিস্টেমের উন্নয়ন ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি না করলে মূল শহরের সুযোগ-সুবিধারও ব্যঘাত ঘটে। রাজধানী ঘিরে যেসব নদী রয়েছে, রাজধানীকে সজীব ও পানিবদ্ধতামুক্ত রাখতে এগুলোর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অবৈধ দখলের কারণে রাজধানীর ধমনী হিসেবে পরিচিত নদীগুলোর স্বাভাবিক গতিধারা হারানোর পাশাপাশি এগুলোর অস্তিত্ব বিলীন হতে চলেছে। ফলে শহর থেকে প্রতিদিন যে বর্জ্য ও দূষিত পানি নিঃসরিত হয়, তা নদীতে গিয়ে পড়ছে এবং সেখানেই স্থির থেকে যাচ্ছে। স্বাভাবিক গতি না থাকায় নদীগুলো বাগাড়ে পরিণত হয়েছে। বুড়িগঙ্গা এখন ঢাকার অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর পানি এতটাই কালো ও বিষাক্ত যে, এতে কোন প্রাণের অস্তিত্ব নেই। অথচ আগে বিদেশি কোন রাষ্ট্রীয় অতিথি এলে এই বুড়িগঙ্গায়ই নৌ-বিহারে নিয়ে যাওয়া হতো। এটি ছিল আমাদের দেশীয় ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্য বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এখন ভুলেও কোন রাষ্ট্রীয় অতিথিকে নৌ-বিহারে নিয়ে যাওয়া হয় না। রাজধানীর এ অবস্থার জন্য বিশ্লেষকরা মূলত রাজনীতিকদের দায়ী করেন। তারা মন্তব্য করেন, ‘রাজনীতিকদের কারণেই অপরিকল্পিতভাবে ঢাকা মহানগরী গড়ে উঠেছে। রাজনীতির কারণেই ঢাকা কেন্দ্রীভূত বা অতি কেন্দ্রীভূত হয়েছে। এখন পর্যন্ত দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতি ঢাকামুখী। আগামীতে কি পরিণতি হবে তা দেখতে অপেক্ষা করতে হবে। তারা বলেন, ঢাকার স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা সবচেয়ে খারাপ বলেই এই দুরবস্থা।
চার.
ঢাকা শহর সভ্য না হওয়ার অন্যতম কারণ সুষম পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়নের অভাব। যেভাবে অপরিকল্পিত নগরায়ণ হচ্ছে, এ ধারা অব্যাহত থাকলে ঢাকা কখনোই বাসযোগ্য শহরে পরিণত হতে পারবে না। নগরবিদরা মনে করছেন, ঢাকা শহরের জন্য আর্থিক সামর্থ্য বড় ব্যাপার নয়, সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও কার্যকর করাই প্রধান সমস্যা। ঢাকাকে বাসযোগ্য করে তুলতে হলে, প্রত্যেকটি সমস্যা আলাদাভাবে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে সমাধানে উদ্যোগ নেয়া জরুরী। যানজটের কারণে যে হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়, তা নিরসন করতে পারলে এই অর্থ দিয়েই অন্যান্য সমস্যা সমাধান সম্ভব। বৃষ্টি মৌসুমে পানিবদ্ধতা যেহেতু নগরবাসীর জন্য চরম সমস্যা হয়ে দেখা দেয়, এই সমস্যা নিরসনে পরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা অপরিহার্য। বিদ্যমান ড্রেনগুলো নিয়মিত পরিষ্কার রাখা এবং সংস্কার কাজ বর্ষায় না করে শুষ্ক মৌসুমে করা বাঞ্চনীয়। রাজধানীতে এক সময় অসংখ্য প্রাকৃতিক খাল ছিল। খালগুলো বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন এবং শহরকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। অবৈধ দখলের কারণে এসব খাল এখন আর নেই। দখলমুক্ত করে কিছু খাল উদ্ধার ও সংস্কার করতে পারলে পানিবদ্ধতা অনেকটাই কমে যেত। পাম্প বসিয়ে পানি নিষ্কাশন কোন স্থায়ী সমাধান নয়। পানিবদ্ধতা নিরসন করতে হলে ড্রেনেজ সিস্টেম উন্নত করতে হবে। সিটি কর্পোরেশন ও ওয়াসার সমন্বয়ে ড্রেনের পাইপ বসিয়ে স্থায়ীভাবে সমস্যা সমাধান করতে হবে। তা না হলে প্রতি বছরই বার বার রাস্তা খুঁড়তে হবে, অর্থের অপচয় হবে এবং জনভোগান্তিরও সৃষ্টি হবে। ঢাকাকে বাসযোগ্য ও পরিকল্পিতভাবে গড়ে তুলতে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়ের মাধ্যমে নির্দিষ্ট মেয়াদের মহাপরিকল্পনা নেয়া এবং দ্রুত বাস্তবায়ন করা জরুরী।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।