পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বাংলাদেশের জাতীয় আয়ের এক বড় অংশই আসে বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের পাঠানো রেমিটেন্স থেকে। আর দেশের আভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও রফতানি আয়ের প্রধান সেক্টর হচ্ছে তৈরী পোশাক রফতানি খাত। গত এক দশকে তৈরী পোশাক রফতানি খাতে একটি শুভঙ্করের ফাঁক তৈরী হয়েছে। সেটি হচ্ছে, এ খাতে ঢুকে পড়া লাখ লাখ বিদেশি শ্রমিক। বিভিন্ন সেক্টরের জন্য দেশে প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবলের ঘাটতি থাকলেও তা এতটা প্রকট নয় যে, লাখ লাখ অবৈধ বিদেশি শ্রমিক দিয়ে তা পুরণ করতে হবে। সবচেয়ে উদ্বেগের ব্যাপার হচ্ছে, দেশে ঠিক কত সংখ্যক বিদেশি শ্রমিক অবৈধভাবে কাজ করছে তার সঠিক পরিসংখ্যান সরকারী কোনো সংস্থার হাতেই নেই। যে কোনো দেশের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য এটি একটি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা হিসেবে বিবেচিত হবে। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ(বিডা)র রেজিস্ট্রেশন অনুসারে দেশে বিদেশি শ্রমিকের সংখ্যা ১ লক্ষাধিক। যে কোনো দেশের নাগরিককে দেশের সরকারী-বেসরকারী যে কোনো প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে হলে বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের পূবানুমতি গ্রহণ বা ওয়ার্ক পারমিট নেয়া একটি বাধ্যতামূলক আইনগত শর্ত হলেও এই আইনের তোয়াক্কা করছেন না বাংলাদেশে কর্মরত বেশিরভাগ বিদেশি কর্মী এবং নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠান। শুধুমাত্র তৈরী পোশাক খাতেই কমপক্ষে ৫ লাখ বিদেশি শ্রমিক কর্মরত রয়েছে বলে জানা যায়। এদের সিংহভাগই ভারতীয় নাগরিক। এছাড়া চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, শ্রীলঙ্কা, দক্ষিন কোরিয়া, ফিলিপাইনসহ আরো বেশকিছু দেশের নাগরিক বাংলাদেশের বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করছে। এরা বছরে বাংলাদেশ থেকে অন্তত ৫বিলিয়ন ডলার নিজ নিজ দেশে পাঠাচ্ছে বলে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে জানা যায়। এ ক্ষেত্রে সরকারী-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার জরিপে বেশ গরমিল পরিলক্ষিত হয়। দেশে অবস্থানরত ও কর্মরত অবৈধ বিদেশি নাগরিকের সংখ্যা ১০ লাখেরও বেশি হতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এভাবে বিদেশে চলে যাওয়া রেমিটেন্সের পরিমান ১ হাজার কোটি ডলারের বেশি হতে পারে বলে অনুমিত হচ্ছে।
গত এক দশকে বাংলাদেশের বৈদেশিক কর্মসংস্থান খাতে তেমন কোনো অগ্রগতি অর্জিত হয়নি। সউদি আরব ও মালয়েশিয়ার মত বড় শ্রমবাজারের দরোজা বছরের পর বছর ধরে বন্ধ রয়েছে। সে সব দেশেও অবৈধ শ্রমিকদের বিরুদ্ধে মাঝে মধ্যেই অভিযান পরিচালিত হচ্ছে এবং প্রতিমাসে হাজার হাজার বাংলাদেশি শ্রমিক শূণ্য হাতে ফেরত আসছে অথবা জেলখানায় আটক হচ্ছে। এহেন বাস্তবতায় বাংলাদেশে বেকারত্বের হার বাড়লেও দেশের বিভিন্ন সেক্টরে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ অবৈধ বিদেশি শ্রমিকদের দখলে চলে যাওয়ার বাস্তবতা মেনে নেয়া যায় না। আমরা যেমন লাখ লাখ অদক্ষ শ্রমিক বিদেশে পাঠাই, তেমনি বিভিন্ন সেক্টরের জন্য দক্ষ টেকনিশিয়ান ও ইঞ্জিনিয়ারের পদ পুরণে বিদেশি জনবলের প্রয়োজনীয়তাও অস্বীকার করা যায় না। এক গার্মেন্ট সেক্টরে লাখ লাখ বিদেশি শ্রমিকের উপস্থিতির পেছনে কোনো সঙ্গত কারণ নেই। বিশেষ অবৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত বিদেশি শ্রমিকদের কারণে একদিকে দেশের শিক্ষিত জনশক্তির কর্মসংস্থানের সুযোগ সংকুচিত হয়ে পড়েছে, অন্যদিকে এসব শ্রমিক দেশ থেকে বিদেশি মূদ্রায় কোটি কোটি ডলার রেমিটেন্স আকারে নিজ দেশে নিয়ে গেলেও আমাদের রাজস্ব বিভাগ বড় ধরনের বঞ্চনার শিকার হচ্ছে। দেশের অর্থনীতি ইতিমধ্যেই নেতিবাচক ধারায় প্রবাহিত হলেও বিদেশি শ্রমিকের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। ইতিমধ্যে ভারতের বৈদেশিক রেমিটেন্স আয়ে বাংলাদেশ তৃতীয় বৃহত্তম উৎস হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। প্রায় এককোটি বাংলাদেশি শ্রমিক বিদেশ থেকে যে পরিমান রেমিটেন্স পাঠাচ্ছে তার একটি বড় অংশই রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে অবৈধ ভারতীয় ও বিদেশি শ্রমিকদের মাধ্যমে বাইরে চলে যাচ্ছে।
অনেক দেরিতে হলেও বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ(বিডা) অবৈধ বিদেশি শ্রমিকদের কারণে কোটি কোটি ডলারের রাজস্ব ক্ষতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ইতিপূর্বে ২০১৬ সালের ফেব্রæয়ারীতে অনুষ্ঠিত এক আন্ত:মন্ত্রনালয় সভায় বিভিন্ন সেক্টরে কর্মরত অবৈধ বিদেশি কর্মীদের করফাঁকি এবং সংখ্যা নিরূপণে একটি টাস্কফোর্স গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। এনবিআর’র অধীনে গঠিত সেই টাস্কফোর্স কাজ শুরু করলেও গত তিন বছরে তারা তেমন কিছুই করতে পারেনি বলে জানা যায়। যেখানে শত শত কারখানা ও প্রতিষ্ঠানে লাখ লাখ বিদেশি শ্রমিক অবৈধভাবে কাজ করছে সেখানে গঠিত টাস্কফোর্স গত ৩ বছরে হাতে গোণা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়েই ঝিমিয়ে পড়েছে এবং বর্তমানে টাস্কফোর্সের কার্যক্রম প্রায় বন্ধ রয়েছে বলে জানা যায়। বিদেশিদের করফাঁকি রোধ এবং তাদের একটি ডেটাবেজ তৈরীর দায়িত্ব ছিল এই টাস্কফোর্সের। এই দায়িত্ব পালনে তাদের ব্যর্থতার কারণে বছরে কোটি কোটি ডলারের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশ। বিদেশি শ্রমিকের সংখ্যা ১০ লক্ষাধিক হলেও তাদের মধ্যে গত বছর আয়কর রিটার্ন জমা পড়েছে মাত্র ১৩ হাজার। এহেন বাস্তবতায় গত সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত বিডার এক বিশেষ সভায় অবৈধ বিদেশি শ্রমিক নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানের কাছে বৈধ-অবৈধ বিদেশি শ্রমিকের সংখ্যা, অবস্থানসহ বিভিন্ন তথ্য জমা দেয়ার একটি নির্দেশনা জারি করা হয়। দেশের চলমান রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতায় এটি খুবই জরুরী উদ্যোগ। সেই সাথে তিন বছর আগে গঠিত এ সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের কার্যক্রমের মূল্যায়ণ, জবাবদিহিতাসহ নতুন করে আরো বেশি জনবল নিয়ে কার্যক্রম শুরুর উদ্যোগ নিতে হবে। অবৈধভাবে কর্মরত লাখ লাখ বিদেশি শ্রমিকের ডাটাবেইজ জাতীয় নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক স্বার্থেই খুব গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। এ ব্যাপারে সরকারের সর্বোচ্চ মহল এবং অর্থমন্ত্রীর নির্দেশনা ও নজরদারি থাকতে হবে। অবৈধ বিদেশি শ্রমিক নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে জবাবদিহিতা ও আইনগত বাধ্যবাধকতার আওতায় আনতে হবে। অবৈধ ও অপ্রয়োজনীয় বিদেশি শ্রমিকদের দেশ থেকে বের করে দিয়ে দেশের বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের পথ প্রশ্বস্ত করতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।