দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
প্রসঙ্গ: ১৪৪০হি. মোতাবেক ২০১৯খ্রি. এর রমযান-পূর্ব শা‘বান মাসের চাঁদ দেখার ঘোষণায় ৬৪ জেলার স্থানীয় ৬৪ উপকমিটি ও কেন্দ্রিয় কমিটির সংশ্লিষ্টদের চাঁদ দেখতে না পাওয়া এবং সে মোতাবেক নেতিবাচক ঘোষণাদানের পরেই ওই রাতে এবং পরবর্তী কয়েকদিন পর্যন্ত বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, পত্র-পত্রিকায় সেদিন বাস্তবে অন্যরা বা বিভিন্নস্থানে চাঁদ দেখা গিয়েছিল মর্মে প্রচার ও লেখালেখি হতে থাকে। যদিও কর্তৃপক্ষের সেই ঘোষণা বিধি-বহির্ভূত ছিল না, তারপরও মাননীয় ধর্ম-প্রতিমন্ত্রী মহোদয়ের সদয় উদ্দোগে সকলের সংশয় দূরীকরনার্থে কয়েকদিনের মাথায় একটি বৈঠক ডাকেন। বৈঠকে ঢাকার বড় বড় মুফতীগণ ও আলেমগণকে এবং যারা যেখানে চাঁদ দেখেছেন মর্মে ইতোপূর্বে অবহিত করেছিলেন, তাঁদেরকেও সাক্ষ্যদান বা বক্তব্য শোনার জন্য আহবান করা হয়। সে অনুষ্ঠানে ঘোষণা’র দিন যাঁরা চাঁদ দেখেছেন বলে দাবী করেছিলেন (রাঙ্গামাটি/মুন্সিগঞ্জ/দিনাজপুর বা ঠাকুরগাঁ) তাঁদের সবার বক্তব্য শুনে বিশেষত মুন্সিগঞ্জের ইমাম সাহেবের নিজে ব্যতীত আরও দু’জনসহ দেখার কথা শুনে এবং তাঁকে যখন জিজ্ঞাসা করা হল, তা হলে আপনি কেন মুন্সিগঞ্জের জেলা উপকমিটিকে বা আপনার থানা/উপজেলার সংশ্লিষ্ট কাউকে কেন অবহিত করলেন না? তখন তাঁর নিরুত্তর হয়ে থাকায়; এ ছাড়া, বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিনের চিন্তাভাবনায় আমার কাছে দু’টি সমস্যা মনে হয়েছে:
সাধারণ জনগণের মত অনেক জানাশোনা লোকজনও একদিকে এ বিষয়টি জানেন না যে, ‘জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটি’ তথা ধর্ম-মন্ত্রণালয় বা ইসলামিক ফাউন্ডেশন কেবল বায়তুল মুকাররমে বসেই বা এ একস্থানে চাঁদ দেখেই চাঁদ প্রমাণিত হওয়া বা না হওয়ার ঘোষণা দেন না; বরং ৬৪ জেলার ৬৪টি স্পটে চাঁদ দেখার পর একে-একে সবগুলোর তথ্য/সংবাদ নিশ্চিত হয়েই ঘোষণাটি প্রদান করা হয়।
আরেকদিকে ৬৪ জেলার ৬৪ স্পটের বাইরে যারা চাঁদ দেখেন (যা একেবারেই সম্ভব, কারণ একটা জেলা তো অনেক বড়; অনেকগুলো উপজেলা হয়ে থাকে। মেঘাচ্ছন্ন দিনে জেলা কমিটির স্পটের বাইরে বিশাল এরিয়ার মধ্যে, মেঘের ফাঁক-ফোকরে, সামান্য সময়ের জন্য চাঁদ দেখা অসমম্ভব নয়) তেমন সাধারণ লোকজন এমনকি সাধারণ আলেম/ইমাম/মুয়াযযেনগণও, এ বিষয়টি জানেন না যে, ‘বিক্ষিপ্তভাবে আমাদের মত কেউ যে-কোন স্থানে চাঁদ দেখলেই রোযা-ঈদ পালন করা যায় না বা তা জরুরী হয় না। বরং তা অবশ্যই সুনির্দিষ্ট ‘চাঁদ দেখা কমিটি’কে জানাতে হবে। আর এ জানানো, চাঁদ দেখার চেষ্টা করা, বিশ্বাসযোগ্য নিকটস্থ কেউ দেখেছেন বলে জানতে পারলে, তাঁকেসহ স্থানীয় কমিটির কাছে সংবাদটি পৌঁছাতে চেষ্টা ও সহযোগিতা করা, একজন মুসলমান হিসাবে প্রত্যেকেরই দায়িত্ব রয়েছে। কেননা নামায-রোযা পালন আমাদের প্রত্যেকেরই ব্যক্তিগতভাবেও, ফরয দায়িত্ব। যে-কারণে বা যে চাঁদ দেখার সঙ্গে আমারও ফরয রোযা এবং ঈদ পালনের সম্পর্ক রয়েছে; সেখানে আমি নিজে আমার সাধ্যের ভেতরের দায়িতটুকুও পালন না করে, কেবল সরকারকে বা চাঁদ দেখা কমিটিকে বা অমুক-তমুককে দোষারোপ করাই যথেষ্ট নয়, যৌক্তিকও নয়।
উক্ত বিষয় দু’টি ষ্পষ্ট করা, আমাদের করনীয়, চাঁদ দেখা কমিটি’র করনীয় এবং এতদসংক্রান্ত শরীয়তের বিধান-দিকনির্দেশনাকে সহজবোধ্য করাই প্রবন্ধটি প্রস্তুতির মূল প্রয়াস।
সুচনা: কয়েক বছর থেকে মাঝে-মধ্যে রমযান ও ঈদুল ফিতর এর সময়ে পুরো দেশে এক অবাকজনক বিক্ষিপ্ত-বিরোধ অবস্থা ছড়িয়ে পড়ে। কেন্দ্রিয় চাঁদ দেখা কমিটির লক্ষ্য-উদ্দেশ্য যেখানে ছিল সারা দেশে সবাই মিলে একসঙ্গে একইদিনে মিলেমিশে ঈদ উদযাপন করা, সেখানে তার বিপরীতে স্থানে- স্থানে, জেলায়-জেলায় দুই-দুই দিনে ঈদ হতে শুরু করেছে; আবার এ বছর (২০১৯ খ্রি. / ১৪৪০ হি.) তো বাংলাদেশে মোট তিনদিন ঈদ উদযাপিত হয়ে গেল। স্বয়ং ঈদের দিন যা আনন্দ-খুশি ও ঐক্য-ভালোবাসার একটা দিন ও সুযোগ ছিল, তাতেও পরস্পর বিরোধ-বিবাদ ও মন-মালিন্যের সূত্রপাত ঘটছে! যা একজন বিবেকবান মানুষ কোন দেশের পক্ষেই কাম্য ও সমীচীন বলে, ভাবতে পারেন না।
এর চেয়েও অধিক ক্ষতিকর সেসব আলোচনা-সমালোচনা যা ঈদ-পরবর্তী এক সপ্তাহব্যাপী পত্র-পত্রিকা, গণ-মাধ্যম বা টকশো ইত্যাদিতে চলতে থাকে। ক্ষেত্রবিশেষে ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে (অনিয়ম ও ভূল হলে বা সরকারের ঘোষণার বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে) সংশ্লিষ্ট আলেমগণকে দোষারোপ করা হয় যে, তাঁরা নিজেদের আপসের বিরোধের কারণে বা রাজনৈতিক কারণে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে গোলমাল বাধাতে চাচ্ছেন! পক্ষান্তরে সরকারের বিরুদ্ধেও এমন অবাস্তব অভিযোগ করা হয় যে, তাঁরা জেনে-বুঝে মুসলমানদের ইবাদতে বিঘœ ঘটান এবং ধর্মীয় বিষয়-ব্যাপারে খামখেয়ালী করেন!
কিন্তু সামান্য চিন্তা করলেই বোঝা যাবে যে, উক্ত উভয় অভিযোগই একেবারে ভূল ও অবাস্তব। কেননা সংশ্লিষ্ট আলেমগণের মাঝে বিরাট একটা সংখ্যা এমনও হয়ে থাকেন যাঁদের রাজনীতির সঙ্গে নূন্যতম সম্পর্কও থাকে না এবং এক্ষেত্রে তাঁদের কারও কোন ব্যক্তিগত স্বার্থেরও কল্পনা করা যায় না। একইভাবে সরকারের সংশ্লিষ্ট সেই বিভাগ বা কমিটিতে জড়িত সদস্যগণসহ অপরাপর সবাই মুসলমান, নিজেরাও রোযা রাখেন, ধর্ম-কর্মের প্রতি তাঁদের সকলেরই সম্মানবোধ অবশ্যই আছে। তাঁদের ব্যাপারে এমন কুধারণা পোষণ যেমন সঠিক বলে মনে হচ্ছে না; তেমনি তাঁরা জেনেবুঝে জনগণের ঈদ-রোযা বিনষ্টের মারাতœক পরিণতি, নিজের ঘাড়ে নিতে যাবেন কেন?
মূল কারণ ও সমস্যা: আসল বিষয়টি এ ছাড়া আর কিছুই নয় যে, একে-অন্যের অবস্থান বুঝতে ও বুঝাতে ভুল বোঝাবুঝির শিকার হয়ে পড়ছেন বা পড়েছেন। তার কারণ সম্ভবত এটাই যে, সংশ্লিষ্ট সরকারী লোকজন এটিকে একটি জাতীয় উৎসব এবং রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনাধীন একটা ব্যাপার মনে করে থাকেন; যাতে আলেমদের কোনরূপ হস্তক্ষেপ তাঁদের কাছে অনাকাঙ্খিত মনে হতে পারে। আরেকটি বিষয় হল, তাঁরা এক্ষেত্রে কেবল সত্য সংবাদ, যা শ্রোতার কাছে সত্যরূপে নিশ্চিতভাবে প্রতিভাত হয়, তার উপর ভিত্তি করেই রোযা বা ঈদ-চাঁদের ঘোষণাদানকে যথেষ্ট মনে করে থাকেন। অথচ এক্ষেত্রে এমন একটা পার্থক্য যে, কারও নিজ প্রত্যয়-বিশ্বাস অপর কারও বেলায়, অন্যভাবে বলা যায়, একজনের বোধ-বিশ্বাস বা জানা সত্য বিষয়টি অন্যের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বা বাধ্যতামূলক বলতে গেলে বা ধর্তব্য হতে পারে তখন যখন তা সত্য-সাক্ষ্য হিসাবে পেশ করা হবে; যার জন্য বিধিবদ্ধ বিশেষ শর্ত ও নিয়ম-নীতি বিদ্যমান। কেবল সত্য সংবাদ হওয়াই শরীয়তের নির্দেশনা মোতাবেক এক্ষেত্রে আইনত যথেষ্ট হয় না।
তা ছাড়া, আলেমগণ জানেন যে, আমাদের ঈদ পালন অপরাপর সাধারণ জাতী-গোষ্ঠির উৎসব-পর্ব পালনের অনুরূপ নয়; তা বরং একটি ইবাদত শুরু করা এবং এর শেষান্তে আরেকটি ইবাদত পালনের নামান্তর হয়ে থাকে। যেখানে শরীয়তের বাতানো নিয়ম- নির্দেশনার বাইরে বা বিপরীতে কোন পন্থা-পদ্ধতি বৈধ হয় না। আর কোন বিষয় যতই সত্য হোক, নির্ভরযোগ্য হোক এবং শ্রোতার/ শ্রোতাদের সে বিষয়ে যতই পাকাপোক্ত প্রত্যয় জন্ম নিয়ে থাকুক; কিন্তু তাঁরা তাঁদের এই প্রত্যয়পূর্ণ বিষয়টি পুরো দেশের জনগণের ওপর আবশ্যকরূপে প্রয়োগ বা চাপিয়ে দিতে পারবেন না যে পর্যন্ত না শরীয়তসম্মত দলীল মোতাবেক এবং বিধি মোতাবেক ‘সাক্ষ্য বাক্য’ উচ্চারণের মাধ্যমে চাঁদ দেখার ‘সংবাদ’টি ‘সাক্ষ্য’ হিসাবে কমিটি/কর্তৃপক্ষের কাছে প্রমাণিত হয়ে যায় এবং তারপর কর্তৃপক্ষ তা বিধি মোতাবেক ঘোষণা করেন। সে কারণেই প্রয়োজন, বিষয়টি প্রশ্নে সুচিন্তিতভাবে এগুনো এবং শরীয়তের নিয়ম-বিধি মোতাবেক চাঁদ দেখার ঘোষণা দানের লক্ষ্যে দেশের বিজ্ঞ মুফতী আলেমগণের পরামর্শ মতে একটা কর্ম-কৌশল তথা নীতিমালা প্রণীত হওয়া বা (যদি না থাকে) থাকা চাই। যাতে বিষয়টি প্রশ্নে সকল আলেমদের ও সর্ব সাধারণ জনতার আস্থা-বিশ্বাস থাকে। তারপর ওই নীতিমালা ও কর্মপন্থা প্রতিপালন সংশ্লিষ্ট সকলের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক করে দিতে হবে। আর সেই কর্মপন্থার নিরীখেই রেডিও, টিভি ও বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে চাঁদ দেখার এবং তা প্রমাণিত হওয়ার সংবাদটি ঘোষণা করা, প্রচারিত হওয়া চাই।
এমন কর্ম-কৌশল অবলম্বনে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, পুরো দেশের আনাচে-কানাচে কোথাও থেকে সরকারীভাবে প্রদত্ত ঘোষণার বিরুদ্ধে প্রশ্ন উঠবে না। বিভিন্ন ধ্যান-ধারণার সঙ্গে জড়িত ও শ্রেণি-পেশার আলেমগণ সকলেই তার সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করবেন এবং সারা দেশে খুশি ও আনন্দঘন পরিবেশে মিলেমিশে একসঙ্গে, একইদিনে ঈদ উদযাপিত হতে পারবে। যদিও শরীয়তের বিবেচনায় সারা দেশে একইদিনে ঈদ উদযাপিত হওয়া বিষয়টির ক্ষেত্রে তেমন বিশেষ কোন গুরুত্বারোপ করা হয়নি। কেননা ইসলামের প্রথম যুগসমূহে তৎকালীন বিদ্যমান সম্ভাব্য যোগাযোগের উপকরণসমূহকেও এ কাজের প্রয়োজনে ব্যবহারে এবং একইদিনে ঈদ উদযাপনের বিষয়ে কোন তাকিদ করা হয়নি। আবার যেক্ষেত্রে দেশটির আয়তন সুবিশাল হবে সেক্ষেত্রে তো উদয়স্থলের ভিন্নতার কারণে, মারাতœক পরিস্থিতির মুখোমুখী হতে হবে।
তারপরও যদি একটা দেশের জনগণ ও সরকারের সদিচ্ছা হয় যে, সারা দেশে একইদিনে ঈদ উদযাপন হওয়া চাই; সেক্ষেত্রেও শরীয়তের আলোকে তার সুযোগ আছে। তবে তার শর্ত হল, ঈদের ঘোষণা যেন পুরোপুরি শরীয়তের উক্ত সাক্ষ্যবিধি বা নিয়ম মোতাবেক হয়। (চলবে)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।