পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
প্রতিটা মানুষ চায় সুস্থতার সাথে বেঁচে থাকতে। আর এই সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্যই আমাদের জীবনের সাথে চলে আসল যুদ্ধ। আমরা অসুস্থ হওয়ার সাথে সাথে সুস্থ হতে মরিয়া হয়ে উঠি এবং চিকিৎসকের স্মরণাপন্ন হই এবং ওষুধ সেবন করে থাকি। আর বেঁচে থাকা এবং সুস্থ থাকার সংগ্রামে রোগ নিরাময়কারী ওষুধ যদি হয় ভেজাল, নকল এবং মানহীন তাহলে কীভাবে সুস্থ থাকা সম্ভব? ভেজাল ওষুধ কতটা মারাত্বক হতে পারে এ বিষয়ে মোটামুটি সবাই অবগত। ধরা যাক, আপনার কোনো সংক্রামক রোগ হয়েছে। সেক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের ব্যবহার অপরিসীম। জীবাণু দ্বারা দেহের কোনো অঙ্গ-প্রতঙ্গ আক্রান্ত হলে জীবাণু টিকে থাকার জন্য যুদ্ধ শুরু করে। এই ক্ষেত্রে শরীর তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার মাধ্যমে বা অ্যান্টিবায়োটিকের মাধ্যমে সুস্থ হয়ে উঠার জন্য জীবাণু ধ্বংস করার কাজ করে। দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে বা নষ্ট হয়ে গেলে এবং উপযুক্ত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা না হলে জীবাণু দেহকে ধ্বংস করার কাজে লেগে যায়। এর মানে হলো, মারাত্বকভাবে স্বাস্থ্য ঝুঁকি বেড়ে যায়।
বাংলাদেশে যে পরিমাণ নকল ওষুধ উৎপাদন, মেয়াদহীন ওষুধ পুনঃ প্যাকেটজাতকরণ এবং ভেজাল ওষুধের সয়লাব দেখা যায় তা পৃথিবীর আর কোনো দেশে দেখা যায় না। যে সকল ওষুধ আসল নয় বা সঠিক কাঁচামাল দিয়ে তৈরি নয় সেটাই ভেজাল বা নকল ওষুধ। যে ওষুধ সঠিক কাঁচামাল ছাড়া, মান-নিয়ন্ত্রণহীনভাবে তৈরি করা হয় সেটাই হলো নকল ওষুধ। উৎপাদন এবং এই ওষুধ যখন মানুষের দোড়-গোড়ায় পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হয় তখন সেই পদ্ধতিকে বলা হয় নকল ওষুধ বাজারজাতকরণ। তবে এটা সত্য যে, আমাদের দেশ ছাড়াও প্রায় সকল দেশেই নকল ও ভেজাল ওষুধ কম হলেও কিছুটা পাওয়া যায়। তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো পাকিস্তান, ভারত, ল্যাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকা। পরিসংখ্যান ঘাঁটলে দেখা যায় , বিশে^র উৎপাদিত প্রায় ১৫ শতাংশ ওষুধে ভেজাল রয়েছে, যার মাঝে এশিয়া ও আফ্রিকার কিছু অঞ্চলে এর পরিমাণ প্রায় ৫০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। পরিসংখ্যানে বাংলাদেশেও কম নয়, ১৯৮০ থেকে ১৯৮২ সাল নাগাদ ভেজাল প্যারাসিটামল সিরাপ খেয়ে কয়েক হাজার শিশুর মৃত্যু হয়েছিল, যা সরকাররে ওষুধ প্রসাশনের মতে, দুই হাজারের অধিক হয়েছিল। আবার ২০০৯ সালের মাঝামাঝিতে শুধুমাত্র ভেজাল প্যারাসিটামল ওষুধ সেবনে ২৮ শিশুর মৃত্যু হয়েছিল।
আসল ওষুধ উৎপাদনের বদলে নকল ওষুধ উৎপাদনকারী বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে বাংলাদেশে। তা আরো দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে আইনের সঠিকভাবে প্রয়োগ না হওয়ার কারণে। আইনশৃংখলা বাহিনী হাতে গোনা কিছু ওষুধ বিক্রেতা ও কিছু প্রতিষ্ঠানকে আইনের আওতায় এনে জরিমানা করে ছেড়ে দিচ্ছে, আবার কিছু মামলাও হচ্ছে। কিন্তু প্রতিকার নেই। কারণ, ঐসকল অসাধু ওষুধ ব্যবসায়ী সাময়িকের জন্য থেমে থাকলেও পুনঃরায় একই পথ অবলম্বন করে।
দিন দিন প্রশস্ত হচ্ছে নকল, ভেজাল ওষুধের বাজার। এর অনেক কারণ সহজেই লক্ষযোগ্য। কিছু প্রধান কারণ উল্লেখ করতে চাই। (১) ইন্টারনেটের ব্যবহার জীবন চলার পথকে যেমন সহজ করেছে; সেই সাথে ইন্টারনেটের মারাত্বক অপকার রয়েছে। এই ইন্টারনেটকে কাজে লাগিয়ে অনলাইন ভিত্তিক কিছু প্রতিষ্ঠান ভেজাল ওষুধ সরাসরি ক্রেতার হাতে পৌঁছে দিচ্ছে। (২) রাস্তার আশে পাশে, ছোট-বড় হাট-বাজারে ছত্রাকের মতো গড়ে উঠা কিছু ওষুধের দোকান নকল ওষুধ বিক্রয়ের মূল হাতিয়ার হয়ে উঠেছে নকল ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে। (৩) তথ্যমতে, দেশে প্রায় ২৫-২৬ হাজার রকমের ওষুধ তৈরি হয়, যার মধ্যে সরকার মাত্র ৪ হাজার রকমের ওষুধ পরীক্ষা করে দেখতে পারে। ফলে ভেজাল, নকল এবং নিম্নমানের ওষুধ ক্রমাগত ছড়িয়ে পড়ছে দেশের সব জায়গায়। আর এভাবেই ধীরে ধীরে যেমন বাড়ছে ভেজাল ওষুধের বাজার; তেমনি মানুষের মৃত্যু ঝুঁকিও পাল্লা দিয়ে বেড়ে যাচ্ছে।
দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ভেজাল, নকল ওষুধের পরিসংখ্যান বেশি। দেশের মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ কম হলে দেখা যায় নিম্ন থেকে মধ্যম আয়ের মানুষ কঠিন রোগেও দামী ওষুধ কেনার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে মুনাফালিপ্সু কিছু মানুষ কম দামে ভেজাল ওষুধ ছড়িয়ে দেয়। তাই ভেজাল, নকল ওষুধের ব্যাপারে সরকারের আরো সজাগ হতে হবে। তেমনি সচেতন হতে হবে প্রতিটা মানুষকে। চীনে ওষুধ এবং খাদ্য দ্রব্যে ভেজাল মিশালে মৃত্যুদন্ডের বিধান আছে। যদিও আমাদের বাংলাদেশে সেটা সম্ভব হয়ে উঠেনি। তবে আমরা দেশের জনগণ যদি নকল, ভেজাল ওষুধ চিনতে পারি, তাহলে ভোক্তা অধিকার আইনে মামলা করার সুযোগ পাবো। সুতরাং আমরা চেষ্টা করলে কিছু নিয়মে নকল ওষুধ চিনতে পারবো। যেমন, ১. ওষুধ কেনার সময় ওষুধের গায়ে যে সিল থাকে সেটি ভালো করে খেয়াল করতে হবে। কোনো প্রকার গলদ মনে হলে সে ওষুধ এড়িয়ে চলা ভালো। প্রয়োজনে অন্য কোনো দোকান থেকে ওষুধ কিনতে হবে। ২. আপনি যে ওষুধ খাচ্ছেন তা পরের বার কেনার সময় একই ওষুধ কিনা খালি লেভেলের সাথে মিলিয়ে কেনা ভালো। তাতে নকল ওষুধ কিনা কিছুটা হলেও যাচাই করতে পারবেন। ৩. ওষুধ কেনার সময় দাম একটি বড় ব্যাপার। দাম কম বেশি বা গড়মিল মনে হলে সে ওষুধ এড়িয়ে যাওয়া ভালো। নকল, ভেজাল ওষুধের দাম কম হয়ে থাকে। ৪. ওষুধের প্যাকেটে উৎপাদন এবং মেয়াদ দেখে নিন। ৫. আমাদের দেশে প্যানাসিয়া ডট লাইভ নামে একটি ওয়েব সাইট আছে। সেখানেও আপনার ওষুধটি সঠিক কিনা যাচাই করতে পারেন।
পরিশেষে শুধু বলতে চাই, যারা ভেজাল, নকল ওষুধ তৈরি করছে তাদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক কঠোর শাস্তির আওতায় আনা খুবই জরুরি। সেই ব্রিটিশ আমল থেকে অদ্যাবধি বাংলাদেশে ১৯৪০ সালের ড্রাগ অ্যাক্ট বা ওষুধ আইন বলবৎ আছে। এ আইনের আওতায় যে শাস্তির কথা বলা হয়েছে তা খুবই নগন্য। অপরাধের তুলনায় শাস্তির মাত্রা এতই কম যে তাতে অপরাধ ও অপরাধীর ওপর তেমন কোনো প্রভাব পড়ছে না। নকল, ভেজাল ও ক্ষতিকর ওষুধ উৎপাদন ও বিক্রি করার মাধ্যমে মানুষ হত্যার শাস্তি এক বা দুই লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে এক, দুই বা তিন মাস জেল গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এসব ক্ষেত্রে আইনকানুন পরিবর্তন করে আরো কঠোর শাস্তির বিধান করতে হবে, যাতে করে আর কেউ কোনো সময় নকল, ভেজাল ওষুধ উৎপাদন ও বাজারজাত করার সাহস না পায়। সেই সাথে দেশের সকল ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত ওষুধ ও প্রতিষ্ঠানকে ওষুধ প্রশাসনের নজরে আনতে হবে।
লেখক: আইনজীবী এবং কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।