Inqilab Logo

শুক্রবার, ০৫ জুলাই ২০২৪, ২১ আষাঢ় ১৪৩১, ২৮ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

ভিকটিমের জন্য যথাযথ প্রতিকার নিশ্চিত করতে হবে

তৈমূর আলম খন্দকার | প্রকাশের সময় : ৭ অক্টোবর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

প্রাচীন কালে ইংরেজি শব্দ Victim বলতে ধর্মোদ্দেশ্যে বলি দেয়া কোনো মানুষ বা প্রাণিকে বুঝাতো। দেবতার নামে বা কোন ধর্মীয় উৎসবে জীবিত মানুষকে বলি (হত্যা করা) দেয়ার একটি ধর্মীয় সংস্কৃতি এক সময় চালু ছিল। দেবতার উদ্দ্যেশ্যে তখন যাকে জবাই করা হতো তাকেই ভিকটিম বলা হতো। কিন্তু আধুনিককালে সে পুরাতন ধারা পরিবর্তন হয়ে হত্যা, আঘাত (Injury), হামলা (Assult), অবিচার, রোগব্যাধি (যেমন ডেঙ্গু, যে রোগব্যাধি কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণে সংক্রমিত হয়) প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা কমিউনিটিকে বুঝায়। আধুনিক ধারণায় আইন ভঙ্গের কারণেও মানুষ ভিকটিম হয়। আমেরিকান Human Right Act মোতাবেক, মানবাধিকার বিষয়ক ইউরোপীয় কনভেনশন বিরোধী কোনো করণ বা অকরণের (Do or undo)) দ্বারা প্রকৃত পক্ষে বা প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবার ঝুঁকিসম্পন্ন ব্যক্তিকে ‘ভিকটিম’ হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়।
২০০৪ সালে আইন বিশেষজ্ঞ John Jay College of Criminal Justice--এর অধ্যাপক Andrew Karmen ভিকটিমের উপর একটি তথ্যভিত্তিক সূত্র প্রদান করে বলেন যে, কোনো বেআইনী কার্যকলাপের জন্য কেউ শারিরিক, ইমোশনাল এবং অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে সে ব্যক্তিও ভিকটিম বা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি হিসাবে চিহ্নিত হবে। অপরাধ বিজ্ঞান পর্যালোচনায় ভিকটিমের সংজ্ঞায় আরো অনেকগুলি শব্দ যোগ হয়েছে, যেমন- যে কোনো ব্যক্তি কোনো কারণে Loss বা Injury বা hardship প্রভৃতি কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেও ভিকটিমের আওতায় আসে। আইনের বা ক্ষমতায় অপপ্রয়োগ, ডেসট্রাকটিভ কার্যকলাপ, দুর্ঘটনা বা জীবাণু সংক্রান্ত আঘাত, অস্বচ্ছতা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে আইন দ্বারাও মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত বা Victim হয়ে থাকে। ভিকটিম দুই প্রকারের, যথা (১) প্রত্যক্ষ বা প্রাথমিক এবং (২) পরোক্ষ বা সেকেন্ডারি। যে ব্যক্তি প্রত্যক্ষভাবে আঘাত প্রাপ্ত হয় তিনি প্রাইমারী ভিকটিম। কিন্তু যে ব্যক্তি সরাসরি আঘাত প্রাপ্ত নন, বরং ইমোশনালি ও অনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত তিনি বিশেষজ্ঞদের মতে সেকেন্ডারি ভিকটিম হিসাবে চিহ্নিত।
প্রায় ৪,৫০০ বছর পূর্বে প্রাগ বেবিলোনিয়ান যুগে যখন Code of UrNammu চালু ছিল তখন অপরাধী ভিকটিমকে ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য ছিল। উক্ত আইনে ধনী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের চক্ষুশুল থেকে নারী ও এতিমদের সুরক্ষার বিধান করা হয়েছিল। ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তিকেই উক্ত আইনে অপরাধীর শাস্তির পরিমাণ নির্ধারণের ক্ষমতা দেয়া ছিল। যেমন ‘চক্ষুর পরিবের্ত চক্ষু’, ‘নাকের পরিবর্তে নাক’ প্রভৃতিও তখন আইনসিদ্ধ ছিল।
প্রায় ৪,০০০ বছর পূর্বে বেবিলোনিয়ান আইন Code of Hammurabi মোতাবেক অপরাধীকে শাস্তি দেয়ার বিষয়ে নিম্নবর্ণিত নীতিমালা নির্ধারণ করা হয়:
(ক) শক্তিশালী/প্রভাবশালী মহল দুর্বলকে আঘাত করতে পারবে না।
(খ) কর্তৃপক্ষ/রাষ্ট্র যদি ডাকাত ধরতে না পারে বা আইনের আওতায় আনতে সক্ষম না হয় তবে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে রাষ্ট্র ক্ষতিপূরণ প্রদান করবে।
(গ) কোনো ব্যক্তি যদি কারো গবাদি পশুকে ক্ষতি বা আহত করে তবে আহত পশু ভালো না হওয়া পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে তার (অপরাধীর) পশু ভিকটিমকে ব্যবহার করতে দিতে বাধ্য থাকবে।
ইটালির প্রখ্যাত মনোবিজ্ঞানী ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ Cesare Beccaria (১৭৩৮-১৭৯৪) ভিকটিমের অধিকার সম্পর্কে নতুন একটি মতবাদ চালু করেন যা নিন্মে উল্লেখ করা হলো:
(ক) অপরাধী থেকে ভিকটিমের জন্য মাত্রাতিরিক্ত ক্ষতিপূরণ আদায় করা অযৌক্তিক।
(খ) নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য অপরাধীকে সুযোগ দিতে হবে।
(গ) তিনি মনে করেন বিচারে আদালতের রায় বা কোনো আদেশে কোনো ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন যে, All members of a socity could be victim of the law and those tasked with admistering the law| ক্ষমতার অপব্যবহারেও মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এ দর্শনেও Cesare Beccaria বিশ্বাস করতেন। ১৯৪১ সালে Hans Von সর্ব প্রথম ভিকটিম ও অপরাধীর মধ্যে পারষ্পারিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার উপর একটি আর্টিকেল প্রকাশ করেন। ১৯৪৭ সালে ফ্রান্সের দার্শনিক Benjamin Mendelson ভিকটিমের বিষয়টি জনসম্মুখে তুলে ধরেন।
ব্রিটিশ আইন সংস্কারক Margery Fry ১৯৫০ সালে The Roots of Crime শিরোনামে একটি আর্টিকেল লেখেন এবং ১৯৫১ সালে Arms of the law নামে একটি পুস্তক (বই) প্রকাশ করেন যাতে তিনি ভিকটিমের ক্ষতিপূরণ সংক্রান্ত বিষয়ে নিম্নবর্ণিত তিনটি বিষয়ের উপর গুরুত্ব অর্পণ করেন।
(ক) ক্ষতিগ্রস্ত নারীকে আশ্রয় দিতে হবে, (খ) ভিকটিম ও অপরাধীর মধ্যে ক্ষতিপূরণের বিষয়টি নির্ধারণ করতে হবে ও (গ) আঘাত প্রাপ্তির কারণে ভিকটিম যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেছে সে পরিমাণ অর্থ অপরাধীর নিকট থেকে আদায় করা।
Margery Fry এর মতবাদ মোতাবেক, রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে ১৯৬৩ সালে সর্বপ্রথম নিউজিল্যান্ড ভিকটিম ক্ষতিপূরণ তহবিল গঠন করে। অনুরূপভাবে ১৯৬৪ সালে ব্রিটেন, ১৯৬৫ সালে কেলোফোর্নিয়া, নিউ ইউয়র্ক ১৯৬৬ সালে, হাউউই রাজ্যে ১৯৬৭ সালে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে ভিকটিম ক্ষতিপূরণ তহবিল গঠিত হয়। আমেরিকার কংগ্রেস ১৯৯০ সালে Victims Rights and Restitution Act এবং ১৯৯৪ সালে Violence against women Act পাস করে। অনুরূপ ২০০০ এবং ২০০৩ সালে বাংলাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতন আইন পাশ হয়। ২০১৩ সালে শিশু আইন ও প্রতিবন্ধী সুরক্ষা আইন বাংলাদেশ পার্লামেন্ট পাশ করে। কিন্তু আইনের প্রভাব ও কার্যকরিতা খুবই ধীর এবং এর পিছনের কারণ নানা বিধ।
আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার দাবি দীর্ঘ দিনের। কিন্তু এর প্রতিষ্ঠার চেয়ে ব্যক্তিশাসন প্রতিষ্ঠার কলা কৌশল বর্তমানে অনেক বেশি। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা ব্যক্তিশাসন প্রতিষ্ঠার পক্ষে, কারণ ব্যক্তিশাসন প্রতিষ্ঠিত থাকলে কর্মচারীরা অর্থাৎ আমলারা সমুদয় সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে এবং ক্ষমতা প্রর্দশনের রাস্তা থাকে অনেক প্রশস্ত, কেননা ব্যক্তি শাসনে জবাবদিহিতার পথ দিনে দিনে সরু হওয়ার কারণে রাজকর্মচারীরা ধরাকে সরা জ্ঞান করে বিধায় যা খুশি তাই করতে পারে। শুধুমাত্র উপরস্ত কর্মকর্তাকে সন্তোষ্ট রাখতে পারলেই তাদের পথে অন্যকোন কাঁটা থাকে না। বিচার প্রক্রিয়া, বিচারকের স্বাধীনতা প্রভৃতি নিয়ে প্রতিনিয়তই অনেক কথা আওড়ানো হচ্ছে। বিচারকগণ সরকারের মুখের দিকে তাকিয়ে মামলার রায় দেন একথাও দেশবাসীসহ বিচার প্রার্থীগণ বিশ্বাস করে। এ সব পরিস্থিতিতে সাবেক প্রধান বিচারপতি এস.কে. সিনহার বিদায় বেলাটি পর্যালোচনা করলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আজ কোথায় তা সহজেই উপলব্ধি করা যায়।
বিচার ব্যবস্থার প্রতি অসন্তুষ্টির কারণে বিকল্প বিচার ব্যবস্থার দাবি উঠেছে এবং বিকল্প ব্যবস্থার মানুষ সুফল পেতে শুরু করেছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির (এডিআর) মাধ্যমে ১০ হাজার ৩৫৭ জনকে সুফল দেয়া হয়েছে। ৮ কোটি ২৫ লাখ দুই হাজার ২৭০ টাকা ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষকে দেয়া হয়েছে বলে জাতীয় আইনগত প্রদান সহায়তা সংস্থা দাবি করেছে। এ ছাড়া সফল বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি হওয়ায় পরবর্তীতে উপকারভোগীরা আদালত থেকে ২৪৩টি মামলা তুলে নিয়েছে। জাতীয় আইনগত প্রদান সহায়তা সংস্থা বিনামূল্যে দু’পক্ষের সমঝোতার মাধ্যমে এ অর্থ আদায় করে দিয়েছে। সংস্থাটির বার্ষিক এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়। এতে বলা হয়, বিকল্প পদ্ধতিতে বিরোধ নিষ্পত্তি সারা বিশ্বে দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। তাদের মতে শান্তিপূর্ণ উপায়ে বিরোধী পক্ষের সম্মতিতে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ায় বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি করা হয়েছে।
বিচার ব্যবস্থার গুণগত পরিবর্তন এখন সময়ের দাবি। রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত বিচার ব্যবস্থা জনগণের চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, আইন প্রণেতাদের উপরেও। প্রথম অভিযোগ, হালে তারা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয় নাই, বরং জনগণকে জিম্মি ও ভিকটিম বানিয়ে গৃহপালিত নির্বাচন কমিশন দিয়ে নির্বাচনী ফলাফল হাতের মুঠোয় নিয়েছে। এটা একটি মহা দুর্নীতি। এ নিয়ে প্রশ্ন উপস্থাপন একমাত্র বিচার বিভাগই করতে পারতো তার এখন আর সেই অবকাশ আছে বলে মনে হয় না।
একটি সভ্য সমাজ ব্যবস্থায় সরকার নিয়ন্ত্রিত বিচার ব্যবস্থা ভিন্ন মতাবলম্বীদের নির্যাতনের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হওয়া কাক্সিক্ষত বা বাঞ্চনীয় নয়। বিচারিক ব্যবস্থা ছাড়া একটি রাষ্ট্র, সমাজ বা জাতি চলতে পারে না। আইনের শাসনই এখন সময়ের দাবি। তবে সে আইন হতে হবে জনকল্যাণমুখী, যে আইন শাসকের গদি রক্ষার জন্য প্রয়োগ হচ্ছে তা আইনী বর্বরতা, কল্যাণমুখী নয়। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে আইনের কল্যাণমুখী ব্যবহার স্বাধীনতার স্বার্থকতা বয়ে আনে। আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ হোক শাসকের নয়, বরং জনতার স্বার্থে। ভিকটিম পাক তার উপযুক্ত বিচার ও ক্ষতিপূরণ। ইনসাফ প্রতিষ্ঠা হোক আপন গতিতে।
লেখক : কলামিস্ট ও আইনজীবী



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন