পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বর্তমানে মানুষ নিজেদের উন্নত সভ্যতার নাগরিক দাবি করলেও মাঝে-মাঝেই নীতি-নৈতিকতা ও কর্মকান্ডে আইয়্যামে জাহেলিয়াতের যুগকেও হার মানাচ্ছে। ‘সুস্থ দেহ, সুন্দর মন, উন্নত জীবন’, বাক্যটি শুনতে চমৎকার হলেও বর্তমান বাংলাদেশে তা নীতিবাক্যের যাদুঘরে স্থান পেতে চলেছে। পূর্বে আমাদের দেশে খাদ্য সঙ্কট ছিল, অর্ধাহারে-অনাহারে মানুষ দিন কাটাতো। খাদ্যাভাবে মানুষ মারা যাবার নজিরও ছিল। বর্তমানে বিজ্ঞানভিত্তিক কৃষির কারণে আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, অনিরাপদ খাদ্যে দেশ সয়লাব হয়ে গেছে। কোনোভাবেই খাদ্যসন্ত্রাসীদের অপতৎপরতা বন্ধ করা যাচ্ছে না। সম্প্রতি বিএসটিআই বাজারের কিছু পণ্য পরীক্ষা করে তা মানহীন বলে প্রতিবেদন দাখিল করেছে। নিঃসন্দেহে এটি প্রশংসার দাবীদার। কিন্তু আজ যে পণ্যটি মানহীন বলে সরকারের নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিবেদন আকারে জানানো হয়, দু-একদিন পরেই আবার একই সংস্থা থেকে পণ্যটির গুণগত মান ঠিক রয়েছে বলে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। এমন কর্মকান্ড জনসাধারণের মনে যথেষ্ট উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার সৃষ্টি করে যা বলার অপেক্ষা রাখে না। আবার বাজারে রয়েছে হাজার হাজার রকমের পণ্য। সাধারণ ক্রেতার জানার কোনো সুযোগ নেই কোন পণ্যটি মানহীন; কোনটিই বা গুণগত মানসম্পন্ন? টেলিভিশন, পত্রিকায় বা পোস্টারে দৃষ্টিনন্দন বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রতিটি কোম্পানিই নিজেদের পণ্যকে বাজারের সব থেকে সেরা পণ্য হিসেবে দাবি করে থাকে। সাধারণ ক্রেতা বা ভোক্তার সাথে এটি এক ধরনের প্রতারণা। এমন বিজ্ঞাপনের ফলে ভোক্তারা দ্বিধায় ভুগে থাকেন। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় যে বিএসটিআইয়ের সীল বা লোগো দেওয়া থাকে অনেক পণ্যে অথচ সেসব পণ্য বাজারে বিক্রয়ের অনুমোদনই নেই। সরকারের নির্ধারিত প্রতিষ্ঠানসমূহের নিয়মিত বাজার তদারকি না করার ফলে নামে-বেনামে বাধাহীনভাবে বিভিন্ন পণ্য বিক্রয় হচ্ছে, যা জনসাধারণের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। হলুদের গুঁড়ায় ইটের গুঁড়া মেশানো, গুঁড়া মরিচে রং মেশানো এখন যেন নিত্যদিনের ব্যাপার। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সমন্বয়হীনতার অভাব দেশে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণে প্রধান অন্তরায়। এছাড়াও সংস্থা দুটির পর্যাপ্ত লোকবলের অভাব, আধুনিক ল্যাবলেটরির অনুপস্থিতিও অন্যতম কারণ। আবার আমাদের দেশের রাজনীতিবিদেরা এই স্পর্শকাতর বিষয়টি নিয়েও রাজনীতির নোংরা খেলা খেলে থাকেন। কিছুদিন পূর্বে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, খাদ্যে ভেজাল দেওয়া বিএনপি-জামায়াতের কাজ। সরকারদলীয় ব্যক্তি দ্বারা পরিচালিত প্রতিষ্ঠান থেকে ভেজাল দেওয়া হয় বলেও অনেক সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রথম সারির নেতাদের বক্তব্য শোনা যায়। জনগুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর এমন একটি বিষয় নিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের বাগযুদ্ধের সুযোগে খাদ্যসন্ত্রাসীরা নিজেদের কুকর্ম চালিয়ে যেতে থাকে বিনা বাধায়। যানজট, ভিড়ের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে এবং স্বাচ্ছন্দ্যে কেনাকাটা করতে অনেকেই বেছে নিচ্ছেন অনলাইন বা ডিজিটাল বাজার ব্যবস্থা। কিন্তু প্রতারণার সর্বোচ্চ জালটি যেন এখানে বিছিয়ে রাখা হয়েছে। মোবাইল ফোন অর্ডার করার পর মোবাইলের মোড়কে এসেছে সাবান, স্বর্ণালঙ্কার অর্ডারের পরে এসেছে ধাতব বস্তু, জামদানি শাড়ির বদলে দেওয়া হয়েছে সুতি কাপড় এসব যেন এখন প্রতিদিনের বিড়াম্বনা। এমন প্রতারণার শিকার হলে দেশে বিভিন্ন আইন আছে, কিন্তু জনসচেতনতা না থাকায় ফলপ্রসূ হচ্ছেনা আইনসমূহ। শুধু তাই নয়, প্রতারণার ভিন্ন ভিন্ন কৌশল যেন অনলাইন ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান সমূহেরই আবিষ্কার! উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একটি জামার প্রকৃত মূল্য ৫০০ টাকা হলেও অনলাইনে নির্ধারিত মূল্য দেওয়া আছে ১৫০০ টাকা। আবার সেখানে লেখা আছে ৫০% ছাড়! তাহলে ক্রেতাকে পরিশোধ করতে হচ্ছে ৭৫০ টাকা, সেই সাথে তো কুরিয়ার চার্জ আছেই! এভাবে অধিকাংশ পণ্যে অতিরিক্ত মূল্য নেবার পাশাপাশি অনলাইনে পণ্যের প্রদর্শিত গুণগত মান ঠিক না থাকার অভিযোগ পাওয়া যায় অহরহ। বাংলাদেশে অনলাইন ভিত্তিক বাজারের যে বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে, কিন্তু কিছু প্রতারক ও অসাধু ব্যক্তির অপকর্মের জন্য অনলাইন বাজার ব্যবস্থা ক্রমেই ভোক্তাদের আস্থা হারিয়ে ফেলছে। দেশে অনলাইনে ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য ওয়েবসাইট বাড়লেও এখনো পর্যন্ত তা সুসংগঠিত নয়। নেই অনলাইনে কেনাবেচার কোনো নীতিমালা। গতানুগতিক ব্যবসার মতো অনলাইনে ব্যবসা শুরু করার জন্য ট্রেড লাইসেন্স সংগ্রহ করতে হয়। এরপর ডোমেইন রেজিস্ট্রেশন করে ওয়েবসাইট তৈরি করে নিয়ে, প্রয়োজন অনুযায়ী হোস্টিং নিয়ে সাইট চালু করতে হয়। অনেকেই এখন ঘরে বসেই সামাজিক যোগাযোগ সাইটগুলো ব্যবহারের মাধ্যমে বুস্টিং পদ্ধতির মাধ্যমে নিজস্ব অনলাইন দোকানের বিজ্ঞাপন প্রচার করছে। এজন্য ফেসবুক, টুইটার খুললেই একটার পর একটা বিজ্ঞাপন দেখা যায়। এতে নিয়মিতই বিভিন্ন পণ্যের বিবরণ ও মান সম্পর্কে সব ধরনের খবর দেওয়া হয়। অনেকে আবার কোন ওয়েবসাইট তৈরি করে নয়, ফেসবুকের ফ্যান পেজের মাধ্যমে অনলাইনে ব্যবসা করছেন। এভাবে বিক্রিত পণ্যের ওপর ভ্যাট দিতে হয়না। কারণ, বাংলাদেশের অনলাইন স্টোরগুলোতে মূলত নিজস্ব পণ্য থাকে না। তাই এ ক্ষেত্রে ভ্যাটের বিষয়টিও খাটেনা। যারা দেশের বাইরে থেকে পণ্যে অর্ডার নেন তাদের বৈদেশিক মুদ্রা আনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৪৭-এর ১৮/এ ধারার অনুমোদন নিতে হয়। বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৪৭-এর ১৮ এ এবং বি ধারায় স্থানীয় এজেন্ট বা প্রতিষ্ঠানের কমিশন, ফি, সার্ভিস চার্জসহ যাবতীয় তথ্য এবং অফিস খরচ হিসাব বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা বিনিয়োগ বিভাগে দাখিল করতে হয়। অন্যদিকে অন্যান্য দেশে পণ্য বিক্রির সুযোগ পেতে হলেও বিক্রেতাকে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে শুরু করে ঠিকানা, জাতীয় পরিচয় পরিচয়পত্রসহ আনুষঙ্গিক তথ্য দাখিল করতে হয়। এসব তথ্যের সত্যতা যাচাই-বাছাইয়ের পরই একজন বিক্রেতাকে পণ্য বিক্রির জন্য অনলাইনে বিজ্ঞাপন প্রদানের সুযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু আমাদের দেশে যে কেউ ইচ্ছে করলেই অনলাইনে পণ্য বিক্রয়ের জন্য বিজ্ঞাপন দিতে পারেন।
যেহেতু বর্তমানে বাংলাদেশে ই-কমার্স বা ডিজিটাল বাজার ব্যবস্থা সম্পর্কিত কোনো আইন নেই সেহেতু জনসচেতনা তৈরির মাধ্যমে এই সমস্যা থেকে উত্তরণ হবার চেষ্টা করতে হবে। ডিজিটাল বাজার ব্যবস্থায় প্রতারণা এড়াতে সরকারের অতিসত্ত¡র কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। ডিজিটাল বাজার ব্যবস্থা সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে ভোগান্তি এড়ানো সম্ভব। এক্ষেত্রে সরকারের আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা অতীব প্রয়োজন। ডিজিটাল বাজার ব্যবস্থায় অসাধুপায় অবলম্বন করলে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে এর প্রতিকার সম্ভব।
অনলাইন ভিত্তিক বাজার ব্যবস্থার আশার দিক হলো দেশে এখন অনেক ই-কমার্স কোম্পানি আছে যাদের ট্রেড লাইসেন্স আছে, নিজস্ব অফিস আছে এবং তারা সরকারের বাজার সংক্রান্ত নীতিমালা মেনে ব্যবসা করে। গ্রাহকদের জন্য এসব প্রতিষ্ঠান থেকে কেনার সুবিধা হচ্ছে, অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের রিটার্ন আর রিফান্ড পলিসি আছে, কোনো সমস্যা হলে সেটির সমাধান করতে তারা বাধ্য। আবার যদি ক্রেতা তাতেও সন্তুষ্ট না হন তবে ‘জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর’ বরাবর অভিযোগ করতে পারে খুব সহজেই এবং অভিযোগ প্রমাণিত হলে ই-কমার্স কোম্পানি সেটির ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য। ধীরে ধীরে ই-কমার্স কোম্পানিগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং তাদের সেবার মান উন্নত হচ্ছে।
বাংলাদেশে ডিজিটাল বাজার ব্যবস্থা অত্যন্ত সম্ভাবনাময় খাত। অসাধুপায় বন্ধ করলে এটি আরো জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। এ খাতে ভোগান্তি এড়াতে উল্লেখিত প্রস্তাবনাসমূহ বাস্তবায়ন করলে প্রতারণার দ্বার বন্ধ হতে পারে। অনলাইন বাজার ব্যবস্থা অর্থ্যাৎ ই-কমার্স সহায়ক উপযুক্ত জাতীয় নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। আর্থিক লেনদেনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। আস্থাশীল ই-কমার্স পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। এক্ষেত্রে সরকার ও অনলাইন বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসতে হবে। অনলাইনে পণ্য বিক্রয় করার জন্য সরকারের নির্ধারিত অধিদপ্তর থেকে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করতে হবে। অনলাইনে পণ্য বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত অফিস থাকা বাধ্যতামূলক করতে হবে। ক্রেতা প্রতারিত হলে অভিযোগ করার প্রক্রিয়া সহজ করতে হবে এবং অভিযোগটি দ্রæততম সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে হবে। কোনো প্রকার শর্ত ছাড়া পণ্য হাতে পাবার পরে মূল্য পরিশোধের সুব্যবস্থা করতে হবে। সরকার কর্তৃক মনিটরিং সেল গঠন ও নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে। ইন্টারনেটে ব্যবসাকারী সকল কোম্পানির আয়ের হিসাব সরকারের কাছে প্রদর্শন করতে হবে। অনলাইনে পণ্য বিক্রয়কারী সকল প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থা চালু করতে হবে। বিবরণ অনুযায়ী পণ্য না পেলে কিংবা ক্রুটিপূর্ণ পণ্য পেলে তা সহজেই ফেরত নিয়ে পরিবর্তন করে দিতে হবে এবং পণ্য পরিবর্তনের যাবতীয় খরচ বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানকেই বহন করতে হবে। জাতীয় ভোক্তা অধিদপ্তরের কার্যক্রম উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছে দিতে হবে।
উন্নত দেশসমূহ ডিজিটাল বাজার ব্যবস্থার মাধ্যমে ব্যাপকতর উন্নতি লাভ করেছে। সময় ও শ্রম কম দিতে হয় বলে এই খাতে বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। অতিরিক্ত মুনাফা লাভের আশা ত্যাগ করে সেবাদানের মানসিকতা তৈরি করলে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রনয়নের মাধ্যমে ডিজিটাল বাজার ব্যবস্থার আরো জনপ্রিয়তা অর্জন করানো সম্ভব।
লেখক: শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।