Inqilab Logo

সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পরিবেশ সুরক্ষায় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে

সরদার সিরাজ | প্রকাশের সময় : ৫ অক্টোবর, ২০১৯, ১২:০২ এএম

পরিবেশ বাঁচাও, বিশ্ব বাঁচাও, ক্লাইমেট জাস্টিস ইত্যাদি শ্লোগান এখন সর্বত্র উচ্চারিত হচ্ছে। এ শ্লোগানে গত ২০ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশসহ ১৫০টি দেশের তিন লাখের অধিক শিক্ষাঙ্গনের ৪০ লাখ শিশু শিক্ষাঙ্গন ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসে। এর আগে একদিন পশ্চিমা দেশের শিশুরা এরূপ আন্দোলন করে বিশ্ববাসীকে সচেতন করে। এ আন্দোলনের জনক সুইডেনের ১৬ বছর বয়সী কিশোরী গ্রেটা টুনব্যার্গ। সে তার দেশের পরিবেশের ক্ষতি দেখে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠে ২০১৮ সালে। প্রথমে সে একা এ আন্দোলন শুরু করে। সে তার স্কুলের গেটে প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে জানান দেয়, ‘ফ্রাইডেস ফর ফিউচার’। তাতে একে একে শামিল হয় তার দেশের শিক্ষার্থীরা। তারই রেশ ধরে এখন এটা বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে ‘টক অব দি ওয়ার্ল্ড-এ পরিণত হয়েছে। গ্রেটা টুনব্যার্গ তার এই দাবী বিশ্বময় জোরালো করার লক্ষ্যে জাতিসংঘের অধিবেশনের জলবায়ু সম্মেলনে ব্যাপকভাবে আলোচিত হওয়ার জন্য পাল তোলা নৌকায় চড়ে ব্যাপক ঝঞ্জাময় আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যায়। অতঃপর নিউইয়র্কে আন্দোলনরত শিশুদের সমাবেশে জ্বালাময়ী বক্তব্য দেয় ২০ সেপ্টেম্বর। তার বক্তব্যে সে পরিবেশ রক্ষা করতে ব্যর্থ হওয়ার জন্য বিশ্ব নেতাদের কঠোর সমালোচনা করে বলে, ‘হাই ডিয়ার ইউ’। এই অবস্থায় গত ২১ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে এই প্রথমবারের মতো ‘যুব জলবায়ু সম্মেলন’ অনুষ্ঠিত হয়। তাতে ১৪০টিরও বেশি দেশের প্রায় ১ হাজার তরুণ অংশ নেয়। এই তরুণ পরিবেশবাদীরা জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশের পাশাপাশি অতিসত্বর এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য বিশ্ব নেতাদের প্রতি আহ্বান জানায়। এছাড়া, জাতি সংঘের মহাসচিবের উদ্যোগে সংস্থাটির সাধারণ পরিষদের ৭৪তম বার্ষিক অধিবেশনে ‘ক্লাইমেট সামিট’ শুরু হয় গত ২৩ সেপ্টেম্বর। এ সামিটকে অবহিত করতে গত ২২ সেপ্টেম্বর বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা এবং অন্যান্য সংস্থার বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান একত্রিত করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, ‘২০১৫-২০১৯ সাল পর্যন্ত বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা আগের পাঁচ বছরের সময়ের চেয়ে ০.২ ডিগ্রির উপরে বলে অনুমান করা হয়েছে এবং ১৮৫০-১৯০০ সাল পর্যন্ত প্রাক-শিল্প সময়কাল থেকে ১.১ ডিগ্রি উষ্ণ। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করার ফলে শিল্প যুগের শুরুর সময় থেকে আরম্ভ করে এপর্যন্ত সমুদ্রের অ¤øতা ২৬% বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়েছ, মূল জ্বালানি শক্তি হিসেবে এখন পর্যন্ত কয়লা এবং পেট্রোলিয়ামের মতো জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করার ফলে গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ অব্যাহতভাবে বেড়ে চলেছে। তাই সরকারগুলো যদি নিঃসরণ কমানোর প্রতিশ্রুত মাত্রা অর্জন করতে সক্ষম হয় তবুও চলমান পরিস্থিতিতে ২১০০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক গড় উষ্ণতা ৩.৪ ডিগ্রি বৃদ্ধির দিকেই নিয়ে যেতে পারে। জাতিসংঘ মহাসচিবের দফতরের বিবৃতি মতে, এ সামিটে ‘২০৫০ গ্রুপে’ যোগ দিয়েছে ১০টি অঞ্চল থেকে ৬৬টি সরকার, ১০২টি শহর, ৯৩টি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এবং ১২ জন বিনিয়োগকারী। জরুরি জলবায়ু প্রতিযোগিতায় আমরা হেরে যাচ্ছি। কিন্তু এ প্রতিযোগিতায় আমরা জিততে চাই। এই সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে বিশ্বের দেশগুলোকে প্যারিস জলবায়ু চুক্তির শর্ত মানতে রাজি করানো। ইতোমধ্যে ৬৯টি দেশ জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ৬৫টি দেশ ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নির্গমন শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন তো অবুঝ শিশুদের করার কথা নয়। তাদের কাজ শিক্ষা, খেলাধুলো, বিনোদন ইত্যাদি নিয়ে মশগুল থাকা ও ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধশালী জীবন গড়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করার কথা। তবুও তারা তাদের স্বীয় কাজের ফাঁকে রোদ-বৃষ্টিসহ নানা প্রতিকূলতা মাথায় নিয়ে পরিবেশ বাঁচিয়ে ধরিত্রীকে বাসোপযোগী করার জন্য আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। কারণ, তাদের এ কাজটি করার কথা ছিল তাদের অভিভাবক ও বিশ্ব নেতাদের। তারা তা সঠিকভাবে পালন করেনি। বরং বিভিন্নভাবে দূষণ ছড়িয়ে বিশ্বকে বাসের অনুপযুক্ত করে ফেলেছে। ফলে বায়ুমন্ডলের উঞ্চতা বৃদ্ধি অব্যাহতই আছে। তাতে নানা রকমের সংকট বেড়েই চলেছে। স্মরণীয় যে, সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়ে বিশ্বের বহু দেশ পানিতে তলিয়ে কোটি কোটি মানুষ উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে বলে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন অনেকদিন থেকেই। অতি স¤প্রতি বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন, ‘বায়ু দূষণের কারণে গর্ভে থাকা শিশুরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’ এই অবস্থায় কমলমতি শিশুরা বাধ্য হয়েই তাদের নিরাপদ ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার লক্ষ্যেই পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন শুরু করেছে বিশ্বব্যাপী। কারণ, তাদের ভবিষ্যৎ চাঁদ, মঙ্গল ও অন্য গ্রহ-নক্ষত্র হলেও যতদিন পর্যন্ত সেখানে যাওয়া-থাকা না হয়, ততদিন তাদেরকে এ পৃথিবীতেই থাকতে হবে। তাই এটাকে বাসোপযোগী করে গড়ে তোলা ছাড়া বিকল্প নেই তাদের। কারণ, ধরিত্রীর দূষণ রোধ করতে না পারলে তাদের ভবিষ্যৎ ঠিকানা- মহাকাশ, সেটাও দূষিত হয়ে বাসের অনুপযোগী হবে। ইতোমধ্যেই পৃথিবীর দূষণ বিভিন্নভাবে মহাকাশে পৌঁছে সেখানে দূষণ সৃষ্টি করছে বলে বিজ্ঞানীদের অভিমত।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যেসব দেশ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তার অন্যতম বাংলাদেশ। এই ক্ষতির বিশদ বিবরণ ইতোপূর্বে বহুবার আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা প্রকাশ করেছে, যা লোমহর্ষক। যেমন: বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে ঝুঁকিপূর্ণ ১২টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১০ম। জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারে বাংলাদেশের ওপর আইএমএফ’র করা ২০১৯ সালের কান্ট্রি রিপোর্টে বলা হয়েছে, উপকূলীয় অঞ্চলে ভাঙনের ফলে ২০৫০ সাল নাগাদ দেশটি ১৭% ভূমি হারাতে হতে পারে, যার ফলে খাদ্য উৎপাদন ৩০% পর্যন্ত কমে যেতে পারে এবং একই সাথে বসত হারানো মানুষের ভিড়ে শহরে অভিবাসীর সংখ্যাও বাড়বে। তাই বাংলাদেশকে জলবায়ুর ঝুঁকি মোকাবিলা এবং প্রকৃতির বৈরিতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার নীতি গ্রহণ করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা বাংলাদেশকে এখনই মোকাবেলা করতে হচ্ছে। গত ১৯ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত আন্তর্জাতিক পরিবেশ ও উন্নয়ন সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের গ্রামীণ অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে বরাদ্দ ছিল ১.৪৬ বিলিয়ন ডলার। এ সময় এই খাতে আন্তর্জাতিক অর্থায়নের পরিমাণ ছিল বছরে ১৫৪ মিলিয়ন ডলার৷ উক্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, অনেক পরিবারকে খাদ্য কেনার পরিবর্তে বা স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় ব্যয় না করে ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িঘর মেরামত এবং প্রাণী ও ফসল উৎপাদনে অতিরিক্ত ব্যয় করতে হচ্ছে। এই ব্যয় ভবিষ্যতে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে!
বাংলাদেশের পরিবেশ ধ্বংস হওয়ার কারণ যেমন বৈশ্বিক, তেমনি অভ্যন্তরীণও। পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ বর্জ্য দূষণ, বায়ু দূষণ, নদী দূষণ, শব্দ দূষণ, ই-বর্জ্য ইত্যাদি। বায়ু দূষণের কিয়দংশ বৈশ্বিক। কিন্তু বর্জ্য দূষণ ও নদী দূষণের জন্য দায়ী আমরা নিজেরাই। কারণ, এ দেশে আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। ভেরিস্ক ম্যাপলক্রপট প্রণীত ‘ওয়েস্ট জেনারেশন অ্যান্ড রিসাইক্লিং ইনডিসেস ২০১৯: ওভারভিউ অ্যান্ড ফাইন্ডিংস’ শীর্ষক প্রতিবেদন মতে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে মাথাপিছু বর্জ্য উৎপাদনের পরিমাণও বাড়ছে। শুধু রাজধানী ঢাকায় প্রতিদিন প্রায় ৭ হাজার টন বর্জ্য জমা হয়। তন্মধ্যে স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করে রিসাইক্লিং হয় সামান্যই। ফলে মোট উৎপাদিত বর্জ্যরে ৮৯% অব্যবস্থাপনায় পড়ে থাকে বাংলাদেশ। ১৯৪টি দেশের বর্জ্য উৎপাদন ও পুনর্ব্যবহার পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে এ রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে। অথচ দেশের প্রতিদিনের বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ ও জৈব সার উৎপাদন করা সম্ভব। এটা বিভিন্ন দেশেই করা হয়। কিন্তু আমরা তা তো করতে পারছি না, বরং বর্জ্যগুলো যত্রতত্র ফেলে রেখে পরিবেশ ধ্বংস করছি! দ্য ইকোনমিস্টের ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের এ বছরের তালিকা অনুযায়ী বিশ্বে বসবাসের সবচেয়ে অযোগ্য শহরগুলোর মধ্যে ঢাকার অবস্থান তৃতীয়। এ তালিকায় অন্তর্ভুক্তির পেছনে এই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা ও পরিবেশ দূষণের দায়ও কম নয় বলে মনে করেন পরিবেশবিদরা।
নদী-নালা, খাল-বিল, দীঘি-পুকুর, হাওর-বাঁওর ইত্যাদির দেশ বলে পরিচিত ছিল বাংলাদেশ। কিন্তু সে দেশটিই আজ পানির অভাবে মরুভূমিতে পরিণত হতে চলেছে। দীর্ঘদিন সংস্কার না করার কারণে ও ভারত আন্তর্জাতিক অভিন্ন নদীগুলোর ন্যায্য পানি না দেওয়ায় এ দেশের নদীগুলো মরতে মরতে অর্ধেকের বেশি বিলীন হয়েছে। একদা বাংলাদেশে ছোট-বড় সাড়ে ১১শ নদী ছিল। বর্তমানে ৪০৫টি রয়েছে। উপরন্তু বর্তমানে যা আছে, তাও দখল ও দূষিত হয়ে মরণ যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। এ জন্য দায়ী উজানে পানি প্রত্যাহার, অভ্যন্তরে দখল, দূষণ, ভাঙন ও বালু উত্তোলন। এসব সমস্যা দূর করার জন্য ১৯৯৫ সালের আইন, ১৯৯৭ সালের রেগুলেশন, ২০০০ সালের আইন, ২০১০ সালের আইনের সংশোধনী ও ২০১১ সালের রাজনৈতিক অঙ্গীকার আছে। সর্বোপরি, নদী-খাল দখল ও দূষণ রোধে মামলার পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত গত দশ বছরে ৫৬টি আদেশ দিয়েছে। যার কিছু বাস্তবায়ন হয়েছে। বাকিগুলোর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া চলছে। সর্বোপরি গত ১ জুলাই ‘নদীকে জীবন্ত সত্তা’ বলে রায় দিয়েছেন মাননীয় হাইকোর্ট। এছাড়া, প্রধান ৪৮টি নদীর তথ্য ভান্ডার গড়ে তোলা হচ্ছে। এতো কিছুর পরও দেশের নদীগুলো রক্ষা পাচ্ছে না। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সাম্প্রতিক রিপোর্ট মতে, ৬২টি জেলায় ৪৬,৮৩৯ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান দেশের নদীগুলো দখল করেছে এবং তাদেরকে চিহ্নিত করা হয়েছে (প্রকৃতপক্ষে এ সংখ্যা লক্ষাধিক হবে বলে অনেকের অভিমত)। নদীগুলোকে দখলমুক্ত করার জন্য বছরব্যাপী ক্রাশ প্রোগ্রাম নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু নদী খেকোদের দমন করে পুনরুদ্ধার করতে যুদ্ধের প্রস্তুতি লাগার কথা নয়? সদিচ্ছাই যথেষ্ট। ঢাকার চারিদিকের নদীগুলো থেকে দখলদারদের উচ্ছেদের কার্যক্রম চলছে সম্প্রতি। এ ঘটনাই প্রমাণ করে সদিচ্ছা থাকলে নদীগুলোকে দখলমুক্ত করা সম্ভব। তাই প্রস্তুতি বাদ দিয়ে সংশ্লিষ্ট স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হলেই নদীগুলোকে দখলমুক্ত করতে সক্ষম তারা। তদ্রুপ দেশের সব নদীকে দূষণমুক্তও করা সম্ভব এবং তা করা আবশ্যক। কারণ, দেশের নদীগুলো দূষণের দিক দিয়ে বিশ্বের মধ্যে প্রথম কাতারে রয়েছে। ফলে নদীর পানি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। শিল্পের বর্জ্য,অপচনশীল পলিথিন ও প্লাস্টিক সহ নানা বর্জ্যে নদীর পানি দূষিত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানও জড়িত রয়েছে। এতে দেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। এমনকি নদী ও সাগরের প্লাস্টিকের কণা মানুষের শরীরে ঢুকে চরম ক্ষতি করছে বলে বিজ্ঞানীরা স¤প্রতি জানিয়েছেন। তাই যেকোনো মূল্যেই হোক নদীকে দূষণমুক্ত করতেই হবে। সে জন্য প্রতিটি শিল্প-কারখানায় ইটিপি স্থাপন বাধ্যতামূলক করতে হবে। এতে যে প্রতিষ্ঠান ব্যর্থ হবে, সেটা যদি বন্ধ করে দিতে হয়, তাতেও ক্ষতি নেই। কারণ, দূষণকারী শিল্প কারখানার কারণে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হচ্ছে। এছাড়া, সব নদী ও খাল-বিল তথা দেশের সমগ্র পানি কেন্দ্রকে ভালভাবে সংস্কার করা দরকার। তাহলে দেশের নানাবিধ কল্যাণ হবে। সব চেয়ে বেশি কল্যাণ হবে ভারতের সাথে অভিন্ন ৫৪টি আন্তর্জাতিক নদীর ন্যায্য পানি বণ্টন চুক্তি করা। এ জন্য জোর প্রচেষ্টা চালানো আবশ্যক। এ ক্ষেত্রে তিস্তার চুক্তিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। স¤প্রতি নৌ প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, সরকার নদীকে রক্ষা করার জন্য চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছে। এখন দেখা যাক, সেই চ্যালেঞ্জের কি হয়- ‘বাত কি বাত হয়, না কার্যকর হয় যথাশিগগির’।
যেকোনো দেশের পরিবেশ রক্ষার জন্য মোট আয়তনের ২৫% বনভূমি থাকার আন্তর্জাতিক নিয়ম রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে এটা আছে মাত্র ১২%। স¤প্রতি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে জানানো হয়েছে, বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তি দখল করে নিয়েছে বাংলাদেশের ২,৭৯,০৯৬ একর বনভূমি। একটি দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় দেশের আয়তনের ২৫% বনভূমি থাকা দরকার। অথচ বাংলাদেশের রয়েছে মাত্র ১২%। গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচ এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ২০০১-২০১৮ সালের মধ্যে বাংলাদেশের ৩,০০,০৭৮ একর বনভূমি উজাড় হয়েছে। এটি বাংলাদেশের মোট বনভূমির প্রায় ৮%। ঘটনার এখানেই শেষ নয়, দেশে যেটুকু বনভূমি আছে, তাতেও নেই প্রয়োজনীয় বৃক্ষ। প্রতিদিনই লুটেরারা অসংখ্য বৃক্ষ কেটে ফেলছে। কিন্তু তার স্থলে রোপণ করা হচ্ছে না মোটেও। যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ইউনিভার্সিটির গবেষণা রিপোর্ট মতে, ‘বর্তমানে পৃথিবীতে বৃক্ষের সংখ্যা প্রায় ৩ লক্ষ কোটি। দেশ হিসেবে মানুষ পিছু বৃক্ষ রয়েছে: কানাডায় ৮,৯৫৩, রাশিয়ায় ৪,৪৬১, ভুটানে ২,৪১৮, ব্রাজিলে ১,৪৯৪, যুক্তরাষ্ট্রে ৭১৬, ফ্রান্সে ১৮২, নেপালে ১১৯, ব্রিটেনে ৪৭, ভারতে ২৮, আফগানিস্তানে ১২, বাংলাদেশে ৬ ও পাকিস্তানে ৫টি! বিশ্বে প্রতি বছর ১৫ বিলিয়ন বৃক্ষ নিধন হচ্ছে। বিপরীতে মাত্র ৫ বিলিয়ন বৃক্ষ রোপণ করা হচ্ছে বলে গত ২২ সেপ্টেম্বর এক দৈনিকে প্রকাশ। এতে প্রমাণিত হয়, এ দেশে বৃক্ষের অবস্থা বিশ্ব তালিকায় নিচে থেকে দ্বিতীয়। অন্যদিকে, অসংখ্য ইট ভাটা ও কল-কারখানার কালো ধূয়ায় ব্যাপক বায়ু দূষণ হচ্ছে। এভাবে বায়ু দূষণের দিক দিয়ে বাংলাদেশ ডেঞ্জার অবস্থায় পৌঁছেছে। আর এসব কাজ আমরা নিজেরাই করছি। তাই আমাদেরই এই জঞ্জাল পরিষ্কার করতে হবে। অন্য দেশের কেউ এসে এটা পরিষ্কার করে দেবে না। এ জন্য কিছু দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ আবশ্যক। যার অন্যতম হচ্ছে, দখল হয়ে যাওয়া বনভূমিকে অবিলম্বে উদ্ধার করে প্রয়োজনীয় বৃক্ষ রোপণ, বনভূমি রক্ষা করতে ব্যর্থ হওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও দখলকারীদের কঠোর শাস্তি প্রদান, সমগ্র বনভূমিতে গাছ কর্তন বন্ধ করা, দেশের সব ফাঁকা যায়গায় ফলদ ও ভেষজসহ বিভিন্ন বৃক্ষ রোপণ করার জন্য মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা। এছাড়া, আধুনিক ইটভাটা ছাড়া সব ইটভাটা বন্ধ এবং রিসাইক্লিং করা যায় না এমন প্লাস্টিক ও পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধ করা, ই-বর্জ্যরে সুষ্ঠু ব্যবস্থা গড়ে তোলা, নদী ভাঙ্গন রোধ করা, নদী দখল ও দূষণ মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা দরকার। অর্থাৎ পরিবেশ সংক্রান্ত অপরাধীদের বিরুদ্ধে দ্রুত কঠোর অভিযান শুরু করতে হবে এবং তা হতে হবে অতি নিরপেক্ষভাবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন