Inqilab Logo

মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পানিবদ্ধতার দায় নিতে হবে

| প্রকাশের সময় : ৩ অক্টোবর, ২০১৯, ১২:০২ এএম

মঙ্গলবার মাত্র দেড়ঘণ্টার বৃষ্টিতে পুরো ঢাকা শহর আবারো পানিতে তলিয়ে গেল। বৃষ্টির পর শহরের প্রায় সবগুলো গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা ও ব্যস্ততম বাণিজিক এলাকা হাটু সমান পানিতে তলিয়ে যাওয়ার চিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উঠে আসে। অফিস ও কর্মস্থল থেকে ঘরে ফিরে যেতে লাখ লাখ মানুষকে অস্বাভাবিক দুর্ভোগে পড়তে হয়। প্রায় প্রত্যেক এলাকার ভুক্তভোগীদের কেউ না কেউ পানিবদ্ধতার ছবি ও ভিডিও ধারণ করে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছেন। মূলধারার গণমাধ্যমগুলো ঢাকার পানিবদ্ধতা এবং জনদুর্ভোগের সংবাদ প্রচার করেছে। চলতি বছরে সম্ভবত এটাই ছিল ঢাকায় সবচেয়ে প্রকট পানিবদ্ধতার চিত্র। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বছরে বেশ কয়েকবার এমন পানিবদ্ধতায় চরম দুর্ভোগের শিকার হতে হচ্ছে নগরবাসিকে। কখনো কখনো শহরের প্রাণকেন্দ্রে রাস্তায় পানি জমে গাড়ী চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ার পর সেখানে নৌকা নামাতেও দেখা গেছে। প্রতিটি প্রশ্বস্ত রাস্তা যেন একেকটা খরস্রোতা নদী। আর সংকীর্ণ গলিপথ ও সুয়্যারেজ লাইনগুলো যেন একেকটা মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়। নর্দমার ময়লা-জঞ্জাল এবং বৃষ্টির পানি একাকার হয়ে পরিবেশ হয়ে উঠে নারকীয়। বছরের পর বছর ধরে ঢাকাবাসিকে এ অভিজ্ঞতা পোহাতে হচ্ছে। আমাদের ভূ-প্রকৃতি, আবহাওয়া ও জলবায়ুর বাস্তবতায় টানা বৃষ্টিপাত, ভারী বৃষ্টিপাত উজানের ঢল কোনো নতুন বা আকষ্মিক বিষয় নয়। আমাদের নগর পরিকল্পনা এবং বাস্তু ব্যবস্থাপনা সে নিরীখেই নির্ধারিত হওয়ার কথা। মাত্র এক-দেড়ঘন্টার বৃষ্টিপাতে দেশের রাজধানী শহর পানিতে তলিয়ে অচল হয়ে পড়ার বাস্তবতা থেকে উত্তরণে কোনো পথই দেখা যাচ্ছে না। উপরন্তু যতই দিন যাচ্ছে ঢাকায় পানিবদ্ধতা ক্রমে নাজুক আকার ধারণ করছে।
ঢাকার রাস্তায় পানিবদ্ধতা নিরসনে গত এক দশকে শুধুমাত্র ঢাকা ওয়াসার তরফ থেকে ৫২৩ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে বলে গতকাল প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানা যায়। অর্থাৎ বছরে গড়ে ৫ কোটি টাকা ব্যয় করেও পানিবদ্ধতা নিরসনে কোনো ইতিবাচক ফল পাওয়া যায়নি। দিন দিন অবস্থা খারাপ হচ্ছে। দু’তিন বছর আগেও যেখানে এক ঘন্টায় ৫০ মিলিমিটার বৃষ্টি হলেও এমন পানিবদ্ধতা দেখা যেত না, সেখানে মঙ্গলবার ৩৫মিলিমিটার বৃষ্টিপাতেই ভয়াবহ জলাবদ্ধতা দেখা গেল। মাঝারি মাত্রার বৃষ্টিপাতেই যদি এ অবস্থা হয়, দিনব্যাপী ভারী বৃষ্টিপাত হলে অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা সহজেই অনুমেয়। সমুদ্রোপক’লে বিরূপ আবহাওয়ার প্রেক্ষাপটে আরো কয়েকদিন মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টিপাতের আভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর। বর্ষা পেরিয়ে শরতের শেষ প্রান্তে এসে এমন বর্ষণ অস্বাভাবিক হলেও কোনো বিরল ঘটনা নয়। আবহাওয়ার পরিবর্তন মেনেই আমাদের প্রাত্যহিক জীবন যাত্রা এবং নগর কর্তৃপক্ষকে নাগরিক জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করতে হবে। গত বর্ষাও তেমন ভারী বৃষ্টিপাত হয়নি। এ কারণে পানিবদ্ধতার চরম দুর্ভোগে পড়তে হয়নি। তবে সামান্য বৃষ্টিপাতেই এমন অচলাবস্থা সে সময়ও দেখা গেছে। স্যুয়ারেজ লাইন ও পানিবদ্ধতা নিরসনে শত শত কোটি টাকা ব্যয় করেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। এহেন বাস্তবতায় ঢাকার ড্রেনেজ সিস্টেম বা পয়ো:ব্যবস্থাপনা, পানিবদ্ধতা ও বন্যা নিরোধে দীর্ঘ মেয়াদী, টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব কর্মসূচি ও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে।
ঢাকা উত্তরের সাবেক মেয়র আনিসুল হক ২০১৭ সালে এক সেমিনারে ঢাকা ড্রেনেজ ব্যবস্থাকে বিকলাঙ্গ-ক্যান্সার রোগীর সাথে তুলনা করেছিলেন। সেই সেমিনারের বক্তারা ঢাকার ডেনেজ সিস্টেমকে একদিকে আধুনিক অন্যদিকে পুরনো খাল ও নদী-নালার সাথে সমন্বিত করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে নগর পরিকল্পনাবিদরা দীর্ঘদিন ধরেই শহরের খাল উদ্ধার, এখনো টিকে থাকা খালগুলোর সংস্কার, উন্নয়ন এবং নদীগুলোর প্রবাহের সাথে সংযুক্ত করার উপর তাগিদ দিয়ে আসছেন। সেই সাথে নদীদখল ও ভরাট, শহরের চারপাশের নিম্নভ’মি, জলাভ’মি দখল ও ভরাটের বেআইনী অপতৎপরতা রোধের কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া খুবই জরুরী বিষয় হলেও সরকারের পক্ষ থেকে তেমন কোনো শক্ত অবস্থান দেখা যায় নি। সরকারের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় একশ্রেণীর ভ’মিদস্যু, আবাসন প্রকল্পের নামে শত শত একর নিম্নভ’মি দখল ও ভরাট করে ঢাকা শহরের জন্য প্রাকৃতিক ও পরিবেশগত বিপর্যয় সৃষ্টি করেছেন। এসব ক্ষেত্রে দৃষ্টি না দিয়ে জলাবদ্ধতা নিরসন ও তথাকথিত উন্নয়নের নামে বছরে শত শত কোটি টাকার মচ্ছব-অপচয়-লুটপাট করা হয়েছে। সেই সাথে উন্নয়নের নামে যখন তখন রাস্তা খোঁড়াখুড়ি করে মাসের পর মাস ধরে ফেলে রেখে জনদুর্ভোগ অসহনীয় করে তোলা হয়েছে। একইভাবে দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী ও বন্দর নগরী চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনে গত ১৭ মাসে ৫৭৫ কোটি টাকা ব্যয় করেও কোনো সুফল পাওয়া যায়নি। ঠেকায় পড়ে এড-হক ভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে দীর্ঘমেয়াদে কার্যকর কোনো সুফল পাওয়া যায় না। এর জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি, সমন্বিত ও পরিবেশবান্ধক পরিকল্পনা। সেই সাথে নগরীর সুয়্যারেজ লাইনগুলো কাদামাটি ও ময়লা-আবর্জনায় বন্ধ হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে হবে। শহরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় স্যুয়ারেজলাইনগুলোর পরিচ্ছন্নতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন