পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে আদালত কক্ষে কোনো আসামিকে হাজির করা যাবে না বলে উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত রয়েছে। তবে নিরাপত্তার স্বার্থে কারাগার থেকে আদালতে আনা-নেয়ার সময় ডান্ডাবেড়ি পরানো যাবে বলে মত দিয়েছেন আদালত। বিচারপতি ওবায়দুল হাসান এবং বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট ডিভিশন বেঞ্চ ১৪ মার্চ’ ২০১৭ এ আদেশ প্রদানের পর তৎকালীন ডিআইজি প্রিজন মো. তোহিদুল ইসলাম আসামিদের ডান্ডাবেড়ি পরানোর ঘটনায় নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেন। পরে আদালত তাকে সতর্ক করে অব্যাহতি দেন।
বাংলাদেশের সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বাধ্যতামূলক কার্যকরতা সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, আপিল বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত আইন হাইকোর্ট বিভাগের জন্য এবং সুপ্রিম কোর্টের যে কোনো বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত আইন অধঃস্থন সকল আদালতের জন্য অবশ্য পালনীয় হবে।
এবার আসল কথায় আসি। আমাদের সংবিধানে স্পষ্ট বলা আছে, ‘কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেয়া যাবে না কিংবা নিষ্ঠুর অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দন্ড দেয়া যাবে না কিংবা কারো সঙ্গে কোনোরূপ নির্দয় আচরণ করা যাবে না। সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। আইনানুযায়ী ছাড়া জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতা থেকে কোনো ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাবে না কিংবা কোনো ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে এমন কাজ করা যাবে না। আইনসম্মত নিরপেক্ষ আদালত কর্তৃক প্রকাশ্য বিচার ব্যতিত কাউকে কোনো ধরনের শাস্তি দেওয়া যাবে না।’
আমরা সবাই জানি, একটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইনগ্রন্থ সে দেশের সংবিধান। পাঠকের কাছে প্রশ্ন, সে সংবিধান লংঘন করে পুলিশ কি কাউকে মারধর করার অধিকার রাখে? অথবা জেলখানার মধ্যে বন্দিদের শায়েস্তা করার জন্য যখন-তখন ডান্ডাবেড়ি কিংবা আড়ুয়াবেড়ি পরিয়ে রাখতে পারে? এ পর্যায়ে পাঠকের জ্ঞাতার্থে ডান্ডাবেড়ি কিংবা আড়ুয়াবেড়ি কি সে সম্পর্কে আলোকপাত করা দরকার।
বাংলাদেশের কারাগারে বন্দিদের শাস্তির জন্য ডান্ডাবেড়ি এবং আড়ুয়াবেড়ি নামে দুটি লোহার যন্ত্রের মাধ্যমে শাস্তির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ডান্ডাবেড়ি হচ্ছে বন্দি বা বিচারাধীন অভিযুক্ত ব্যক্তির পায়ে মোটা লোহার রিং পরিয়ে তাতে শেকল এঁটে তা ওই বন্দির হাতে ধরিয়ে দেয়া। জেল কর্তৃপক্ষের নির্দিষ্ট করে দেওয়া সময় পর্যন্ত তাকে এটি পরে থাকতে হয়। ওঠা, বসা, হাঁটা, চলা, ঘুমানো সবই এ বেড়ি পরেই করতে হয় ওই বন্দির।
আর আড়ুয়াবেড়ি হচ্ছে যারা কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিতে অবাধ্য তাদেরকে দু’পায়ে রিংয়ের সাথে একটি এক ফুট লম্বা লোহার রড লাগিয়ে দেয়া হয়। এর ফলে বন্দি দু’পা একত্রে করতে পারে না। তাকে হাঁটতে হয় দু’পা ফাঁক করে, ঘুমাতে হয় চিৎ হয়ে বা উপুড় হয়ে। প্রিয় পাঠক, এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন শাস্তির নামে, বিচারের নামে কি বর্বর নির্যাতন চলে মানুষের ওপর।
এবার আসি ডান্ডাবেড়ি এবং আড়ুয়াবেড়ি বিষয়ে আইনে কি বলা আছে। জেলের ভেতর কেউ অপরাধ করলে তার নিষ্পত্তির নিয়ম রয়েছে জেল কোডের ১৯ নং অধ্যায়ে। এ অধ্যায়ের ৭০৮ নং বিধান অনুযায়ী, জেলের মধ্যে কেউ অপরাধ করলে জেল সুপারিনটেনডেন্ট ১১ ধরনের লঘু ও ১১ ধরনের গুরুতর শাস্তি দিতে পারেন। গুরুতর শাস্তির মধ্যে রয়েছে সকল বন্দির থেকে আলাদা করে কাউকে ৭ দিনের জন্য কোনো সেলে আটক রাখা, ৩০ দিনের জন্য ডান্ডাবেড়ি পড়ানো ইত্যাদি। অপরাধী সাব্যস্তকরণের কোনো সাবলীল নিয়ম নেই। কর্তার ইচ্ছায় এখানে কর্ম হয়। সুপারিনটেনডেন্ট সাহেব যাকে অপরাধী মনে করবে, তিনিই অপরাধী হবেন। আবার জেলের মধ্যে হাজার অপরাধ করলেও অপরাধ হবে না।
তবে জেল কোডের ৭০৮ নং বিধান অনুযায়ী বিচারাধীন আসামি বা রাজবন্দিদের এধরনের গুরুদন্ড দেয়া যায় না। কারণ ৭০৮ নং বিধানটি কেবল আদালতে সাজাপ্রাপ্তদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কিন্তু আমাদের সংবিধান যেখানে মানুষকে নির্মম ও হিংস্র শাস্তি দানের বিপক্ষে সেক্ষেত্রে কিছু কিছু ক্যাটাগরির জেল বন্দির হাতকড়া এবং ডান্ডাবেড়ি পরানো সম্পূর্ণ সংবিধান বিরোধী।
জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ কারাবন্দিদের জন্য রাষ্ট্রের তরফ থেকে অনুসৃত যে নূন্যতম নীতিমালা তৈরি করেছে সেখানকার ৩৩ নং অনুচ্ছেদে ডান্ডাবেড়ি পরানোকে অমানবিক বলা হয়েছে। বাংলাদেশে কিন্তু স্রফে বন্দিদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের জন্যও ডান্ডাবেড়ি পড়ানোর অভিযোগও রয়েছে। সাধরণত, একসঙ্গে ৩টি মামলার আসামি হলে তাকে কোর্টে নেয়া হয় ডান্ডাবেড়ি পড়িয়ে। এখানেও আছে বৈষম্য। ৩ মামলা কেন ৩০ মামলার অভিযুক্ত বা অপরাধী রাজনৈতিক ব্যাক্তিদেরকে বেশিরভাগ সময় জামাই আদরেই আনা-নেওয়া করা হয় কোর্টে। কারাগারেও জামাই আদরেই থাকেন তারা।
ন্যায়বিচার এমন একটি শব্দ, যার সাথে কিছু বিষয় এত নিবিড় ও গভীরভাবে জড়িত যে, এর যেকোন একটির কোনো রকম ব্যত্যয় ঘটলে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয় না। মার্কিন মানবতাবাদী মার্টিন লুথার কিং বলেছেন, ‘যে কোনো জায়গায় অবিচার ঘটলে তা সমস্ত জায়গার বিচারকে হুমকির মুখে ফেলে। ফরাসী দার্শনিক আঁনাতোলে ফ্রান্স বলেছেন, আইন যদি সঠিক হয় তাহলে মানুষও ঠিক হয়ে যায় কিংবা ঠিকভাবে চলে। আমাদের বিচার ব্যবস্থায় বিদ্যমান চরম দূরাবস্থায় এ দু’টি উক্তি চরমভাবে প্রণিধানযোগ্য।
পৃথিবীতে এমন কোনো সভ্যতা খুঁজে পাওয়া যাবেনা যেখানে আইনের বিকাশ হয়নি। সভ্যতা বিকাশের সাথে সাথে ‘আইন’ ধারণাটিরও ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। পরিবর্তিত সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে না পারলে আইন তার কার্যকারীতা হারায়। প্রয়োজন হয় সে আইনকে সময় উপযোগী করে তোলা। গঠনমূলক সমালোচনার মধ্যেই আইন তার অস্তিত্বের সন্ধান পায়। দুঃখের সাথে বলতে হয়, আমাদের পুরো আইনব্যবস্থায় রয়েছে বৃটিশদের শঠতার ছোঁয়া। বৃটিশরা তাদের দুষ্কর্ম ঢাকতে আইন ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। তৎকালীন ভারতবর্ষের গভর্নর জেনারেল ১৭৭২ সালে আইন ব্যবস্থার গোড়াপত্তন করে তিনিই সর্বপ্রথম আইন ভঙ্গ করেন। তার অধঃস্থন কর্মচারী জার্মান চিত্রশিল্পীর পরমা সুন্দরী স্ত্রীকে দাঁড়িপাল্লায় বসিয়ে স্বর্ণের দামে খরিদ করেছিলেন। আজকের আদালতে ব্যবহৃত ন্যায় বিচারের প্রতীক দাঁড়িপাল্লাকে তিনিই প্রথম অনৈতিক কাজে ব্যবহার করেন। মূলত ব্রিটিশরা আইন তৈরি করেছিল শাসন-শোষণের জন্য, দরিদ্র কৃষকের জমির খাজনা আদায়ের জন্য কিংবা প্রজাকে কাচারীতে ধরে নিয়ে মারধর, হাত-পা বেঁধে আঁধার কুঠুরিতে ফেলে রাখা, প্রজার স্ত্রী-কন্যাকে বন্ধক হিসেবে আটক রাখা, বিষয় সম্পত্তি ক্রোক করা এবং ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করা। ডান্ডাবেড়ির অমানবিকতা এখনও তার উত্তরাধিকার বহন করছে মাত্র।
প্রিয় পাঠক! আসুন আমরা একটি ইতিবাচক সংবাদের অপেক্ষায় থাকি। যেদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে পত্রিকার পাতায় দেখতে পাবো ‘ শুধু আদালতে নয় সকল স্তরে উচ্চ আদালত ডান্ডাবেড়ি ও আড়ুয়াবেড়ি পরানোকে নিষিদ্ধ করেছে’ সেদিন আমাদের সংবিধানের শ্বাশত বাণী চিরন্তন রূপ পাবে।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী
আইন গ্রন্থ প্রণেতা
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।