পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
যখন এই কলামটি লিখছি তখন রবিবার। কলামটি প্রকাশিত হবে মঙ্গলবার। আমি ধারণা করছি যে, মঙ্গলবারের মধ্যেই ক্যাসিনো মুঘল ইসমাইল হোসেন সম্রাট গ্রেফতার হবেন। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় যে, তিনি আগেই গ্রেফতার হয়েছেন। সরকার কৌশলগত কারণে তার গ্রেফতারের খবর ডিসক্লোজ করেনি। সেটা যদি সত্য না হয় তাহলে আজ রবিবার দুপুর পর্যন্ত তিনি গ্রেফতার হননি কেন সেটি আমাদের বোধগম্য নয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামাল এসম্পর্কে যে বক্তব্য রেখেছেন সেটা খুব হেয়ালি পূর্ণ। তিনি বলেছেন যে, আপনারা দু’ একদিনের মধ্যেই জানতে পারবেন যে, সম্রাট গ্রেফতার হয়েছে কিনা। এর আগের দিন তিনি বলেছেন, সম্রাট গোয়েন্দা নজরদারিতে আছেন। দু’ একটি দৈনিক পত্রিকা আজ রবিবার লিখেছে যে, ইসমাইল হোসেন সম্রাট মুহূর্তে মুহূর্তে তার আস্তানা পরিবর্তন করছেন। তবে তার প্রতিটি মুভমেন্ট গোয়েন্দা নজরদারির রাডারের মধ্যে রাখা হয়েছে । আমরা বুঝতে পারি না, বিষয়টি নিয়ে এত হেঁয়ালি কেন? যদি প্রতি মুহূর্তে তিনি গোয়েন্দা নজরদারিতে থাকেন তাহলে তাকে গ্রেফতার করা হয় না কেন? এর আগে সংবাদপত্রের রিপোর্ট অনুযায়ী ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিনি কাকরাইলে তার অফিসেই ছিলেন। তবে কয়েক শত সমর্থক এবং কয়েকজন দেহরক্ষী পরিবেষ্টিত অবস্থায় ছিলেন। ৭ দিন তিনি এক জায়গায় থাকলেন, অথচ তাকে ধরা হলো না। যেসব সমর্থক পরিবেস্টিত হয়ে তিনি ছিলেন তারা কি এক ব্যাটালিয়ান র্যাবের মুখোমুখি হওয়ার সাহস পেতো? অথচ পত্রিকার রিপোর্ট মোতাবেক তাকে সেখান থেকে বের হওয়ারও সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। তিনি যখন বের হয়ে যান সেটিও নাকি গোয়েন্দাদের নজরে ছিল। এতকিছুর পর তাকে গ্রেফতার না করায় বিষয়টিতে হেঁয়ালিই থেকে যায়। তাই আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, তিনি হয়তো ইতোমধ্যেই পুলিশের কাস্টোডিতে আছেন। এই কলাম লেখার সময় বেলা দেড়টার দিকে দু তিনটি পত্রিকার অন লাইন এডিশনে স্পষ্ট ভাষায় হেডিং দেওয়া হয়েছে, ইসমাইল হোসেন সম্রাট গ্রেফতার হয়েছেন। তিনি পুলিশের হেফাজতে আছেন।
গত ৫/৬ দিন ধরে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, ক্যাসিনো বিরোধী অভিযান যেন তার গতি হারিয়েছে। ঢাকার একটি বাংলা দৈনিক মোতাবেক, ১১ দিনে (২৯ সেপ্টেম্বর) ৩৫ টি অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। এর মধ্যে র্যাব করেছে ১৮টি এবং পুলিশ করেছে ১৭টি। এই অভিযানে যা উদ্ধার হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে ৭ কোটি ২৫ লাখ ৯৮ হাজার টাকা, ১১টি অস্ত্র এবং ৭২০ ভরি সোনা। এছাড়া ১৬৫ কোটি টাকার এফডিআর। ৯ হাজার ডলার, ৭৫২ সিঙ্গাপুরী ডলার, ৫ লাখ টাকা মূল্যের মার্কিন ডলার, ২০ হাজার টাকার জাল নোট। গ্রেফতার হয়েছেন ৩ জন। তাদের মধ্যে যুবলীগের ২জন এবং কৃষকলীগের ১ জন। রবিবার থেকে যে অভিযান পরিচালিত হবে বা হচ্ছে সেই অভিযান থেকে পুলিশকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এখন শুধু র্যাবই এই অভিযান পরিচালনা করবে।
ওপরের এই সংক্ষিপ্ত তালিকা থেকে বিশেষ করে গ্রেফতারের তালিকা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, গ্রেফতারের তালিকায় উচ্ছসিত হওয়ার কিছুই নাই। গ্রেফতার হয়েছেন যুবলীগের দুই জন মধ্যম স্তরের নেতা এবং কৃষক লীগের একজন মধ্যম স্তরের নেতা। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের খুব হাঁক ডাক করে বলেছেন যে, অপরাধী যেই হোক না কেন, কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। এমনকি অপরাধী যদি আওয়ামী লীগেরও হয় তবুও তাকেও ছাড় দেওয়া হবে না। কিন্তু তার কথার সাথে কাজের কোনো মিল নাই। পুলিশ ইন্সপেক্টর সাইফ আমিন লিখিতভাবে অভিযোগ করেছেন যে আওয়ামী লীগের এমপি শামসুল হক চৌধুরী বিগত ৫ বছরে জুয়ার টাকা থেকে ১৮০ কোটি টাকা গ্রহণ করেছেন। ইন্সপেক্টর সাইফ আমিন এই অভিযোগটি করে নিজের পায়ে কুড়াল মেরেছেন। অভিযোগটি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর তাক সাসপেন্ড করা হয়েছে বা সাময়িকভাবে কর্ম বিরত রাখা হয়েছে। অথচ যার বিরুদ্ধে এত গুরুত্বর অভিযোগ, তাও আবার লিখিত, তার কেশাগ্রও স্পর্শ করা হয়নি।
ইন্সপেক্টর সাইফ আমিনকে সাসপেন্ড করার পর আওয়ামী লীগের স্থানীয় প্রভাবশালী ও প্রবীণ নেতা দিদারুল আলম চৌধুরীও শামসুল হক চৌধুরীর বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন। এই অভিযোগ আনার পর এমপির পুত্র শারুন চৌধুরী দিদারুলের বিরুদ্ধে মহা ক্ষিপ্ত হয়েছেন। টেলিফোনে তিনি দিদারুল আলমকে এই মর্মে হুমকি দিয়েছেন যে, রাস্তায় বের হলে তার দাঁত এবং চোঁয়াল ভেঙে দেওয়া হবে। তিনি আরও বলেছেন যে, দিদারুল আলমের কাপড় চোপড় খুলে নেওয়া হবে। ক্ষিপ্ত এমপি পুত্র তার অটোমেটিক রাইফেল থেকে তিন রাউন্ড গুলি ছুঁড়েছেন। দেখতে অনেকটা এক-৪৭ এর মতো রাইফেল তাক করে আছেন শারুন চৌধুরী, সেই ছবি ঢাকার একটি পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। যেখানে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারি সেতুমন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগের আর বড় বড় নেতা গলা সপ্তমার্গে চড়িয়ে বলছেন যে, আওয়ামী লীগের কেউ দুর্নীতি করলে তাকেও ছাড়া হবে না সেখানে শামসুল হক চৌধুরীকে স্পর্শ না করার কারণটি বোধগম্য নয়। শামসুল হকের পুত্র যে অস্ত্রবাজি করেছেন তার বিরুদ্ধেও এখন পর্যন্ত কোনো এ্যাকশন নেওয়া হয়নি। তাই অনেকে সন্দেহ করেন যে, ক্যাসিনো বা জুয়া বিরোধী এবং সেই সাথে ঢক্কানিনাদে উচ্চারিত দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়ন বিরোধী অভিযান কি অবশেষে বজ্র আঁটুনী ফসকা গেরোতে পরিণত হতে যাচ্ছে?
দুই
এই ধরনের মন্তব্য করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। আমরা এখানে বিভিন্ন পত্রপত্রিকার কয়েকটি শিরোনাম তুলে দিচ্ছি। এই শিরোনাম গুলোই বলবে আমাদের আশঙ্কা ভিত্তিহীন কিনা। ২১ সেপ্টেম্বর দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পৃষ্ঠায় যে দুইটি সংবাদ শিরোনাম ফলাও করে দেওয়া হয়েছে তার একটি হলো, ‘অর্ধ শতাধিক গড ফাদার ধরতে অভিযান’। অপর শিরোনাম হলো, ‘ খালেদের মুখে ৫০ নাম, বিস্মিত পুলিশ অফিসার!’। এই খবর পড়ে জনগণের মনে প্রশ্ন, কারা এই ৫০ জন গডফাদার? পুলিশ অফিসাররা বিস্মিত হবেন কেন? যদি হয়েও থাকেন তাহলে এই ৫০ জনের নাম বের করা তাদের পক্ষে কি এতই কঠিন কাজ? জনগণ কিন্তু ঐ ৫০ জনের নাম জানতে চায়।
২০ সেপ্টেম্বর ইংরেজি ডেইলি স্টারের প্রথম পৃষ্ঠার শিরোনাম, Police were their close neighbors/ Only a boundary wall separated two casinos and police barracks in Motijheel. একই দিন ইংরেজি ডেইলি নিউ এজের শিরোনাম, Sports clubs claim they are hostage to politicians. ডেইলি স্টারের শিরোনামের অর্থ হলো, ‘পুলিশ ছিলো তাদের নিকট প্রতিবেশি। মতিঝিলে একটি মাত্র সীমানা প্রাচীর দুইটি ক্যাসিনো এবং পুলিশ ব্যারাককে পৃথক করেছিল’। নিউ এজের শিরোনামের বাংলা অর্থ হলো, ‘ স্পোর্টস ক্লাব গুলি দাবি করছে যে, তারা রাজনীতিবিদদের নিকট জিম্মি ছিলো’।
এখানে যেসব জ্বলন্ত প্রশ্নের উদয় হয় সেগুলি হলো, যেখানে ক্যাসিনো এবং পুলিশ ব্যারাকের মধ্যে ব্যবধান একটি সীমানা প্রাচীর মাত্র, অর্থাৎ অতি নগণ্য সেখানে, ১০ বছর হলো জোরসে মদ, জুয়া ও অন্যান্য অনৈতিকতার আসর চলছে, যেখানে প্রতি রাতে কোটি কোটি টাকার জুয়া খেলা হচ্ছে কিভাবে? যেখানে প্রতিরাতে অসংখ্য গাড়ি এসে ভিড় করছে, সেখানকার খবর পুলিশ ১০ বছর ধরেও জানতে পারলো না? এই কথা কি কেউ বিশ্বাস করবে? আমরা ব্যক্তিগতভাবে ঐ এলাকায় খোঁজ নিয়েছি। ফকিরের পুল বাজারের সাধারণ দোকানদার এবং টিএনটি কলোনীর সাধারণ বাসিন্দাও জানেন যে সেখানে কি চলছে। অথচ, পুলিশ জানলো না। এটা হতে পারে না। তাই পুলিশ কেন জানেনা সেটিরও তদন্ত হওয়া উচিত।
তিন
নিউ এজের রিপোর্ট মোতাবেক, র্স্পোটস ক্লাবের কর্মকর্তারা বলেছেন যে, তারা রাজনীতিবীদদের কাছে জিম্মি ছিলেন। কারা এই কর্মকর্তা? আর কারা এই রাজনীতিবিদ? দেরি না করে অবিলম্বে এসব প্রশ্নের তদন্ত করতে হবে এবং দায়ী ব্যক্তিদেরকে আইনের আওতায় এনে উপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে।
দৈনিক প্রথম আলো ২০ সেপ্টেম্বর আরও গুরুত্বর অভিযোগ করেছে। তারা বলেছে যে, পুলিশ পাহারায় চলতো জুয়া খেলা। পুলিশের বিরুদ্ধে এই অভিযোগটি একেবারে সরাসরি। পুলিশের কোন্ কোন্ অফিসার এবং কোন্ কোন্ কনস্টবলের পাহারায় এই কোটি টাকার জুয়া খেলা চলতো সেটি তদন্ত করে বের করতে হবে এবং দোষী পুলিশ অফিসার এবং পুলিশ কনস্টবলকে শাস্তি দিতে হবে।
২১ সেপ্টেম্বর দৈনিক যুগান্তরে আরও গুরুত্বর অভিযোগ প্রকাশিত হয়েছে। অভিযোগের শিরোনাম, ‘সাবেক এক মন্ত্রীকে ঘুষের টাকা দিতেন বস্তা ভরে। এটি অত্যন্ত গুরুতর একটি অভিযোগ। ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আওয়ামী লীগের কেউ যদি এর মধ্যে জড়িত থাকে তাকেও ছাড়া হবে না। এখন যুগান্তর সরাসরি মন্ত্রীর বিরুদ্ধে ঘুষের টাকা নেওয়ার অভিযোগ উত্থাপন করেছে। কে এই মন্ত্রী? আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতারা মুখে যা বলছেন সেটা যদি মিন করে থাকেন তাহলে এই মন্ত্রীকে খুঁজে বের করতে হবে এবং শুধুমাত্র তার মন্ত্রীত্ব খারিজ করলেই চলবে না তার বিরুদ্ধে অন্যান্য আইনগত ব্যবস্থাও গ্রহণ করতে হবে।
যারা জুয়া খেলেছে, জুয়ার টাকা ভাগাভাগি করে খেয়েছে, তাদেরকে তো ধরতেই হবে, সেই সাথে জুয়ার মেশিনগুলো কিভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করলো সেগুলোও তদন্ত করে বের করতে হবে এবং যেসব ব্যক্তিরা অবৈধভাবে এসব সমাজ ধ্বংসী কাজে নেপথ্য থেকে মদদ দিয়েছে তাদেরকে পাকড়াও করতে হবে।
বাংলাদেশ প্রতিদিন গত ২৪ সেপ্টেম্বর রিপোর্ট করেছে যে, বেপরোয়া ক্যাসিনো এবং জুয়ার বিরুদ্ধে ২০১৭ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পুলিশকে এ্যাকশন নিতে বলেছিলো। গতকাল দৈনিক প্রথম আলো এই খবরটি সমর্থন করে আর একটি নিউজ ছেপেছে। যিনি যতই এই বিষয়ে ঢাক ঢাক গুড় গুড় পলিসির আশ্রয় নিন না কেন, সত্যকে কোনোদিন চাপা দেওয়া যায় না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পুলিশকে যে চিঠি দিয়েছে তার ফটোকপিও ছাপা হয়েছে। এখন পুলিশ আড়াই বছর ধরে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করলো না কেন? এতে স্পষ্ট হয় যে, চোরের স্বাক্ষী গাঁট কাটা। সরকার যদি প্রমাণ করতে চায় যে এব্যাপারে তারা সিরিয়াস, যদি তারা এব্যাপারে জনগণের আস্থা অর্জন করতে চায়, তাহলে কারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চিঠিকে অবজ্ঞা করেছে তাদেরকে খুঁজে বের করতে হবে এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। আরো অনেক কথা বলার ছিলো। একদিনে একটি কলামে সব কথা বলা সম্ভব হচ্ছে না। বারান্তরে প্রয়োজন হলে এবিষয়ে আরো লিখবো, ইনশাআল্লাহ। ততো দিনে যেসব এ্যাকশন নেওয়ার কথা বলা হলো সেগুলো নেওয়া হোক। না নিলে জনগণ ধারণা করতে বাধ্য হবে যে, যত গর্জে তত বর্ষে না।
Email: journalist [email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।