Inqilab Logo

সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

প্রবীণদের যথাযথ সম্মান মর্যাদা ও সুরক্ষা দিতে হবে

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ১ অক্টোবর, ২০১৯, ১২:০২ এএম

আজ পহেলা অক্টোবর। আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস। বয়োজ্যেষ্ঠদের জন্য অত্যন্ত আনন্দের এবং গুরুত্বপূর্ণ দিবস। জাতিসংঘের আহ্বান অনুসারে বিশ্বজুড়ে এই দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস’ হিসাবে উদযাপন করা হয়। বার্ধক্যে উপনীত হওয়া একজন মানুষের জীবনে খুব স্বাভাবিক পরিণতি। এই বয়োজ্যেষ্ঠদের কথা মনে রেখে এমন এক সমাজ গঠন করা উচিত, যেখানে সকল বয়সের মানুষের হবে সমানাধিকার, যে সমাজ বয়স্কদের অসুস্থ ও অবসর প্রাপ্তের দৃষ্টিভঙ্গিতে না দেখে বরং ‘প্রগতির প্রতিনিধি’ হিসাবেই দেখবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আরও একটা দিক ভেবেছে-‘সক্রিয় বয়স্কতা’ (Active ageing)) অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা। এটা ভেবেই বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি পরিবার, সমাজ এবং সরকারের কর্তব্য ও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করাই হচ্ছে এই দিবস পালনের মূল উদ্দেশ্য। ১৯৯১ সাল থেকে বিশ্বজুড়ে এই দিবস উদযাপিত হয়। সারাবিশ্বের সমস্ত বলিষ্ঠ নাগরিকরা নিরোগ দেহ ও মনের অধিকারী হয়ে ভালো থাকুন। স্বভূমে নিজ নিজ পরিবারে স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং আপনজন পরিবেষ্টিত হয়ে সতেজ ও স্নিগ্ধতায় দিন অতিবাহিত করুন, আমাদের আন্তরিক কামনা এটুকুই। বিভিন্ন সমীক্ষায় রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ছয় শতাংশ প্রবীণ ব্যক্তি আছেন। আগামী ২০৫০ সালে জাতিসংঘের সমীক্ষা অনুসারে বাংলাদেশের বায়োজ্যেষ্ঠদের বৃদ্ধির সংখ্যা দাঁড়াবে মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ অর্থাৎ দেশের প্রতি ৫ জনের মধ্যে ১ জন হবেন প্রবীণ। চীনেও একই অবস্থা হবে। ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ এজেয়িং-এর সা¯প্রতিক রিপোর্ট অনুযায়ী আগামী দশকে এই দেশটিতেই বয়স্কদের সংখ্যা বেশী বৃদ্ধি পাবে। সংস্থাটির ‘ডিভিশন অফ বিহেভিয়র অ্যান্ড সোস্যাল রিসার্চ’-এর তথ্য অনুযায়ী পৃথিবীর ইতিহাসে এই প্রথম দশ বৎসরের মধ্যে বিশ্বে পাঁচ বছরের কমবয়সি শিশুদের চেয়ে পঁয়ষট্টি বা তার চেয়ে বেশি বয়স্ক লোকের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরা পড়েছে। জনসংখ্যার এই পরিবর্তন সারাবিশ্বে বিশেষত উন্নয়নশীল রাষ্ট্রসমূহে যথেষ্ট শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পুঁজিবাদী দেশ আমেরিকা। এখানে মানুষের বয়স অনুমান করাটা বেশ কঠিন। এটার কারণ হচ্ছে ব্যস্ততা এবং জীবনের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। আমেরিকানরা বিশ্বাস করেন যে ৪০ বছরের পর জীবন শুরু হয়। এর ফলে ৭০/৮০ বছরের ব্যক্তিরাও পরিশ্রম ও আনন্দ দুটোই উপভোগ করতে পারেন। আমেরিকাবাসীর ‘মানসিক শিক্ষা এবং দৃষ্টিভঙ্গি’ হচ্ছে ওদের সফলতার মূল স্তম্ভ। আত্মবিশ্বাসে ভরপুর থাকেন সামান্য নাগরিক থেকে শুরু করে উচ্চপদস্থ অফিসার সবাই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৯০% প্রাপ্তবয়স্ক সাঁতার জানেন, পাহাড়ে উঠতে জানেন, জানেন খরস্রোতা নদীতে নৌকা বাইচ করতে। শ্রমের মর্যাদাকে এই দেশে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হয়। দেয়া হয় উচ্চপদবিধারী এবং সামান্য উপার্জন করা ব্যক্তিদের সমান মর্যাদা ও বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা।’ ‘বার্ধক্য নিয়ে বা বার্ধক্যের উপর যথার্থ ও সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা নিরূপিত হয়নি আজও।

‘বার্ধক্য’ গবেষণামূলক কাজ। যে পড়াশোনা করা হয়, সেটা হল বার্ধক্যতত্ত¡ চর্চা বা বার্ধক্য বিজ্ঞান চর্চা। আমরা সহজভাবে যেটা বুঝি যে বার্ধক্য হল জন্ম-মৃত্যুর অন্তর্বর্তী জীবনচক্রের এক প্রান্তিক পর্যায় যা অনিবার্য ও অপ্রতিরোধ্য। এ নিয়ে বিজ্ঞানীরা বহু তত্ত¡ আলোচনা করেছেন। তার মধ্যে যে দুটো প্রাধান্য পেয়েছে, তার মধ্যে প্রথম, বার্ধক্যের কারণ হিসাবে ‘সময় বা কাল ও পরিবেশ-এর কথা বলেছেন। দ্বিতীয়ত, জীবকোষ বা দেহযন্ত্রের পরিবর্তন যা পূর্বনির্ধারিত।

গবেষক ন্যাথান শক, যিনি father of American Gerontology বলে খ্যাত, তাঁর মতে আমাদের শরীরের এই পরিবর্তন ঘটে খুব ধীরে ধীরে, মূল মজুত ক্ষমতার বার্ষিক ১ শতাংশ হারে এবং সেটা আরম্ভ হয় ৩০ বৎসর বয়সের পর থেকে। তিনি হিসাব করে দেখিয়েছেন এই কর্মক্ষমতার মজুত ভান্ডার পুরোপুরি নিঃশেষ হতে সময় লাগবে প্রায় ১২০ বৎসর। গবেষকরা এই অভিমতও পোষণ করেন যে জরা বা বার্ধক্য কোনও রোগ নয়, যদিও রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা এই সময় বৃদ্ধি পায়। P.S Timias,, তাঁর Hormones and Ageing (1995) গ্রন্থে বার্ধক্যের সংজ্ঞা দিয়েছেন,‘The some total of all changes that occur in living organism with passage of time that lead to functional impairment, increased pathology and death.’ বার্ধক্যের প্রসঙ্গে এটাই হল বিশ্বের বিশেষজ্ঞদের মাঝে সর্বজনগ্রাহ্য তত্ত¡।
বৃদ্ধ-বৃদ্ধা বা বয়স্করা সবাই একই রকমের হয়, এ-ধরনের কিছু ধারণা প্রচলিত আছে। আমাদের বাস্তবচিত্র কিন্তু অন্যরকম। ব্যক্তিবিশেষে সবারই শারীরিক ও মানসিক গঠন আলাদা হয়। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ ভিন্নতা একটা মূল ভূমিকা নেয়। চিকিৎসা শাস্ত্র অনুযায়ী মহিলা বা প্রবীনরা জৈবিক কারণেই কিছু বেশি সুবিধা পেয়ে থাকেন যার দরুন দেখা যায় বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই বয়স্কতম ব্যক্তিটি হন মহিলা, পুরুষ নন। সমীক্ষায় দেখা যায়, ষাটোর্ধ্ব বয়সের মানুষের ৫৫ শতাংশই হচ্ছেন মহিলা। আশি বছরের মানুষের ৫৫ শতাংশ এবং ১০০ বছর বয়সের মানুষের মধ্যে শতকরা ৭৭ শতাংশ হন বৃদ্ধা।

আমাদের দেশের বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য বিভিন্ন ধরনের কাজের মাধ্যমে বহু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন উপযুক্ত ভূমিকা নিয়েছে। এই সব সংগঠন নিঃসঙ্গ কর্মক্ষম বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। স্বাধীনভাবে থেকে যারা নানা কাজকর্ম করতে চান, এখানে তার সুযোগ রয়েছে। বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের আত্মনির্ভর করে তোলার জন্য বিভিন্ন সংগঠন মেট্রোপলিটন শহরগুলোতে নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। সন্তানেরা বহুদূরে থেকেও নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, যে তাদের মা-বাবাদের দেখাশোনার মানুষ আছে। পরিবর্তে যে অর্থ তাঁদের দিতে হয় সেটা তাঁরা সানন্দে দিয়ে থাকেন। সংঠনের ব্যক্তিরা সমস্ত রকমের কাজ ও ডাক্তারদের সাথে যোগাযোগ রাখেন। এখানে বিদেশে থাকা সন্তানদের সাথে ভিডিও কনফারেন্সের ব্যবস্থাও করে থাকেন।

আমাদের দেশে প্রবীণদের জন্য সরকারের তরফ থেকেও বিভিন্ন প্রকল্প নেয়া হয়েছে। কিন্তু কথা হচ্ছে, কতটুকু ভালো আছেন আমাদের বয়োজ্যেষ্ঠরা। আমাদের বয়োজ্যেষ্ঠদের খুব ভালো না হলেও ‘ভালো’ থাকার কথা বলা যায়। আমাদের অর্ধপুঁজিবাদী ব্যবস্থার মাঝে মানবসম্পদ সংরক্ষণ যতটুকু কার্যকর করা হচ্ছে তা আমরা জানি।

আমাদের সমাজে আজ মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় ঘটেছে। কোথাও আক্রান্ত শিশু, কোথাও কন্যা, কোথাও পিতা, ভগ্নী, স্ত্রী, মাতা, কোথাও স্বামী,। অন্য রূপেও ‘মানুষ’ আজ আক্রান্ত যে কোনও রূপে, সমস্ত রকম সম্পর্কে। ধৈর্যহারা, বুঝি জ্ঞানহারাও মানুষ। আজ জন্মদাতার কাছে শিশুও কি সুরক্ষিত? কোথায় চলেছি আমরা?

এরপরও আমরা জীবনের কথা বলি। বিশ্বাস করি মানুষকেই। কারণ এই মানুষই একমাত্র পারে স্নেহ করতে শ্রদ্ধা করতে। তাই মানব সম্পদ হিসাবে আমরা চাই বায়োজ্যেষ্ঠদের সম্মান করতে ভালবাসতে। আমরা ৬০-এর পরে নবজীবনের কথা বলি, অন্যভাবে বাঁচার, স্বপ্ন দেখার কথা বলি। আমরা চাই এক মুক্ত আকাশের নীচে প্রজন্মগত শূন্যস্থান পূর্ণ করে নতুন এক পরিমন্ডল সৃষ্টি করতে। পুরুষ-মহিলা-নবীন-বৃদ্ধ নির্বিশেষে এগিয়ে আসুন আত্মাধীন হয়ে, বার্ধক্যেভীতি নিয়ে নয়, জীবনে জীবন যোগ করার সংকল্প নিয়ে এগিয়ে যাই।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট



 

Show all comments
  • মো:কামাল উদ্দিন ২ অক্টোবর, ২০১৯, ১২:১৮ এএম says : 0
    আমি চাকুরিতে প্রবেশ করি ১৯৮৫ সালের জুন মাসে সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প বাজেটে। ১৯৮৭ সালে প্রকল্পের মেয়াদ শেষে কর্তৃপক্ষ সক্রিয়ভাবে আমাকেসহ আরো অনেককে রাজস্ব বাজেটের স্থায়ী শূণ্য পদে স্থানান্তর করেন। আজ অবধি রাজস্ব বাজেটে কর্মরত আছি। আমাদের চাকুরি স্থায়ীকরণ/নিয়মিতকরণ করছে না পদোন্নতিও দেয়া হচ্ছে না। আমাদেরকে ডেঙ্গিয়ে জুনিয়রদের ঢালাওভাবে পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে।আর্ন্তজাতিক প্রবীণ দিবসে আমরা প্রবীণরা এর প্রতিকার চাই। আমরা প্রবীণ কর্মচারীরা চাকুরিতে স্থায়ীকরণ/নিয়মিতকরণসহ জুনিয়রদের উপরে আমাদের পদোন্নতি প্রদান করে আমাদের অধিকার ফিরে পেতে চাই।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন