Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভাঙন রোধে সমন্বিত পরিকল্পনা নিতে হবে

| প্রকাশের সময় : ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১২:০২ এএম

পদ্মা তীব্র ভাঙনপ্রবণ হয়ে উঠেছে। ভাঙনে ইতোমধ্যে বিভিন্ন স্থানে অফিস-আদালত, মসজিদ-মাদরাসা, বাড়িঘরসহ নানা স্থাপনা ও জমিজিরাত বিলীন হয়ে গেছে। চাঁদপুর, মুন্সীগঞ্জ, নড়িয়া, শিবচর, রাজবাড়ী প্রভৃতি এলাকায় ভাঙন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। চাঁদপুরে এর মধ্যেই একটি ইউনিয়ন পরিষদ ভবন ও একটি মাদরাসাসহ কয়েকশ স্থাপনা, মুন্সীগঞ্জ ও নড়িয়ায় অনুরূপভাবে বহু বাড়িঘর, জমিজিরাত ও স্থাপনা, শিবচরে স্কুল-মাদরাসাসহ শতাধিক স্থাপনা এবং রাজবাড়ির পাঁচ ইউনিয়নে একটি স্কুলভবনসহ শত শত বিঘা জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। শত শত মানুষ এই ভাঙনে বাড়িঘর-জমিজমা হারিয়ে নি:স্বে পরিণত হয়েছে। ‘কীতিনাশা’ নামে কথিত পদ্মার ভাঙন স্বাভাবিক হলেও সব সময় ভাঙনের মাত্রা ও পরিধি একরকম থাকে না। কখনো ভাঙন হয় ব্যাপক বিধ্বংসী, কখনো অত ধ্বংসাত্মক হয় না। এখন ভাঙনের ধ্বংসকারতা কমে আসার কথা। অথচ ব্যতিক্রমই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এর কারণ, মাঝেমধ্যে ভারি বৃষ্টিপাত হচ্ছে এবং সীমান্তের ওপার থেকে বিপুল পানিরাশি প্রবেশ করছে। খবরে প্রকাশ, ভারতে প্রবল বৃষ্টিপাত হচ্ছে এবং বৃষ্টির সেই পানি বাংলাদেশে অবাধে ঢুকছে। ওই খবরেই জানা গেছে, গঙ্গার ওপর নির্মিত ফারাক্কা বাঁধের সব গেট খুলে দেয়া হয়েছে, যাতে একযোগে পানি বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে। পদ্মায় অস্বাভাবিক পানি বেড়েছে। কোনো কোনো জায়গায় বিপদসীমা অতিক্রান্ত হওয়ার মতো অবস্থা হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে ভাঙন দেখা দেয়ার এটাই প্রধান কারণ বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করেছেন। উল্লেখ করা যেতে পারে, কিছুদিন আগে ভারত তিস্তার উজানে দেয়া গজলডোবা বাঁধের সবকটি গেট খুলে দেয়ায় লালমনিরহাটে আকস্মিক বন্যা দেখা দেয়। জেলার বিভিন্ন উপজেলায় বন্যা দেখা দেয়ায় ব্যাপক ফসলহানি হয়। হাজার হাজার মানুষ বানের পানিতে আটকা পড়ে দুর্বিষহ অবস্থায় পতিত হয়। লক্ষ্য করার বিষয়, ফাঁরাক্কা ও গজলডোবা বাঁধের গেট খুলে দেয়ার আগে ভারত কিন্তু বাংলাদেশকে অবহিত করেনি। যদি করতো তাহলে বাংলাদেশ আকস্মিক পানিবৃদ্ধিজনিত পরিস্থিতি বা সমস্যা মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারতো। একতরফাভাবে পানি আটকানো এবং পানির চাপ বাড়লে একযোগে বাঁধের সব গেট খুলে দেয়া সৎ প্রতিবেশী সুলভ আচরণ নয়।
আমাদের জীবন বাস্তবতায় নদীভাঙ্গন, তার ক্ষতি ও বিপর্যয় সাধারণ ঘটনা। নদীর প্রকৃতিই এমন যে, সে ভাঙন প্রবণ হয়ে ওঠে এবং ভেঙ্গেচুরে সব বিলীন করে দেয়। আবার কখনো সেই বিধ্বংসী নদীই গড়ে দেয় চর, সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত। পদ্মাই নয়, যমুনা, মেঘনা, তিস্তা, কর্ণফুলী প্রভৃতি বড় নদী, এমন কি ছোট নদীতেও ভাঙ-গড়ার এই খেলা চলে। ভাঙা-গড়া নদীর স্বাভাবিক খেলা হলেও তার ভাঙনে বেশুমার ক্ষতি হয় মানুষের। বাড়িঘর, স্থাপনা। ফসলী জমি, শস্য এবং ফলবান বাগান নদীবক্ষে হারিয়ে যায়। তাদের নি:স্ব করে দেয়। এই ক্ষতি থেকে আত্মরক্ষার জন্য বন্যা ও ভাঙন রোধে নেয়া হয়েছে বিভিন্ন কর্মসূচী ও পদক্ষেপ। বেড়িবাঁধ, সুরক্ষা বাঁধ, বন্যানিরোধ বাঁধসহ নানা প্রকার বাঁধ ছাড়াও বৃক্ষায়ণ ও বৃক্ষবেষ্টনী গড়ে তোলা হয়েছে। অথচ এসব পদক্ষেপ নেয়ার পরও প্রতিবছর বন্যা ও নদী ভাঙনে ফসলহানিসহ সহায়-সম্পদের বিপুল ক্ষতি সাধিত হয়। বাঁধ নির্মাণ, সংস্কার বা মেরামতের জন্য প্রতিবছর বাজেটে বড় অংকের বরাদ্দ থাকে। দু:খজনক ব্যাপার, এই বরাদ্দের সামান্য অংশই মাত্র ব্যবহৃত হয়, বেশির ভাগ অংশই লুটপাট হয়ে যায়। এই লুটপাটের বিষয়টি ওপেন সিক্রেট হলেও আজ পর্যন্ত বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। নদী ভাঙন রোধ বা নিয়ন্ত্রণ করে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা কমানো খুবই সম্ভবপর। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নদী ভাঙন ও বন্যা নিরোধে যে সাফল্য দেখা যায়, সেটাই তার প্রমাণ বহন করে। আমাদের দেশে কেন এই ব্যতিক্রম, সে প্রশ্নের উত্তর সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকেই দিতে হবে। প্রতিবছরই আমরা, সিরাজগঞ্জ, চাঁদপুর, খুলনা, রাজশাহী প্রভৃতি শহর রক্ষা বাঁধসহ উপকূলীয় অঞ্চলের বিভিন্ন বেড়িবাঁধ নিয়ে বিচলিত হয়ে পড়ি। অনেক জায়গায় বাঁধে ভাঙন দেখা যায়, ক্ষয়ক্ষতি হয়। অন্যদিকে পদ্মা- মেঘনা, যমুনাসহ অন্যান্য নদী কোথায় কোথায় ভাঙনপ্রবণ তাও আমাদের অজানা নয়। ওইসব এলাকায় প্রতিবছরই ভাঙনে সম্পদ-সম্পত্তির ক্ষতি হয়। প্রশ্ন উঠতে পারে, জানা থাকা সত্তে¡ও ওইসব এলাকায় স্থায়ীভাবে ভাঙন রোধ করা যায় না কেন?
স্থায়ীভাবে ভাঙন রোধ করা অবশ্যই সম্ভব। এজন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন উপযুক্ত পরিকল্পনা ও তার যথাযথ বাস্তবায়ন। বাস্তবায়নে নিষ্ঠা, সততা, জবাবদিহিতা ও সুশাসন নিশ্চিত হলে নদীভাঙন স্থায়ীভাবে রোধ না হওয়ার কোনো কারণ নেই। আমরা অত্যন্ত দু:খের সঙ্গে বলতে বাধ্য হচ্ছি, আমাদের দ্বীপ ও চরাঞ্চল সুরক্ষার জন্যও কোনো ভালো বন্দোবস্ত নেই। হাতিয়া, কুতবদিয়াসহ বিভিন্ন দ্বীপ ও উপকূলীয় চর সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। হাতিয়া-কুতুবদিয়ার আয়তন ক্রমাগত সংকুচিত হয়ে পড়ছে। অন্য অনেক চর ভেঙে ভেঙে ছোট হয়ে আসছে। খবরাখবর থেকে জানা যায়, উপকূলীয় অঞ্চলে দ্বীপ-চর মিলে এমন একটা বিশাল এলাকা জেগে উঠেছে বা উঠছে, যা আয়তনের দিক দিয়ে আরেকটি বাংলাদেশের সমান। অথচ এদিকে সরকার বা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নজর নেই। বহুদিনে জেগে ওঠা দ্বীপ ও চর ভেঙে গেলেও সেদিকে খেয়াল নেই। নতুন দ্বীপ-চর রক্ষায়ও কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেই। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সাগর থেকে যে আরেক বাংলাদেশ জেগে উঠছে তা আগামী ২৫-৩০ বছরের মধ্যে বসবাসযোগ্য হয়ে উঠতে পারে। এটা এদেশের মানুষের জন্য আল্লাহপাকের এক অপার করুণা ও দান। এই দানকে হেলা করা কোনো মত্যেই উচিত হবে না। উপকূলীয় দ্বীপ-চর রক্ষার জন্য, উন্নয়নের জন্য, এবং দ্রুত বসবাসযোগ্য করে তোলার জন্য একটা বড় উদ্যোগ দরকার। ডেল্টা প্লান নেয়া হয়েছে। তবে নামে যতটা, কাজে ততটা নয়। মন্ত্রীপরিষদে অনুমোদিত হওয়ার পরও এর কোনো অগ্রগতি নেই। ডেল্টা প্লান বাস্তবায়নে অবশ্যই দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। নদী ভাঙন প্রতিরোধে একটি ব্যাপক ব্যবস্থা নেয়া আবশ্যক। কোনো এলাকায় ভাঙন রোধে বা বন্ধ করলেই হবে না তাকে স্থায়ীভাবে সুরক্ষার ব্যবস্থাও নিতে হবে। এক্ষেত্রে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা কার্যকর সুফল নিশ্চিত করতে পারে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন