Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সাহাবী কবি লাবীদ দুটি সূরা পড়ে কবিতা রচনা ছেড়ে দেন

কে. এস. সিদ্দিকী | প্রকাশের সময় : ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

আরবের বিখ্যাত কবি লাবীদ ইবনে রাবীয়া (৫৬০-৬৬১) ছিলেন একজন ‘মোখাযরম’ সাহাবী। বনি আমের গোত্রের এ কবি ইসলাম গ্রহণের পর ৬০ বছর জীবিত ছিলেন। এ দীর্ঘ সময়কালের মধ্যে তিনি একটি কবিতাও রচনা করেননি বলে বর্ণিত হয়ে থাকে। কেন তিনি তার এ সৌভাগ্যময় ইসলাম যুগে কাব্যচর্চা হতে বিরত থেকেছেন, তার এক অদ্ভুত-বিস্ময়কর ঘটনা ইতিহাসে বিধৃত আছে। ঘটনাটি বর্ণনা করার পূর্বে জাহেলী যুগে কবি লাবীদ ইবনে রাবীয়া আমেরীর প্রতিভা-সুনামের প্রতি কিঞ্চিত আলোকপাত করা প্রয়োজন। তবে তার জীবন ও কর্মের ওপর আলোচনা করা আমাদের প্রতিপাদ্য বিষয় নয়, শুধু তার কাব্য প্রতিভার ব্যাপারে সামান্য আভাস দিয়ে রাখতে চাই।

লাবীদ ছিলেন জাহেলী যুগের প্রথম শ্রেণির কবি। তাঁর আরেকটি বড় পরিচয় তিনি ছিলেন ‘মোখাযরম’ সাহাবী। তাঁর সাহাবী হওয়ার এ গৌরব ও সৌভাগ্য তাকে সেরা যুগের সেরা মানুষের অন্তর্ভুক্ত করেছিল। কিন্তু তাঁর সাহাবী হওয়া নিয়ে কিছুটা মতভেদ থাকলেও তাঁর ‘তাবেঈ’ হওয়াতে দ্বিমত নেই। তবে সাহাবী হওয়ার পক্ষে জোরালো মত রয়েছে। এ পর্যায়ে মোখাযরম শব্দটির ব্যাখ্যা প্রয়োজন। কেননা ‘রিজাল শাস্ত্রের’ পরিভাষায় তা বিশেষ অর্থবোধক। শরহে নোখবাতুল ফিকর পুস্তকে মোখাযরম সাহাবীর যে পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে তা এই:

সাহাবা ও তাবেঈনের মধ্যবর্তী একটি শ্রেণি আছে, তাদেরকে মোখাযরম বলা হয়। এঁরা সেই সব লোক, যাঁরা জাহেলিয়াত ও ইসলাম- উভয় যুগ প্রত্যক্ষ করেছেন, কিন্তু রসূলুল্লাহ এর সাক্ষাৎ লাভ করেননি। তারা সাহাবা কিংবা তাবেঈন, তাতে মতভেদ আছে। সঠিক মত হচ্ছে এই যে, তাঁরা প্রধান তাবেঈনের অন্তর্গত। তাঁদের ইসলাম গ্রহণ রসূলুল্লাহ (সা.) এর যুগে হোক অথবা পরবর্তী যুগে। কাজী আয়ায প্রমুখ দাবি করেন যে, আল্লামা ইবনে আবদুল বার মনে করেন যে, মোখাযরম সাহাবার অন্তর্ভুক্ত কিন্তু এটি সন্দেহজনক। কেননা খোদ আল্লামা সাহেব ‘ইস্তীআব’ গ্রন্থের ভূমিকায় বিশ্লেষণ করেছেন যে, মোখাযরমীনকে আমি সাহাবার সাথে এই কারণে উল্লেখ করিনি যে তারাও সাহাবা বরং এ কারণে যে, প্রথম যুগে যারা মোমেন ছিলেন, এ কিতাবে তাদের সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে ।

এ বিবরণ হতে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, কবি লাবীদ মোখাযরম সাহাবী ছিলেন। তিনি ইসলাম গ্রহণের পরও বহু বছর জীবিত ছিলেন এবং রসূল (সা.) জীবনের অনেক বছর পেয়ে ছিলেন। সুতরাং তাঁর সাথে সাক্ষাৎ লাভ করা খুবই স্বাভাবিক।

হযরত মুফতি আমীমুল এহসান (রহ.) মোখাযরম সম্পর্কে লিখেছেন, ‘হুওয়া মান আদরাকাল জাহেলিয়াতা ছাগীরান, আও কাবীরান ফি হায়াতিন নবী (সা.), ছুম্মা আসলামা বাদাহু, আও আসলামা ফি আহদিহি (সা.) ওয়া লাম ইয়ারাহু।’ অর্থাৎ যে ব্যক্তি রসূলুল্লাহ (সা.) এর জীবদ্দশায় ছোট বা বড় হওয়ার জাহেলী যুগে পেয়েছে, এরপর ইসলাম গ্রহণ করেছে অথবা তার যুগে ইসলাম গ্রহণ করেছে কিন্তু তাকে দেখেনি। (কাওয়াইদুল ফিকহ)

রসূলুল্লাহ (সা.) এর জন্মেরও (৫৭০) দশ বছর (৫৬০) আগে লাবীদ জন্মগ্রহণ করেন। হুজুর (সা.) ইন্তেকাল করেন একাদশ হিজরী মোতাবেক ৬৩২ সালে। তখন লাবীদের বয়স ৭২ বছর । ৬২২ সালে হিজরতের পূর্ব পর্যন্ত ১৩ বছরের মক্কী জীবনের মধ্যে লাবীদ ইসলাম গ্রহণ করে থাকবেন, তখনই তার ইসলাম জীবন ৬০ বছর হয়। অর্থাৎ লাবীদ হুজুর (সা.) এর মক্কী ও মাদানী জীবনের ২৩ বছরের পরও অনেক বছর জীবিত ছিলেন। তার সুদীর্ঘ সময়কালের মধ্যে একবারও তিনি রসূলুল্লাহ (সা.) এর সাক্ষাৎ লাভে ব্যর্থ হয়েছেন, এটা কীভাবে সম্ভব? তিনি কোনো হাদীস বর্ণনা করেছিলেন কিনা অথবা ইসলাম সম্পর্কে কোন কবিতা লিখেছিলেন কিনা তাও জানা যায় না। আরবের এত বড় বিখ্যাত কবি এবং ইসলাম গ্রহণের পর ৬০ বছর জীবিত থাকা সাহাবীর দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যাবে না।

জাহেলী যুগে লাবীদের সাহিত্য-কীর্তি খুব উজ্জ্বল। তাঁর রচনাবলীর মধ্যে কাব্য সাহিত্যের মধ্যে একটি ‘দীওয়ান’ বা কবিতা সংকলন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রাচীন আরবী কাব্য সংকলন পুস্তক ‘সাবয়ে মোআল্লাকাত’ আলোড়ন সৃষ্টিকারী, অতুলনীয় পুস্তক। এতে কবি লাবীদের একটি বিখ্যাত ‘কাসীদা’ স্থান পেয়েছে। বাকি ৬ জন কবির নাম হচ্ছে: ইমরাউল কাইস, তুরফা, ইবনুল আবদ, যোহাইর ইবনে আবিসালমা, আমর ইবনে কুলসুম, আল হারেস ইবনে হিল্লাযা এবং আন্তারা ইবনে শাদ্দাদ।

কবি লাবীদ ইসলাম গ্রহণের পর কুফায় গিয়ে বসবাস করতে থাকেন। তার ভাই আরবাদের মৃত্যুর পর তার ওপর তিনি যে শোকগাঁথা রচনা করেন তা ব্যাপক খ্যাতি লাভ করে। আরবাদ কীভাবে মৃত্যুবরণ করেন ইতিহাসে সে কাহিনী এইভাবে বর্ণিত হয়েছে, আমের ইবনে তোফাইল এবং আরবাদ তারা উভয় রসূলুল্লাহ (সা.) এর খেদমতে উপস্থিত হয় এবং বলে যে, মদীনার খেজুরে আমাদেরও হিসসা থাকতে হবে। রসূলুল্লাহ (সা.) তাদের দাবি প্রত্যাখ্যান করেন, এতে আমের ইবনে তোফাইল ধমক দিয়ে বলে, আমি আপনার মোকাবিলায় মদীনাকে শক্তিশালী ঘোড়ার পাল এবং বীর নওজোওয়ান সোওয়ারদের দ্বারা ভরে ফেলব। রসূলুল্লাহ (সা.) দোআ করলেন, হে আল্লাহ! আমের ইবনে তোফাইলের ক্ষতিসাধন হতে আমাদের হেফাজত করুন।

‘ইস্তীয়াব গ্রন্থের’ বরাতে হযরত উসায়দ ইবনে হোযায়র (রা.) প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, উক্ত কথাবার্তার সময় হযরত উসায়দ বর্ম উঠান এবং ঐ দুইজন (আরবাদ ও আমের) এর মস্তকে ঢুকিয়ে দেন এবং বলতে থাকেন ‘আইয়্যুহাল হাজরামান’ হে শিয়ালের বাচ্চাদ্বয়। একথা আমের জিজ্ঞাসা করে, তুমি কে? তিনি বললেন, আমি উসায়দ ইবনে হোযায়র। আমের বলল, তোমার চেয়ে তোমার পিতা উত্তম ছিলেন। আমার পিতার সাথে তোমার কি সম্পর্ক সে তো কাফের ছিল, মরে গেছে।

যখন আরবাদ ও আমের হুজুর (সা.) এর নিকট হতে প্রত্যাবর্তন করছিল, তার গতি পথে আল্লাহ তালা বজ্র প্রেরণ করেন এবং আরবাদের উপর তা পতিত হয় এবং তাকে ও তার উটকেও ধ্বংস করে দেয়। আর আমের ‘তাউন’ (মহামারি) রোগে আক্রান্ত হয় এবং সালুলী নামের এক মহিলার গৃহে সে মৃত্যুবরণ করে। (হায়াতুল হায়ওয়ান)

পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, লাবীদ ইসলাম গ্রহণের পর সুদীর্ঘ ৬০ বছর জীবিত ছিলেন। কিন্তু এসময়কালের একটি মাত্র কবিতা (২ ছত্র) ব্যতীত আর কোন কবিতা রচনা করেননি। কেন করেননি, সে কারণটিই এখানে উল্লেখ করতে চাই, যা কবি লাবীদ খলিফা হযরত উমর (রা.) এর প্রশ্নের জবাবে বলে ছিলেন। তার জবাবের মধ্যে রয়েছে সমগ্র কবি সাহিত্যিক সমাজের জন্য চিন্তার খোরাক। বিশেষত যারা পবিত্র কালামুল্লাহ্ পাঠ করেন এবং অর্থ বোঝেন, কবি লাবীদ তাদের জন্য যে চিন্তার বিষয়বস্তু রেখে গেছেন তা ব্যতিক্রমধর্মী এবং অভিনব। ইসলামী আরবী সাহিত্যের গোটা ইতিহাসে লাবীদের মতো চিন্তাশীল কবি পাওয়া যাবে না। তার এ চিন্তা মননশীলতার জন্য তার প্রতি আরবরা যে সম্মাননা প্রদর্শন করেছিলেন সে দৃষ্টান্তও বিরল।

ঘটনাটি হচ্ছে এই যে, একবার হযরত উমর (রা.) লাবীদকে তার কাব্য রচনা ত্যাগ করার কারণ জিজ্ঞাসা করেন। জবাবে তিনি বললেন, যখন আল্লাহতালা আমাকে সূরা ‘বাকারা’ ও সূরা ‘আলে ইমরানের’ জ্ঞান দান করেন, ‘তখন আমার কাব্য চর্চার কী প্রয়োজন?’ তার এ জবাবে সন্তুষ্ট হয়ে হযরত উমর (রা.) তার ভাতা পাঁচশ দেরহাম বাড়িয়ে দেন। এ বৃদ্ধির ফলে তার ভাতা আড়াই হাজার দেরহাম হয়ে যায়।

হযরত আমির মোআভিয়া (রা.) এর শাসনামলে তার এ ভাতা হতে তিনি পাঁচশ দেরহাম হ্রাস করতে চান। লাবীদ বললেন, হযরত উমর (রা.) যা বাড়িয়ে ছিলেন, তার কী প্রয়োজন ছিল? লাবীদ বললেন, আমার মৃত্যুর সময় নিকটবর্তী হয়েছে এবং আমার মৃত্যুর পর বর্ধিত এবং সামান্য ভাতা সবই তো আপনার হয়ে যাবে। একথা শুনে হযরত মোতাভিয়া (রা.) বিগলিত হয়ে পড়েন এবং ভ্রাতা হ্রাস করার ইচ্ছা পরিবর্তন করেন। এ ঘটনার মাত্র কিছুদিন পর লাবীদ ইন্তেকাল করেন।

কথিত আছে যে, হযরত লাবীদ (রা.) ইসলাম গ্রহণের পর মাত্র একটি কবিতা বলে ছিলেন যার অর্থ ‘আল্লাহর শোকর আমার মৃত্যু তখন পর্যন্ত আসেনি, যতক্ষণ না আমি ইসলামের জামা পরিধান করিনি।’ বর্ণিত আছে, ইসলাম গ্রহণের পর লাবীদ ইবনে রাবীয়া কবিতা রচনা ত্যাগ করে কোরআন লিপিবদ্ধ করার মহান দায়িত্বে আত্মনিয়োগ করেছিলেন।



 

Show all comments
  • মোমিনুল ইসলাম ২১ আগস্ট, ২০২১, ৮:১৫ পিএম says : 0
    মাশায়াল্লহ। কবি লাবিদ মুসলিম ছিলেন এটাতো আমি জানতামি না। আর আজ অনেক কিছু জানলাম।মাশাল্লাহ।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন