চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
মানুষ আল্লাহপাকের অপূর্ব সৃষ্টি । মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত । মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হল , মানুষকে আল্লাহপাক কথা বলার শক্তি দিয়েছেন । সৃষ্ট জীবের মধ্যে কাউকে আল্লাহপাক কথা বলার শক্তি দেননি । মানুষকে বলা হয় , হাওয়ানে নাতেক। (অর্থবহ কথা বলা, সুষ্পষ্ট ভাষায় বুঝিয়ে দেয়াকে নুতকুন বলে) মনের ভাব অন্যের নিকট প্রকাশ করার অন্যতম মাধ্যম হল ‘কথা’ । অঙ্গভঙ্গি বা ইশারা দিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করা যায় , তবে সেটি পূর্ণাঙ্গ নয় । কারণ, ইশারা দ্বারা বিশেষ কতগুলো বিষয় প্রকাশ করা যায় , কোনো জটিল বিষয় বোঝানো সম্ভব হয় না।
আল্লাহপাকের অন্যান্য সৃষ্ট জীব যেমন- পশু-পাখি,হাতি-ঘোড়া,গরু-মহিষ,ছাগল-ভেঁড়া বিশেষ কিছু ইশারা এবং সংকেত ব্যবহার করে যা অত্যন্ত সীমিত। মুরগী তার বাচ্চাকে চিলের আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য একটা সংকেত ব্যবহার করে , বাচ্চাও সে সংকেত শুনে সতর্কতা অবলম্বন করে, সে তার বাচ্চাকে সংকেতের মাধ্যমে খাদ্য গ্রহন করা শিক্ষা দেয়, কিন্তু ভাষা বা কথা বলতে না পারার কারনে সামগ্রিকভাবে বিষয়গুলো বুঝিয়ে দিতে পারে না।
মানুষকে আল্লাহপাক কথা বলার শক্তি দিয়েছেন । ইশারা ও লেখার মাধ্যমে অন্যের নিকট তা প্রকাশ করার শক্তিও দিয়েছেন। আল্লাহপাকের লাখো শুকরিয়া, তিনি আমাদেরকে কথা বলার শক্তি দিয়েছেন। কাজেই আল্লাহপাকের নেয়ামতের এই শুকরিয়া আদায় করতে হবে। যে কথাগুলো আমরা বলব সেগুলো হতে হবে আল্লাহপাকের বেঁধে দেয়া নিয়ম-রীতির আওতাভুক্ত। কারণ কথা অনেক প্রকারে বলা যায়, যেমন-মিথ্যা কথা, গীবত বা পরনিন্দা, অশ্লীল বা কুরূচিপূর্ন কথা, চরিত্র হননকারী কথা, শিরেকী কথা, অমার্জিত কথা, অনর্থবোধক কথা, অনাকাঙ্খিত কথা ইত্যাদি এবং সে কথাগুলোকে মন্দ কথার পর্যায়ে ফেলা যায়। পক্ষান্তরে ভালো কথা হল, কোরআন-হাদীসের কথা, আল্লাহপাকের অহ্দানিয়াতের কথা, ইবাদতের কথা, বেহেশত-দোযগের কথা, সত্য কথা, ভালো কাজে এবং ইবাদতে আগ্রহ সৃষ্টিকারী কথা, ঝগড়া-বিবাদ মীমাংসার কথা ইত্যাদি ।
ইসলাম কথা বলার ব্যপারেও বিধি-নিষেধ আরোপ করেছেন। মুখ আছে বলে যা ইচ্ছা তাই বলা যাবে না। অহংকারী কথা বলা যাবে না , যেমন আল্লাহ পাক হযরত লুকমান (আঃ) তাঁর পুত্রকে নছিহতপূর্ণ কথার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন যে,‘তোমরা যখন কথা বল তখন কন্ঠস্বর নীচু করে কথা বলবে ’। অর্থাৎ প্রয়োজনাতিরিক্ত উচ্চস্বরে চিৎকার করে কথা বলা যাবে না। তিনি এমন কথাকে গাধার বিকট আওয়াজের সাথে তুলনা করেছেন।
হযরত আলী(রাঃ) বলেন যে, রসূলে পাক (সাঃ) এর স্বভাব মোটেই রুক্ষ ছিল না, কথাবার্তায় নিরস ছিলেন না, তিনি উচ্চস্বরে বা অশ্লীল কথা বলতেন না, কারো প্রতি দোষারোপ করতেন না।(সামায়েলে তিরমিজি)
আল্লাহপাক রাসূলেপাক (সাঃ) কে বলে দিয়েছেন যে, আপনি যখন আমার প্রতি দাওয়াত দেবেন তখন জ্ঞানের কথা বুঝিয়ে ও উপদেশ শুনিয়ে উত্তমরূপে এবং পছন্দযুক্ত পন্থায় বিতর্কের মাধ্যমে বলবেন।অর্থাৎ যখন দাওয়াত দেবেন তখন আপনার কথার মধ্যে থাকতে হবে অকাট্য যুক্তি প্রমাণ এবং কথাগুলো এমন শুভেচ্ছাপূর্ণ হতে হবে যাতে প্রতিপক্ষের মন নরম হয়ে তা গ্রহণ করে । আপনার ভঙ্গিতে যেন ন¤্রতা থাকে । আল্লাহ পাক হযরত মুসা (আঃ) কেও ফেরাউনের সাথে ন¤্র আচরণ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। মোট কথা , দাওয়াত দিতে হবে প্রতিপক্ষের অবস্থা যাচাই করে হিকমতের সাথে শব্দ চয়ন করে শুভেচ্ছা ও সহানুভূতির মনোভাব নিয়ে যুক্তি-প্রমানসহ যাতে প্রতিপক্ষ নিশ্চিতরূপে বিশ^াস করে যে, যা কিছু বলা হচ্ছে, তা তার উপকারার্থে হিতাকাঙ্খি হিসাবে বলা হচ্ছে, তাকে লজ্জা দেয়া বা আর মর্যাদার হানি করার জন্য নয় ।
আল্লাহ পাক সূরা আহজাবের ৭০ নং আয়াতে বলেছেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সঠিক কথা বল’। সঠিক কথা বলার ব্যাপারে কোনরূপ দূর্বলতা থাকা উচিত নয় । প্রয়োজনের সময় সঠিক কথা বলতেই হবে।
ওসূলে পাক (সাঃ) বলেছেন, ‘প্রয়োজনের সময় কথা না বলে যে চুপ থাকে , সে নিজের সাথে উপহাস করে’। কিয়ামতের দিন আল্লাহ পাক ঐ লোককে ডেকে বলবেন ,‘তুমি ঐ ব্যাপাওে কথা বললে না কেন? কিসে তোমার বাধা দিয়েছিল ? তখন সে বলবে , লোকভয়। তখন আল্লাহ পাক বলবেন, তুমি সবকিছুর চেয়ে আমাকে বেশী ভয় করলে না কেন। (এবনে মাজাহ)
রাসূলে পাক (সাঃ) আরো বলেছেন , অত্যাচারী শাসনকর্তার সামনে সত্য কথা বলাই উত্তম জেহাদ । বোখারী শরীফ)। অর্থাৎ সত্য কথা বলতে হবে সেটা যে কোন পরিস্থিতিতেই হোক ।
সূরা বনি ইসরাইলের ৫৩ নং আয়াতে আল্লাহ পাক বলেছেন , আমার বান্দাদের বলে দিন তারা যেন যা উত্তম এমন কথাই বলে।উক্ত আয়াতে কাফেরদের সাথেও বিনা প্রয়োজনে কটু কথা বলতে নিষেধ করা হয়েছে । কারণ গালি-গালাজ ও কটু কথা দ্বারা কোন দূর্গ জয় করা যায় না এবং কাউকে হেদায়েতও করা যায় না ; বরং মানুষ শত্রæতে পরিণত হয়ে যায়।
আল্লাহ পাক সূরা হামিম সেজদার ৩৪ নং আয়াতে বলেছেন, ভালো ও মন্দ সমান হতে পারে না। উৎকৃষ্ট দ্বারা মন্দ প্রতিহত কর, ফলে তোমার সাথে যার শত্রতা আছে সে হয়ে যাবে তোমার অন্তরঙ্গ বন্ধু। হযরত এবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি তোমার প্রতি ক্রোধ প্রকাশ করে, তুমি তার প্রতি সবর কর, যে তোমার প্রতি মূর্খতা প্রকাশ করে তুমি তার প্রতি সহনশীলতা প্রদর্শন কর এবং যে তোমাকে জ¦ালাতন করে তুমি তাকে ক্ষমা কর। (মাজহারী)
হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) কে এক ব্যক্তি গালি দিলে জবাবে বললেন, তুমি যদি সত্যবাদী হও এবং আমি যদি মন্দ হই তবে আল্লাহ পাক যেন তোমাকে ক্ষমা করে দেন। (কুরতুবী)
আল্লাহপাক কাউকে যথেচ্ছ কথা বলার অনুমতি দেননি। কথা বলার পূর্বে চিন্তা-ভাবনা করে, যদি মনে করে যে এতে কল্যান আছে তখনই যেন ঐ বিষয়ে কথা বলে। তখন জাহান্নামের আগুন তার নিকট থেকে সূযোদয় এবং সূর্যাস্তের ব্যবধানের মতো দূরত্বে চলে যাবে। ( বোখারী ও মুসলিম শরীফ)
রাসূলে পাক(সাঃ) মিথ্যা ও অপ্রাসঙ্গিক কথা বলাকে খুবই অপছন্দ করতেন। যারা মিথ্যা কথা ও বাতিল মজলিস থেকে দূরে থাকে তাদের প্রশংসা করে আল্লাহপাক সূরা ফুরকানের ৭২ নং আয়াতে বলেন, যারা মিথ্যা কাজে যোগদান করে না এবং যখন অর্থহীন ক্রিয়াকর্মের সম্মুখীন হয় তখন মান রক্ষার্থে ভদ্রভাবে চলে যায়।
উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহপাক তার খাস বান্দাদের গুণ বর্ননা করতে গিয়ে বলেছেন, তারা মিথ্যা ও বাতিল মজলিসে যোগদান করে না। অর্থাৎ গান-বাজনা, নৃত্যগীতি, মদ্যপান, নির্লজ্জতা ও কুরূচিপূর্ণ মজলিসে যোগদান করে না, মিথ্যা বলে না, মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় না তারাই হল আসল মুমিন ।
রাসূলে পাক(সাঃ) মিথ্যা সাক্ষ্যকে সর্ববৃহৎ কবীরা গুনাহ আখ্যা দিয়েছেন (বোখারী মুসলিম) কারণ একটা মিথ্যা কথা বা সাক্ষ্য একজনের জীবনে বিরাট ক্ষতি ডেকে আনতে পারে। মান সম্মান চলে যেতে পারে, সমাজে সে অবজ্ঞার পাত্র হিসাবে চিহ্নিত হতে পারে। সুতরাং এটি অত্যন্ত গর্হিত অন্যায় এবং এটি হুকুকুল ইবাদতের পরিপন্থি কাজ। যা আল্লাহপাক ক্ষমা করবেন না বলে ঘোষনা দিয়েছেন। কাজেই কথা বলার ক্ষেত্রে আমাদের প্রত্যেককেই সতর্ক থাকতে হবে। আল্লাহপাক কিন্তু আমাদের কথা বলার ক্ষমতা দেয়ার সাথে সাথে কথা বলার আদব, রীতিনীতি, নিয়মকানুন ও অত্যন্ত উত্তমরূপে শিক্ষা দিয়ে দিয়েছেন। কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ উপমা দিয়ে শিখিয়ে দিয়েছেন। কিভাবে কথা বললে মানুষে মানুষে সুভ্রাতৃত্বের বন্ধন দৃঢ় হবে। কারো কথায় যেন কেউ দুঃখ না পায়, সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয়, পারিবারিক বন্ধন ছিন্ন না হয়, কারো আতœসম্মানে আগাত না লাগে - সেদিকে সদাসতর্ক থাকতে হবে।
আল্লাহ পাক আমাদের সকলকে যেন সর্বপ্রকার মিথ্যা, অশ্লীল,কুরূচিপূর্ণ মন্দকথা থেকে রক্ষা করেন্। এবং রাসূলে পাক (সাঃ) এর কথা বলার নমুনা অনুসরণ করার তৌফিক দান করেন। আমীন!
(আলহাজ¦ মাওলানা এম.এ.মান্নান (রহঃ) এর রচনাবলী হতে সংগৃহীত)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।