দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
হাটহাজারী মাদরাসার সাবেক সিনিয়র শিক্ষক আলহাজ্ব হযরত মাওলানা শাহ মুহাম্মাদ বেদারুল আলম সাহেব রহ.-এর কিছুদিনের সাহচর্যে আমি যা কিছু দেখেছি-
তিনি ছিলেন জ্ঞান-পিপাসু আলিমে দ্বীন। তিনি কওমী শিক্ষাব্যবস্থায় বর্তমান প্রচলিত পাঠদান পদ্ধতির সংস্কারের পক্ষে এবং এর মাধ্যম হিসাবে আরবী ও বাংলাভাষাকে প্রাধান্য দেওয়ার পক্ষে ছিলেন।
তিনি এতই নম্র-ভদ্র ছিলেন যে, যে কেহ জীবনে কেবল একবার হলেও কিছুক্ষণের জন্যে তাঁর সাক্ষাতে যেতে ইচ্ছা পোষণ করতেন। তিনি এতই নিরহঙ্কারী ছিলেন যে, সর্বশ্রেণীর লোকজন নিঃসঙ্কোচে-নির্দ্বিধায় তাঁর কাছে যেতে পারতেন। কথা বলতে পারতেন। আর তিনিও প্রত্যেককে কথা বলার সুযোগ দিতেন। তাঁর কথাবার্তা, উঠা-বসা, চাল-চলনে অহঙ্কারের লেশমাত্রই ছিলনা। তিনি ছিলেন এক অনন্য উদারমনের অধিকারী। সংকীর্ণ মন-মানসিকতাকে তিনি অন্তরের অন্তস্তল থেকেই ঘৃণা করতেন।
মেহমানদারি ছিল তাঁর অলঙ্কার। তাঁর কামরা বা বাসা (শাহ মানযিল)-এ যে কেউ যে কোন সময় গেলে কমসে কম এক কাপ চা পান করা ব্যতিত বিদায় নিতে পারতেন না। ঈসায়ী ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বের ঘটনা- একদিন তাঁকে বললাম, ‘শাহ সাহেব! আজ বাসা থেকে (মাদরাসায়) আসতে দেরী হয়ে গেল নাকি?’ উত্তরে বললেন, ‘রাত্রে বাসায় মেহমান আসার কারণে ঘুমাতে পারিনি। তাই সকালে ঘুমাতে গিয়ে দেরী হয়ে গেল।’ বললাম-‘কোন্ সে মেহমান?’ বললেন- “জাতীয় সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী জনাব আলহাজ্ব সৈয়দ ওয়াহিদুল আলম (তিনিও এখন মরহুম) নির্বাচনী প্রচারণা শেষে রাত ১টার দিকে ১৫/২০জন সহকর্মী-সহ বাসায় এসে বললেন- ‘আমরা খানা খাইনি।’ তাদের জন্যে তৎক্ষণাত শাহ মানযিলের অন্দর মহলে খানা তৈরি করা হল। সাধ্যানুযায়ী তাদেরকে মেহমানদারির করার চেষ্টা করলাম। খাবার-দাবার শেষে তারা চলে গেলে দেখি রাতও প্রায় শেষ পর্যায়ে। তাই বাকি রাত আর না ঘুমিয়ে কুরআন তিলাওয়াত ইত্যাদি করে ফজরের আযানের পর নামায আদায় করে লম্বা ঘুম দিলাম। তাই আজ মাদরাসায় যথাসময়ে উপস্থিত হতে পারিনি।”
তাঁর আরেকটি বিশেষ গুণ ছিল- সর্বসাধারণের মাঝে তাঁর ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা। মাদরাসার যে কোন ছাত্র তাঁকে যে কোন বিষয়ে নির্দ্বিধায় অভিভাবক হিসাবে মেনে নিত। মাদরাসার ভিতরে, বাহিরে-এলাকায় যে কোন বিচার-আচারে গেলে প্রায়ই ক্ষেত্রে আমীরে ফায়সালার গুরুদায়িত্ব তাঁর উপরই অর্পণ করা হত।
তিনি মানবদরদী ও ন্যায়বিচারক হিসাবে বিশেষ গুণে গুণান্বিত ছিলেন। একদিন তাঁর কামরায় দেখলাম- এলাকার এক ব্যক্তির সাথে কী একটা বিষয়ে উনার বাড়াবাড়ি চলছে। একপর্যায়ে লোকটি বলল, ‘আপনার কাছে মানুষ কেন আসে?! আপনি ভাল লোক নয়।’ উনি বললেন- ‘আমি ভাল নই, তুই ভাল হলে হয়। যা, এখান থেকে চলে যা।’ তখন লোকটি রাগ করে চলে গেল। দুইদিন পর দেখি- ঐ লোকটিই এসে তাঁকে সালাম দিয়ে ‘মাথা ঠান্ডা হয়েছে কিনা?’ জিজ্ঞাসা করল। উনি বললেন, ‘আমার গরম-ঠান্ডা দিয়ে তোমার প্রয়োজন কী?’ উত্তরে লোকটি যা বলল এবং এরপর মাওলানা শাহ বেদারুল আলম সাহেব রহ. যা করলেন তা রীতিমতো বিস্ময়কর। লোকটি বলল, ‘আমার প্রয়োজন আছে। আপনি ফ্রি আছেন কিনা? আমি একটি বিপদে পড়েছি। থানায় যেতে হবে। একটি মামলার বিচার আছে। আর এতে আপনাকে থাকতেই হবে।’ এরপর লোকটি মামলার কাগজ-পত্র উনাকে দেখালেন। তিনি সেগুলো দেখে বললেন, ‘এটি নিয়ে এত টেনশন করার কিইবা আছে! চল, থানায় যাই। কী হয় দেখি।’ অতঃপর থানায় গিয়ে যুক্তি-তর্ক করে লোকটিকে মামলা থেকে খালাস করে আনেন। এ ধরনের আরো বহু সংখ্যক সৎ গুণাবলী তাঁর মাঝে বিদ্যমান ছিল, যেগুলো অনুকরণীয়-অনুস্মরণযোগ্য।
তিনি ছিলেন অমায়িক, সদালাপী। একদিন আমাকে বললেন- “ক্বারী সাহেব! তোমাকে ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করতে আমার সঙ্কোচ লাগে। তোমাকে হেয় করছি মনে হয়। তাই তোমাকে সম্বোধন করতে ‘আপনি’ শব্দের পরিবর্তে ‘তুমি’ শব্দ ব্যবহার করব।” কেবল এ বিষয়টি থেকে আমি তাঁর আর তিনি আমার কত যে আপনজন এবং কাছের ব্যক্তি ছিলেন- তা প্রকাশ করার ভাষা আমার জানা নেই।
বাংলাদেশের হাতেগণা কয়েকটি ঐতিহ্যবাহী পরিবারের মধ্যে আল্লামা শাহ আবদুল ওয়াহহাব সাহেব রহ.-এর পরিবার অন্যতম। তাঁরই সুযোগ্য সাহেবযাদা মাওলানা শাহ বেদারুল আলম সাহেব রহ. পারিবারিক প্রায়ই বিষয়ে আমার কাছে পরামর্শ চাইতেন। এ বিষয়টি আমার কাছে যেমন অবাক লাগত, ঠিক তেমনি এটি ছিল আমার জন্য আল্লাহ তাআলা প্রদত্ত এক মহা নেয়ামত। এমনকি পবিত্র কুরবানির জন্তু কিনতে যাওয়ার প্রাক্কালে তিনি আমাকে ডেকে সাথে নিতেন। আমি যেটি দেখিয়ে দিতাম যে কোন মূল্যে/উপায়ে সেটিই কিনতেন। আর কুরবানীর জন্তু আমাকে দিয়ে যবেহ করাতেন। কুরবানীর গোশ্ত থেকে শুরু করে যে কোন নাস্তা-খানা আমাকে ছাড়া খেতেন না।
মৃত্যু (তা. ১৪/১/১৪২৫ হি. অনুযায়ী ৬/৩/২০০৪ ঈ., শনিবার)-এর দু’ দিন পূর্বের ঘটনা- দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। হাটহাজারী মাদরাসার মুহতারাম সিনিয়র শিক্ষক হযরত মাওলানা মুহাম্মদ ইয়াহইয়া সাহেব দা.বা.-সহ হাটহাজারী মাদরাসার চার/পাঁচজন উস্তায উনাকে দেখতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান। সন্ধ্যার সময় আমিও উনাকে দেখতে মেডিকেলে গেলাম। উনার শয্যার পাশে কিছুক্ষণ অবস্থান করে তাঁর সাথে সামান্য কিছু কথাবার্তা বলার পর ঐ উস্তাযগণ হাটহাজারীতে চলে আসার জন্যে বিদায় নিলেন। আমিও তাঁদের সাথে চলে আসার কথা ব্যক্ত করলে মাওলানা বেদারুল আলম সাহেব আমাকে বললেন- ‘ক্বারী সাহেব! কোথায় যাচ্ছ?’ বললাম, ‘হুযূরদের সাথে হাটহাজারী চলে যাচ্ছি।’ তিনি বললেন- ‘তুমি যেতে পারবে না! আমি একা কেমনে থাকব? মন খোলে, মনের কথাবার্তা বলার কেউ নেই।’ তখন উপস্থিত উস্তাযগণ আমাকে বললেন- ‘আপনি উনার পাশে আরো কিছুক্ষণ অবস্থান করে কথাবার্তা বলে পরে আসেন।’ এমতাবস্থায় উনার বড় ছেলে (মাওলানা হাফেয) শাহ তকিউদ্দীন মুহাম্মাদ আজিজ আমাকে একটু দূরে নিয়ে গিয়ে বলল- ‘হুযূর! আব্বু কিছুই খেতে চান না। কিছু খেতে দিলে বা বললে রাগ করেন। আশা করিÑ আপনি দিলে বা বললে কিছু খেতে পারেন।’ অতঃপর আমি শর্ত জুড়ে দিয়ে বললাম যে, আপনি কিছু খাওয়ার শর্তে থাকতে পারি। না হয় চলে যাব। উনি বললেন, ‘তুমি থাকলে খাব।’ এরপর চার/পাঁচ আইটেমের নাস্তা উনার সামনে রাখা হলে প্রতি আইটেম থেকে কিছু কিছু খেলেন। ঘণ্টা খানেক পরে বিদায়ের অনুমতি চাইলে বললেন- ‘আমাকে বাসায় কবে নিয়ে যাবে?’ বললাম- ‘ডাক্তাররা রিলিজ দিলেই নিয়ে যাব।’ এরপর বললেন- ‘আমাকে বাসায় নিয়ে গিয়ে গরম পানি দিয়ে একটু গোসল করিয়ে আবার হাসপাতালে নিয়ে আসিও।’ আমি বললাম, ‘একটু ধৈর্য ধরুন। কয়েকদিন পরেই তো নিয়ে যাব।’ তখন আমাকে বললেন- ‘ভাই! আমার বাড়ির দিকে নযর রাখিও। বিশেষ করে আমার ছেলে-সন্তানাদির খবরাখবর রাখিও, খবরাখবর নিও। তাদের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখিও।’ বাস! এই ছিল আমার সাথে উনার সর্বশেষ কথা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।