পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে অভিযান নিয়ে এক সপ্তাহ ধরে ঢাকার প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় বিস্তর আলোচনা হয়েছে। এই আলোচনার মধ্যে অধিকাংশই ছিলো ক্যাসিনো সম্পর্কে নিত্য নতুন খবর, অজানা তথ্য এবং সম্পাদকীয় বা উপসম্পাদকীয়। গত দু’ দিন থেকে দেখছি ক্যাসিনোর খবর কমে যাচ্ছে। কমে যাবে, এমন ধারণা আমি দ্বিতীয় দিনেই করেছিলাম। কয়েক দিন পর দেখা যাবে, এই ধরনের খবরই হবে লাপাত্তা। ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে অভিযান নিয়ে সংবাদপত্রগুলো যতই সরব হোক না কেন, যারা দুরদর্শী, তারা সেই মুহূর্ত থেকেই চিন্তা করছেন হঠাৎ কেন এই অভিযান শুরু হলো? তারা আরো চিন্তা করছেন, অভিযান শুরু হলো ঠিকই, কিন্তু যুবলীগ সভাপতি ওমর ফারুক চৌধুরীর জবানিতে যেখানে ঢাকা মহানগরীতে ক্যাসিনোর সংখ্যা কমপক্ষে ৬০টি সেখানে মহাসমারোহে এবং বিরাট পাবলিসিটি সহযোগে ৪/৫টি ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হলো। এর পরে বাকিগুলোকে ধরতে গেলে তারা কি আগের মতই জুয়ার ব্যবসা চালাতে থাকবে? নাকি তারা সেই মুহূর্তের মতো পাততাড়ি গুটাবে এবং কোথাকার পানি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় সেটি দেখার জন্য অপেক্ষা করবে।
আমার এই আশঙ্কা সত্য প্রমাণ করার জন্য এক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হয়নি। তৃতীয় দিনেই দেখা গেছে যে, অনেক ক্যাসিনো বন্ধ অথবা জুয়া খেলার সরঞ্জাম সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। কলাবাগান ক্রীড়া চক্রের প্রেসিডেন্ট ফিরোজকে ৫/৬ জন সঙ্গীসহ গ্রেফতার করা হয়েছে। তাকে রিমান্ডেও নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তার ক্লাবে ক্যাসিনোর কিছু যন্ত্রপাতি পাওয়া গেলেও আধুনিক ক্যাসিনো বলতে যা বোঝায় সেটি দেখা যায়নি। কারণ আগের দিন এবং রাতে খালেদ এবং শামীমের বিরুদ্ধে অভিযানের খবরটি যেভাবে টেলিভিশনে শুধু নিউজেই নয়, লাইভে দেখানো হয়েছে তার পরে আর কলাবাগান ক্লাব বা মৎসজীবীদের ক্লাবে ক্যাসিনোর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া সম্ভব ছিল না। আমরা শুনেছি যে, সরকারের দুই লক্ষ পুলিশ রয়েছে। র্যাবের সংখ্যা জানি না, তবে কয়েক হাজার তো হবেই। আমরা এটাও জানি না যে, ঢাকাসহ সারা বাংলাদেশে ক্যাসিনোর সংখ্যা কত। পত্র পত্রিকার মাধ্যমেই জেনেছি, শুধুমাত্র ঢাকা শহরেই নাকি ক্যাসিনোর সংখ্যা ৬০। একযোগে ৬০টি ক্যাসিনো বিনা নোটিশে ঘেরাও করতে গেলে কতজন পুলিশ বা র্যাব লাগতো? ২০ জন করে হলেও ১২০০ পুলিশ বা র্যাব লাগতো। সেভাবে যদি অভিযান শুরু হতো তাহলে অনেকে ধরা পড়তো। আর যারা ধরা পড়তো তাদেরকে রিমান্ডে নিলে ক্যাসিনো সাম্রাজ্যের অধিপতিদেরকেও পাকড়াও করা যেতো। কিন্তু সেটি করা হয়নি। ২/৩টি ক্যাসিনোতে অভিযান চালাতে গিয়ে এমন ঋধহ ভধৎব বা সরব পাবলিসিট করা হলো, যেন মনে হলো সরকার যুদ্ধ জয় করতে চলেছে। ফল কী হলো? ঐ খালেদ, শামীম এবং ফিরোজকে নিয়ে কয়েক দিন হৈ চৈ হবে। তারপর এই বিষয়টি বাতাসে মিলিয়ে যাবে। চট্টগ্রামের অবস্থা দেখুন। সেখানেও দু’ চারটি ক্যাসিনোতে অভিযান চালানো হয়েছে। কোনো লাভ হয়নি। অন্তত পত্রিকার খবর অনুযায়ী কাউকেও পাকড়ানো সম্ভব হয়নি।
পত্র পত্রিকাগুলোই বলছে যে, ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন সম্রাট নাকি ক্যাসিনো সাম্রাজ্যেরও সম্রাট। ইনি এমন টপ জুয়াড়ি যে মাসের কমপক্ষে ১০ দিন তিনি সিঙ্গাপুর থাকেন। সিঙ্গাপুর যাওয়ার সময় বস্তা ভর্তি টাকা নিয়ে যান। সেখানে এমন সব ক্যাসিনো আছে যেখানে ইউরোপ এবং আমেরিকা থেকে বড় বড় জুয়াড়িরা খেলতে আসে। বলতে গেলে আর একটি লাস ভেগাস। সেই সম্রাটও এখন তাদের স্ট্যাটাসে উঠে গেছেন। তাই সম্রাট যখন সিঙ্গাপুর বিমানবন্দরে নামেন তখন নাকি তাকে বিশেষ প্রটোকল দেওয়া হয়। এর পর তাকে একটি লিমুজিনে গন্তব্যে নিয়ে যাওয়া হয়। যাই হোক, সম্রাট যখন শোনেন যে, ক্যাসিনোর আর এক গড ফাদার খালেদ গ্রেফতার হয়েছেন, তখন তিনি কাকরাইল অফিসে আসেন। তাকে পরিবেষ্টন করে থাকেন ৬/৭ শত অনুসারী। পরদিনও তিনি একই অবস্থায় কাকরাইলে থাকেন। তারপর দিন সম্রাটের আর কোনো খবর নাই। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন যে সম্রাটের বিরুদ্ধে উপযুক্ত প্রমাণ পেলে তাকে ধরা হবে। খবরে কাগজে সম্রাটকে নিয়ে এই যে এতকিছু লেখা হলো তার মধ্যেই কি কোনো প্রমাণই ছিলো না?
৬০টি ক্যাসিনো চালাতে অন্তত ১২০ জন মাফিয়ারর প্রয়োজন। এই অভিযান শেষে ১২০ জন মাফিয়াকে কি গ্রেফতার করা হবে? কতজনকে আটক করা হয় সেটি দেখার জন্য মানুষ অপেক্ষা করছেন।
দুই
ইতোমধ্যেই পত্রপত্রিকার পাতায় অনেকগুলো ক্যাসিনোর নাম এসেছে। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও বেশ কিছু ক্যাসিনোর খবর দেওয়া হয়েছে। সেগুলো পর্যালোচনা করলে নিম্ন লিখিত নামগুলো বেরিয়ে আসে। এগুলো হলো (১) ভিক্টোরিয়া ক্লাব। এর সভাপতি নাকি কাজল ও সাধারণ সম্পাদক নাকি তুহিন। (২) কলাবাগান ক্লাব। এই ক্লাবটির সাথে জুয়াড়ি সেন্টুর নাম সামাজিক মাধ্যমে এসেছে। (৩) সৈনিক ক্লাব।
‘সারা বাংলা’ নামক একটি অনলাইন পোর্টালে বলা হয়েছে, মালিবাগ-মৌচাক প্রধান সড়কের পাশের একটি ভবনে অবস্থান সৈনিক ক্লাবের। অবসরপ্রাপ্ত সৈনিকদের নামে এই ক্লাব চলে। আর এটি নির্ধারিত টাকায় ভাড়া নিয়ে ক্যাসিনো খোলেন দুই জন যুবলীগ নেতা। (৪) ঢাকা গোল্ডেন ক্লাব। বনানী আহমেদ টাওয়ারের ২২ তলায় ঢাকা গোল্ডেন ক্লাব চালু করেন চাঁদপুরের দুই ব্যবসায়ী। ক্লাবটি চালুর কিছুদিনের মধ্যেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে বন্ধ করে দেয়। যুবলীগের একজন তোলাবাজ জোর করে ক্লাবটির মালিকানায় ঢুকে যায়। (৫) ওয়ান্ডারার্স ক্লাব। এই ক্লাবের অন্যতম অংশীদার নাকি একজন স্বেচ্ছা সেবক লীগ নেতা। যুবলীগের একজন অত্যন্ত প্রভাবশালী নেতার তত্ত্বাবধানে চলে এই ক্যাসিনোটি। (৬) দিলকুশা ক্লাব। এই ক্লাবটির মালিকানাও নাকি যুবলীগের একজন শীর্ষ নেতার। (৭) আরামবাগ ক্লাব। এক সময়ে ফুটপাত হকার এবং বর্তমানে মতিঝিল থানা যুবলীগের জনৈক নেতার মালিকানায় এই ক্যাসিনোটি খোলা হয়। (৮) ফুয়াং ক্লাব। তেজগাঁও লিংক রোডের ফুওয়াং ক্লাবে একসময় মদ বিক্রির পাশাপাশি নিয়মিত বসত ডিজে গানের আসর। (৯) মোহামেডান ক্লাব। সকলেই জানেন, এটি ফুটবল খেলার একটি বিখ্যাত ক্লাব। অথচ, এমন একটি জননন্দিত ক্লাবেও সকলের আড়ালে খোলা হয় ক্যাসিনো। (১০) সারা বাংলা নামক নিউজ পোর্টালে মুক্তিযোদ্ধা ক্লাব নামের একটি ক্যাসিনোর নাম উল্লেখ রয়েছে। এখানেও ক্যাসিনো চলে এবং যুবলীগের এক প্রভাশালী নেতা নেপথ্য থেকে এই ক্যাসিনো পরিচালনা করেন। (১১) ইয়াং মেনস ক্লাব। সদ্য সাবেক মন্ত্রী এবং বর্তমানে এমপি বামপন্থী নেতা রাশেদ খান মেনন এই ক্লাবটির চেয়ারম্যান। ক্লাবটির মূল চালিকা শক্তি হলেন খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, যিনি অভিযানের প্রথম দিনেই গ্রেফতার হয়েছেন। এই ক্লাবটি নাকি ক্যাসিনোর অত্যাধুনিক সরঞ্জাম দিয়ে তৈরি। ঐ সব অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি চীন থেকে আমদানি করা হয়েছে। (১২) এজাক্স ক্লাব। এলিফেন্ট রোডের এজাক্স ক্লাবেও র্যাব অভিযান চালিয়েছিল। কিন্তু ফলাফল জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয় নাই। (১৩) উত্তরার ক্যাসিনো। উত্তরায় এপিবিএন অফিসের উল্টো পাশে একটি ভবন ভাড়া করে চালু করা হয় একটি ক্যাসিনো। তাদের পার্টনার হন একজন স্থানীয় যুবলীগ নেতা।
ঢাকায় ক্যাসিনো সাম্রাজ্য গড়ে তোলার পেছনে দুই জন নেপালি নাগরিকের নাম শোনা যায়। তারা হলেন, দিনেশ ও রাজকুমার। পুলিশ এদের খোঁজ করছে কিনা জানা যায়নি। আগেই বলা হয়েছে যে, ইসমাইল হোসেন সম্রাট এখনও মুক্ত মানব আছেন। তার সাথে মুক্ত মানব হিসাবে এখনও চলা ফেরা করছেন তাদেরই ঘনিষ্ঠ সহযোগী ৭/৮ জন মানুষ।
তিন
দ্বিতীয় প্রশ্নটি ছিলো, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঠিক এই সময় এই ধরনের পদক্ষেপ নিলেন কেন? ছাত্রলীগের চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, গুন্ডামি ও মাস্তানি গত ১১ বছর থেকেই তো চলে আসছে। তাদের অর্šÍকোন্দলের ফলে বেশ কয়েকজন ছাত্র নিহতও হয়েছেন। আর যাকে তাকে হুমকি দেওয়া, ধামকি দেওয়া, চাঁদাবাজি করা এগুলো তো তাদের নৈমিত্তিক ব্যাপার। তাহলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের ভিসি ফারজানা ইসলামের নালিশের পর প্রধানমন্ত্রী ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট এবং সেক্রেটারিকে পদচ্যুত করলেন কেন? এই পদচ্যুতি নিয়ে সরকারপন্থীরা খুব ডংকা বাজিয়েছে। ছাত্রলীগের সাবেক প্রেসিডন্ট শোভন এবং সেক্রেটারি গোলাম রাব্বানী ভিসির নিকট থেকে উন্নয়ন কাজের মোট বরাদ্দের ৪-৬ শতাংশ যা প্রায় ৮৬ কোটি টাকা চাঁদা দাবি করেছে। অন্যদিকে জাবি ছাত্রলীগের নেতারা ভিসির কাছ থেকে ২ কোটি টাকা চাঁদা নিয়েছে। ২ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে বেগম জিয়াকে যদি ১০ বছর জেল খাটতে হয়, তাহলে ২ কোটি টাকা ঘুষ নেওয়ার জন্য ছাত্রলীগ নেতাদের গ্রেফতারও করা হয়নি কেন? তারা তো বহাল তবিয়তে আছে।
এরপর যুবলীগের ৩ নেতাকে গ্রেফতার ও রিমান্ডে নেওয়া হলো। এখন এই অ্যাকশনটি কেন হলো? এর উত্তর কেউ জানে না। যারাই টকশো করছেন বা কাগজে কলাম লিখছেন তারা এই অ্যাকশন নেওয়ার জন্য সরকারের গুণগান করছেন। অন্যেরা বলছেন জুয়া খেলা, ক্যাসিনো চালানো, চাঁদাবাজি করা, এগুলোতো তারা ১০ বছর ধরেই করছে। আজ হঠাৎ এই ৩ ব্যক্তির বিরুদ্ধে অ্যাকশন কেন? আসলে আমার নিজের কাছেও একই প্রশ্ন। আরও কয়েকটি পত্রিকায় দেখলাম, তারাও এ প্রশ্ন তুলেছেন। এ সম্পর্কে যুবলীগের প্রেসিডেন্ট ওমর ফারুক চৌধুরী বৃহস্পতিবার প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘হঠাৎ করে কেন জেগে উঠলেন? কারণটা কী? এটাকি বিরাজনীতিকরণের নীতিতে আসছেন? দলকে পঙ্গু করার কোনো ষড়যন্ত্রে আসছেন? নিষ্ক্রিয় করার ষড়যন্ত্রে আসছেন?’ হয়তো যুবলীগ প্রেসিডেন্টের এই মন্তব্য নিয়েও কলামিস্ট এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা গবেষণা করতেন। কিন্তু পরদিনই তিনি একেবারে ১৮০ ডিগ্রি উল্টে গেলেন। সুতরাং জল্পনা কল্পনা এবং গবেষণার সব রাস্তা শেষ। আমার কাছেও জবাব নাই, অন্য রথি মহারথিদের কাছেও জবাব নাই।
জবাব দেবে কাল বা মহাকাল। সেই সময়ের জন্য অপেক্ষা করুন।
Email: journalist [email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।