পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
সংবাদপত্রে নানা বিষয় ছবির মাধ্যমে বিবৃত বা মূর্তমান করা হয়ে থাকে। সংবাদপত্রের একটি ছবি একজন পাঠককে যত দ্রুত আকর্ষণ করতে পারে এবং পাঠকের অন্তরে যত দ্রুত রেখাপাত করে লেখা সেটা পারে না। লেখাতে ঘটনার বর্ণনায় রং থাকতে পারে, দলীয় অথবা ব্যক্তি স্বার্থের জন্য সত্য মিথ্যার বর্ণনা থাকতে পারে কিন্তু ছবি যা প্রকৃত ঘটনা তাই থাকবে। প্রতিদিন আমাদের সংবাদপত্রে অনেক ছবি ছাপা হয়, তার বিরুদ্ধে রিজয়েনটার বা প্রতিবাদ আসে না বলা যায়। এমনকি সারাবছর একটি সংবাদপত্রে যত সংবাদ চিত্র ছাপা হয় তার জন্য একটি প্রতিবাদ পত্রও পায় না, তবে মাঝে মধ্যে ভুল ক্যাপশনের কারণে সেটা ঘটলেও ঘটতে পারে মাত্র।
একজন প্রেস ফটোগ্রাফারকে যথেষ্ট সচেতন থেকে তার দায়িত্ব পালন করতে হয়। তার কাজের তুলনায় সময় থাকে অল্প। সর্বদাই তার সময়ের সাথে যুদ্ধ করে বিজয়ী হতে হয়। ইদানীং ডিজিটাল প্রযুক্তির সুবাদে ঘটনাস্থল থেকে ল্যাপটপ এবং ইন্টারনেটের সাহায্যে দ্রুত এবং সময় মত পর্যাপ্ত ছবি পাঠানো সম্ভব হচ্ছে। তবে আমাদের দেশের ফটোগ্রাফাররা এখনও সবাই এই সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করে ফটো সাংবাদিকতায় অবদান রাখতে পারছেন না। অথচ তারাই পত্রিকার প্রতিনিধিত্ব করে দেশের দুর্গম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলসহ সর্বত্র ছুটে যাচ্ছেন সবার আগে। জাতীয় ঐক্য, সংহতি রক্ষায় ফটোগ্রাফারদের ভূমিকা ঐতিহাসিক। ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, ৭১’র মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ, ৮২-৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন এবং সর্বশেষ ৯৬’র অসহযোগ আন্দলনের জীবন্ত দলিল ক্যামেরার ফ্রেমে ধারণ করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে স্বাধীনতা ও সংগ্রামী প্রেরণা যোগিয়েছেন ফটোসাংবাদিকরা। কিন্তু আক্ষেপের বিষয় হচ্ছে, সারাজীবন কাজ করেও একজন ফটোসাংবাদিক ফটো এডিটর হতে পারছেন না, বিদেশে ট্রেনিং ও প্লেজারট্রিপে পর্যন্ত যাওয়া হয় না। অনেক অফিসে নির্দিষ্ট ডেস্ক ও ফোন নেই। দেশ ও জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে পেশাগত কাজের সুযোগ তাদের দীর্ঘদিনের দাবি।
সংবাদপত্র মূলতঃ ভাষার দ্বারা সাজানো হলেও ছবি এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। ভাষা যে তত্ত¡ ও তথ্য পরিবেশন করে তাকে সচল করে তোলে ছবি। শব্দ যে চিত্র আঁকে তা জীবন্তরূপ পায় তার সাথে দেয়া ছবিতে। এমনকি শব্দ চিত্রকে অনেক সময় ছাড়িয়ে যায় ক্যামেরার ভাষা। তাই, ক্যামেরা শুধু ছবি তুলে না- এতে ভাষাও দেয়, শিল্প সৌন্দর্য আনে, চিরন্তনতা দান করে। তাই, ফটোসাংবাকিতাকে সাংবাদিকতার একটা নিছক অনুজ অঙ্গ বলে অবহেলা করার অবকাশ নেই। একে গণ্য করতে হবে সংবাদপত্র মাধ্যমের একটি অপরিহার্য শ্রম বিভাগ, শিল্প ও নান্দনিকতার বিষয় হিসেবে।
বিগত চার দশক ধরে এদেশে ফটোসাংবাদিকতা ক্রমান্বয়ে বিকশিত হয়ে আসছে। এর মধ্যে সংবাদত্রের মাধ্যমে প্রতিটি অঙ্গের বহুবিদ বিকাশ ঘটেছে; বিকশিত হয়েছে ফটোসাংবাদিকতার নানা আঙ্গিক ও বৈশিষ্ট্য। তবে ফটোসাংবাদিকতার যথাযথ স্বীকৃতি, এর সমস্যা, উন্নয়ন, পেশাগত ঝুঁকি ও তার প্রতিবিধান নিত্যকার নানা বিষয়ের আলোচনার ও দিকনির্দেশনা নির্ধারণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। বাংলাদেশে ফটোসাংবাদিকতার উন্নয়নে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত (ক) একজন ফটোসাংবাদিকের জন্য, (খ) একটি সংবাদপত্রের জন্য, (গ) সরকারের জন্য এবং (ঘ) জনগণের জন্য।
(১) একজন ফটোসাংবাদিকের অবশ্যই ছবির গুরুত্ব বুঝার মতো শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকতে হবে। পেশাগত জীবনে সহকর্মীদের প্রতি সহমমির্তা থাকতে হবে। (২) সংবাদপত্রগুলো সমঝোতার ভিত্তিতে এবং উপযুক্ত সম্মানী প্রদানের বিনিময়ে ফ্রিল্যান্সারদের কাজের পরিধি বৃদ্ধি করে আরো বেশি লাভবান হতে পারে। (৩) কোনো নির্দিষ্ট গ্রুপ সুস্পষ্টরূপে দাবি না করলে সরকার কোনো সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে না। তাই এ ধরনের দাবি আসতে হবে ফটোসাংবাদিকদের অভিন্ন স্বার্থে। (৪) মনে রাখতে হবে, জনগণ বরাবরই ভালো কাজের প্রতি সমর্থন দেয় এবং জনগণের আস্থা অর্জনে ফটোসাংবাদিকদের পেশাগতভাবে নিজেদের যোগ্য হিসাবে গড়ে তুলতে হবে।
ভারত বর্ষে ফটো সাংবাদিকতার শুরু ১৯৩০ সাল থেকে। আমাদের দেশে পত্রিকায় ফটোর ব্যবহার শুরু হয় পঞ্চাশের দশকে। বিশেষ বিশেষ ঘটনা বা পত্রিকার চাহিদা মত। কাঠের বাক্সে সেই ছবি আঁকা হতো, দেখলে চিনা যেত না, তবুও উদ্দীপনা ও আনন্দ নিয়ে শুরু হয়েছিল ফটো সাংবাদিকতা। এই সাহসী ও সৃজনশীল কাজে মাত্র কয়েকজন ফটোগ্রাফার এগিয়ে আসেন। বেশি দিনের কথা নয়, আমি যখন এই পেশায় আসি তখন প্রায় সকল অগ্রজ ফটো সাংবাদিকরা কর্মরত ছিলেন। তাদের মধ্যে মোজাম্মিল হোসেন, কামরুল হুদা, রশীদ তালুকদার, গোলাম মাওলা, আকিল খান, ইয়াকুব ভাই, লাল ভাই, আলহাজ্ব জহিরুল হক, আফতাব আহম্মেদ, মো. কামরুজ্জামান, মোহাম্মদ আলমসহ আরও অনেকেই। তাদের মধ্যে অনেকেই ইহলোক ত্যাগ করেছেন। আমার সৌভাগ্য হয়েছে তাদের অনেকের সাথে কাজ করার। তাদের ত্যাগ, নিষ্ঠা আজকে আমাদেরকে করেছে সম্মানিত। তাদের বক্স ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলার সীমাবদ্ধতার কথা ভাবলে অবাক হতে হয়, কীভাবে তারা গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনার বিশেষ করে ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬৯’র গণআন্দোলন, ৭১’র মহান মুক্তিযুদ্ধের ছবি তুলেছেন। আটটি অথবা বারটি এক্সপোজার দেওয়া যেত একটি ফিল্মে। কোন ওয়াইড, টেলি, ঝুম লেন্সের ব্যবহার সুযোগ নেই। সীমিত ও সীমাবদ্ধ প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করতে হতো সময়ের সাথে যুদ্ধ করে। ঘটনার সাতদিন পরেও হয়তো ছবি তুলি ঢাকা পৌঁছাতে ফিল্ম ডেভেলপ ও ছবি প্রিন্ট ও প্রসেস করে নিউজ টেবিলে ছবি পৌঁছাত। সেই ছবি এখন এক একটি ইতিহাস হয়ে আছে। এনালগ প্রযুক্তির ফটোগ্রাফি সত্যি অনেক কঠিন ছিল।
সেই সব ক্যামেরা চলে যাওয়ার পর এস.এল.আর ক্যামেরা, লেন্স, ফ্ল্যাশ, রোল ফ্লিম নানান সুবিধা যুক্ত ক্যামেরা প্রযুক্তি পাওয়া শুরু হল। এই সময় আমাদের দেশে ফটো সাংবাদিকতার বিকাশ ঘটে। নতুন পত্রিকা বের হয় এবং পেশাদার ফটোগ্রাফার তৈরি হতে থাকে। সাদাকালো ছবি পত্রিকায় ব্যবহার করা হতো। একটি পত্রিকা রঙিন বিজ্ঞাপন পেলে রঙিন ছবি ব্যবহার করতে শুরু করে ১৯৯৫ সালের দিকে। রঙিন ছবির ব্যবহার ধীরে ধীরে প্রায় সব পত্রিকায়ই শুরু হয়ে যায়। ফটোগ্রাফার তার প্রয়োজনে নতুন করে যাত্রা শুরু করেন। তখন পর্যন্ত ফটোগ্রাফার নিজে নিজে করতে করতে শিখে দক্ষতা অর্জন করছে। ফটো সাংবাদিকদের চরম প্রতিকূলতার মধ্যে কাজ করতে হয়। এই জন্য চাই তার যথাযথ মূল্যায়ন। একজন টেনিস বা ক্রিকেট খেলোয়াড় সারা জীবন ভালো খেলতে পারে না, তেমনি ফটো সাংবাদিক তার বয়সের সাথে কাজ করতে পারে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত। কেননা শারীরিকভাবে ফিট না থাকলে ফটো সাংবাদিকতায় অযোগ্য হতে বাধ্য।
যাইহোক, ফটো সাংবাদিকতার অতীত ছিল সংগ্রামে পরিপূর্ণ। অতীতে ফটোসাংবাদিকদের সংগ্রাম ও ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত সুফল বর্তমান প্রজন্মের ফটোসাংবাদিকরা ভোগ করছেন। আজকে ডিজিটাল প্রযুক্তিতে কত সহজে, কত দ্রুত সংবাপত্রে ফটো সাংবাদিকতার কাজ করছে এটা তাদেরই ফসল। ফটোগ্রাফির অনেক সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি পেয়েছে সত্য, কিন্তু ফটো সাংবাদিকতার উৎকর্ষতা সেই সাথে বাড়েনি। দুঃখের সাথে বলতে হয়, ফটোগ্রাফারের মর্যাদা বেড়েছে, মজুরী বেড়েছে, ফটোগ্রাফির প্রযুক্তি উন্নত হয়েছে সেই তুলনায় ফটোগ্রাফারের মান বাড়েনি। আমাদের অতীত ও বর্তমানকে মূল্যায়ন করবে ভবিষ্যত। তবে আমরা আশাবাদী, বাংলাদেশে ফটো সাংবাদিকতার মান অনেক উন্নত দেশের চাইতে বেশি এবং ভালো পেশা হিসেবে আজকে জাতীয়ভাবে এর মর্যাদার স্বীকৃতি পেয়েছে। এটাও সত্য যে, অপেশাদার ফটো সাংবাদিক দিয়ে বাজার ভরে গেছে। একটি ক্যামেরা নিয়ে সাধারণ মানুষকে নানানভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে এই মহান পেশার ঐতিহ্য ও মর্যাদা ক্ষুন্ন করে চলছে এক শ্রেণির টাউট। এর থেকে মুক্ত হওয়ার সংগ্রামে সবাইকে শরীক হওয়ার আহবান জানাচ্ছি।
কর্তব্যরত প্রেস-ফটোগ্রাফাররা সাংবাদিক হিসেবে একটা বিশেষ মর্যাদার অধিকারী সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। তাঁরা যথেষ্ট মর্যাদা পেয়েও থাকেন, আবার অনেক ক্ষেত্রে অপদস্থ হয়েও ফিরতে হয় তাঁদের। বিচক্ষণ ফটোগ্রাফাররা বাইরে কোনো অমর্যাদার ব্যাপার ঘটলে তা নিয়ে সেখানে বিশেষ হৈ চৈ করেন না। কোনো ধরনের অনুষ্ঠানে কীভাবে ছবি তুলতে হবে এ ব্যাপারে তাদেরকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অনেকেই আজ ফটো সাংবাদিকদের দাওয়াত করেন না বা করতে চান না, কিন্তু কেন তা খুঁজে বের করতে হবে। সরকার এবং রাজনৈতিক দলের লেজুর-বৃত্তিতে যদি ফটোসাংবাদিকরা সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়ে তবে পরিণামে সমাজে ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া হতে পারে।
কোনো অনুষ্ঠান বা প্রেস কনফারেন্সে আমন্ত্রণ ছাড়া যেতে পারি বা পারি না তা সুস্পষ্টভাবে জানা থাকা রকার। কারণ আজকাল এসব বিষয়ে মুখরোচক কথা শোনা যায়। ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও প্রাইভেসি সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা থাকা দরকার। কোন কোন ক্ষেত্রে ছবি তুলতে এবং প্রকাশ করতে পারা যাবে বা পারা যাবে না সে বিষয়ে বিভিন্ন দেশে কড়াকড়ি আইন আছে এবং তা অমান্য করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে যোগদানের ক্ষেত্রে আমাদের পোশাক পরিচ্ছদ ও নিয়মানুবর্তিতা সম্পর্কে জানা থাকা দরকার, এ ক্ষেত্রে অনেকেই যথাযথ নিয়ম-নীতি মানতে ব্যর্থ। অনুষ্ঠানে উপস্থিত দর্শকদের সমস্যা ও অনুষ্ঠানের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন না করে কীভাবে কাজ করা যায় তার সঠিক গাইড লাইন থাকা আবশ্যক।
পেশার স্বাধীনতা ও সাংবাদিকতার ভাবমর্যাদা রক্ষা করা এবং দায়িত্ব পালনে ঐক্যবদ্ধভাবে সিদ্ধান্তে আসা প্রয়োজন। প্রযুক্তির পরিবর্তনে বিপ্লব হয়েছে। সেই তুলনায় আমাদের দায়িত্ব আচরণে এবং মান উন্নয়নে পরিবর্তন আসেনি। সম্মিলিতভাবে পরস্পর সহযোগিতার ভিত্তিতে দায়িত্ব পালন করলে ফটো সাংবাকিদের ভাবমর্যাদা উজ্জ্বল করা সম্ভব হবে। আমাদের সীমাবদ্ধতা এবং সমস্যা অনেক, এগুলো তুলে ধরে সমাধান করা উচিত। পেশাগত অধিকার ও মর্যাদা, সচেতনতা ও নৈতিকতার বিষয়টি সম্পর্কে নবীনদের যথাযথভাবে পালনে কোনো নির্দেশ ও জবাবদিহিতা নেই। আত্মসমালোচনা করে ত্রুটিমুক্ত হয়ে সুশৃঙ্খল ও নৈতিকতার সাথে জাতীয় স্বার্থে পেশাগত কাজে ভূমিকা রাখাই একজন আদর্শ ফটো সাংবাদিকের লক্ষ্য হওয়া উচিৎ।
লেখক: সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ফটোজার্নালিস্ট এসোসিয়েশন
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।