পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
দেশের পুঁজিবাজার নিয়ে তো আর কম পানি ঘোলা হলো না! গত ১০ বছর ধরেই অস্থিরতা বিরাজ করছে পুঁজিবাজার ঘিরে। চলতি বছর বাজেট ঘোষণার পর থেকে বাজার আরো অস্থির। দেশের নামকরা কোম্পানির শেয়ার কিনেও সাধারণ মানুষ ঠকবে কেন? পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রকদের অনেকে সাধারণ বিনিয়োগকারীকে কিভাবে ঠকাবেন সে চর্চাই শুধু করেন কী? না হয়তো একটি বিষয়ের সমাধানে এক দশক পেড়িয়ে গেলো, তারপরও যেই সেই? গত ছয় মাসে ব্যাপক দরপতনের কারণে পুঁজিবাজার প্রায় ৪৮ হাজার ৬২৫ কোটি টাকার মূলধন হারিয়েছে। পুঁজিবাজার চাঙ্গা করতে প্রয়োজন দক্ষ, যোগ্য ও সৎ নেতৃত্ব। সেখানে সরকার পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। গত ১০ বছরে ভালো শেয়ারপত্র বাজারে আসেনি। এর মূল কারণ- বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকট, সিন্ডিকেট কারসাজি, মানহীন কোম্পানির আইপিও, সুশাসনের ঘাটতি ও নিয়ন্ত্রণ সংস্থার সঙ্গে দ্ব›দ্ব। এসব বন্ধ করতে না পারলে পুঁজিবাজারে বড় ধস নামবে। তাই সবার আগে উচিত কারসাজি বন্ধ করা। প্রতিবারই সিন্ডিকেটের কারণে সব উদ্যোগ ভেস্তে যায়। এ জন্য কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। যারা পুঁজিবাজার অস্থির করার কারসাজিতে জড়িত, যারা সিন্ডিকেট করে, তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। পুঁজিবাজারে আস্থা ফেরাতে সিন্ডিকেট ভেঙে দিয়ে সরকারের মনিটরিং সেল বাড়াতে হবে।
গত ১৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে এনইসি সম্মেলনকক্ষে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সঙ্গে ‘পুঁজিবাজারের উন্নয়নের লক্ষ্যে অংশীজনদের সঙ্গে মতবিনিময়’ শীর্ষক বৈঠকের খবরে সপ্তাহের প্রথম দুই কার্যদিবস শেয়ারবাজারে কিঞ্চিৎ ঊর্ধ্বমুখীতার দেখা মিললেও তা স্থায়ী হয়নি। অর্থমন্ত্রী জানান, সরকারি ভালো ভালো কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে আনা হবে এবং বাজারে এলে কোম্পানিগুলো যাতে ন্যায্যমূল্য পায়, সে ব্যবস্থাও করা হবে। অর্থমন্ত্রী আরো বলেন, ‘বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ‘ইন্টারনাল অডিট কমিটি’ গঠন করবে। কোম্পানিগুলোর শেয়ারের ন্যায্যমূল্য পায়, কোনো কোম্পানির শেয়ারের দাম যেন অতিমূল্যায়িত না হয়, সেদিক নজর রাখবে ওই কমিটি।’
পুঁজিবাজার চাঙ্গা করতে সরকারের পক্ষ থেকে আস্থার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। বিনিয়োগকারীদের প্রণোদনার ঘোষণা দিতে হবে। বিনিয়োগকারী ছাড়াও যারা শেয়ারবাজার নিয়ে কাজ করেন এবং গবেষণা করেন, তাদের সঙ্গে অর্থমন্ত্রী ও পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের একসঙ্গে বসতে হবে। বারবার বসতে হবে। আলোচনা করে এর উন্নয়নে দিকনির্দেশনামূূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পথ খুঁজতে হবে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পুঁজিবাজার আরো আধুনিক করতে হবে।
শেয়ারবাজারে অনেক মানুষের অর্থ, স্বপ্ন শ্রম যুক্ত রয়েছে। এখানে কোনো সিন্ডিকেট বা মোড়লদের স্থান দেয়া যাবে না। বিনিয়োগকারীরা ভালো কোম্পানি চায়; কিন্তু ভালো কোম্পানিকে আসতে হলে যে দর দেওয়া প্রয়োজন, সেটি দেওয়ার মতো নির্দিষ্ট সুযোগ বর্তমান পদ্ধতিতে আছে কী? শেয়ারবাজারে কোনোভাবেই কালো হাত পড়তে দেওয়া যাবে না। ভারসাম্যহীন বাজারে আস্থাহীনতা বাড়ে। বেশির ভাগ কোম্পানির শেয়ারের দাম কমেছে তো কমছেই। এর মধ্যেই পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির সঙ্গে ডিএসইর দ্ব›দ্ব চলছে বলে গণমাধ্যমে জানা যায়। মুদ্রাবাজার ও পুঁজিবাজার একে অপরের প্রভাবক, সেহেতু এ দুটি বাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যে এতদ্বিষয়ক প্রয়োজনীয় সমন্বয় বাড়ানো জরুরি। বিশ্লেষকরা বলছেন, বাজারে অর্থপ্রবাহ কমে যাওয়ায় ক্রমাগত দরপতন হচ্ছে। প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) নিয়ে বিভিন্ন কোম্পানির অনিয়মও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। সার্বিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে সরকারকে পুঁজিবাজারে আস্থা ফেরানোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
যে কোনো উন্নয়ন, আঁধারে নয়, আলোতে অর্জিত হয়। পুঁজিবাজারকে গতিশীল করতে হলে এর ব্যবস্থাপনা আলোতে আনতে হবে। দুর্নীতি-অনিয়ম দূর করতে হবে। বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের সুরক্ষার তৈরি হলে সাদা টাকা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের হবে। লুটেরা ও সিন্ডিকেট কোনো নীতিবাক্য শোনে না। চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনির মতো। মানহীন কোম্পানিতে বাজার সয়লাব। মুষ্টিমেয় কিছু কোম্পানি আছে মানসম্পন্ন। পুঁজি বিনিয়োগ করে বিনিয়োগকারী যেন স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। অশুভ শক্তির করালগ্রাস থেকে পুঁজিবাজার মুক্ত রাখতে পারলেই পুঁজিবাজার চাঙ্গা হবে।
বর্তমানে দেশের অর্থনীতি যে শক্তিশালী, এটি বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। তাহলে অর্থনীতির প্রভাব পুঁজিবাজারে পড়ছে না কেন? দেশের টেকসই জিডিপি প্রবৃত্তির স্বার্থে অস্থিতিশীল শেয়ারবাজারে স্থিতিশীলতায় বিশেষ নজর দেওয়া দরকার। ভালো কোম্পানি, বহুজাতিক কোম্পানিগুলো কেনো বাজারে আসছে না খতিয়ে দেখে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। শুধু সভা-সেমিনারে বহুজাতিক কোম্পানি তালিকাভুক্ত করার আওয়াজ না দিয়ে তাদের সঙ্গে বসতে হবে, চাপ প্রয়োগ করতে হবে। বাজারে ভালো শেয়ারের জোগানের সাথে বিনিয়োগকারীদের আস্থা নিশ্চিত করতে পারলে বাজার আবার ঘুরে দাঁড়াবে ।
বরাবরই যখন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়, ‘শতকোটি টাকা বাজার থেকে নেই, কে বা কারা নিয়ে চলে গেছে’, তখনই কর্তৃপক্ষ নড়েচড়ে বসে। এতে যেটি হয় তা হলো, সাধারণ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সর্বস্ব হারিয়ে অনেকে পথে বসে যায়। কেন এসব হয় তার নেপথ্য কারণ চিহ্নিত করতে হবে। পুঁজিবাজার তখনই চাঙ্গা হবে, যখন বিনিয়োগকারীরা আস্থা খুঁজে পাবে। বাজারে কোনো ধরনের অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটবে না। পুঁজিবাজারের যেসব বিনিয়োগকারী আছে, তারা বাজারের উপর আস্থা প্রতিনিয়ত হারিয়েছেন এবং হারাচ্ছেন। আলোচনা অনেক হয় কিন্তু বিনিয়োগকারীরা হাতে কিছু পায়নি। কেন ব্যাংকে হাজার হাজার কোটি টাকা মানুষ অলস ফেলে রেখেছে? কেন তারা বিনিয়োগ করছে না? কেন মানুষ পুঁজিবাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে? এসব বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে হবে। টক শো আর গোলটেবিল বৈঠক করে পুঁজিবাজারের উন্নয়নে কিছুই হবে না।
বিশ্বের প্রতিটি দেশে অর্থনীতি যতটা গতিশীল, পুঁজিবাজারও ততটাই গতিশীল থাকে। অর্থনীতির মৌলিক এলাকা বলা হয় পুঁজিবাজারকে। এজন্য পুঁজিবাজারকে অবহেলার কোনো সুযোগ নেই। পুঁজিবাজারের উন্নয়ন ছাড়া সামনে এগোনো সম্ভব নয়। নিয়ন্ত্রক সংস্থা যেনতেন প্রকারে বাজারে শেয়ারের জোগানই শুধু বাড়িয়েছে। কোম্পানি বা শেয়ারের মানের দিকে নজর দিয়েছে বলে মনে হয় না। ফলে নিম্নমানের ও দুর্বল ভিত্তির এসব কোম্পানির বেশির ভাগই তালিকাভুক্তির কিছুদিন পরই তাদের অবস্থান ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। এ সংকট থেকে উত্তরণের উপায় হচ্ছে বাজারের তারল্য সংকট দূর ও বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতা কাটাতে পদক্ষেপ গ্রহণ। নতুন কোম্পানির তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে আরো যাচাই-বাছাই করে শুধুমাত্র যোগ্য কোম্পানিকে অনুমোদন দিতে হবে। বিনিয়োগকারীদের স্বল্প মেয়াদে বিনিয়োগের পরিবর্তে দীর্ঘ মেয়াদে বিনিয়োগে উৎসাহের সাথে শিল্পোদ্যোক্তাদের পুঁজিবাজারকে ব্যাংকের বিকল্প অর্থায়নের উৎস হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।
অর্থমন্ত্রী যথাযথ মূল্যে প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) আনা ও সুশাসন বজায়ের জন্য একটি বিশেষ কমিটি গঠন করার পরামর্শ দিয়েছেন। একথা ঠিক, ঢালাওভাবে কোম্পানির আইপিও দেওয়া হয়। আইপিও অনুমোদনের সময় প্রতিবেদনে বাস্তবচিত্র না দেখিয়ে একটি রোজি পিকচার দেওয়া হয়। যার ফলে লেনদেনের প্রথম দিকে দাম বাড়ে আর কিছুদিন পর দাম কমে যায়।
‘এখন থেকে আর কেউ অপবাদ দিতে পারবেন না যে সরকার ন্যায়বিচার করে না অথবা কারোর প্রতি দুর্বল’, এমন মন্তব্য করে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘পুঁজিবাজারে যিনি অপরাধ করবেন, তিনি যেই হোন না কেন, তাকে আইনের আওতায় আসতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘বাজারে যেটা প্রয়োজন, সেটা হচ্ছে সুশাসন। আমরা আপনাদের আশ্বস্ত করতে পারি যে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠান করেই এই বাজার প্রতিষ্ঠা করা হবে। আমরা কারও প্রতি দুর্বল নই। যিনি অপরাধ করবেন, তিনি যতবড় শক্তিশালী হোন না কেন, তাকে আমরা আইনি প্রক্রিয়ায় বা আইনি কাঠামোই নিয়ে আসব।’
পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ভয় ঢুকে রয়েছে। মানুষ পুঁজি বিনিয়োগ করবে, সেই পুুঁজি বিনিয়োগের জায়গা কোথায়? পুঁজি বিনিয়োগ হলে সঙ্গে সঙ্গে উড়ে এসে জুড়ে বসে কিছু অর্থ আত্মসাৎকারী। এসব মানুষকে যত দিন এই সংস্থা থেকে সরানো না হবে, তত দিন পুঁজিবাজারের সুফল পাওয়া যাবে না। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত করে বাজারের প্রতি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। পুঁজিবাজারে যারা প্রভাব খাটিয়ে ধস নামায় এবং নিজেদের আখের গোছানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত থাকে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এছাড়া সমন্বিত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পুঁজিবাজারকে একটি সক্ষমতার জায়গায় নিয়ে যেতে হবে। যাতে পুঁজিবাজার দীর্ঘ মেয়াদে একটি অবস্থান ধরে রেখে আরও সামনে এগুতে পারে।
রাষ্ট্রের অর্থনীতিকে ধ্বংস করার মূল হোতা হলো কতিপয় দুর্নীতিবাজ, লোভীরা। সুষ্ঠুভাবে, মুক্তমনে নির্ভয়ে, দেশের মানুষ যদি যার যা সম্বল আছে, তা নিয়ে পুঁজি বিনিয়োগ করতে পারতো, তাহলে দেশের অর্থনীতির চেহারা আর বেকারত্বের হার অনেক পরিবর্তন হতো।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।