পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
চট্টগ্রামে এসডিসি অর্জনে ক্ষুদ্র অর্থায়ণ প্রতিষ্ঠানসমূহের ভূমিকা শীর্ষক আঞ্চলিক সম্মেলনে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেছেন, ঋণ দিতে হাজার হাজার লোক ঢাকায় ব্রিফকেস নিয়ে হাঁটছে। বাংলাদেশকে বিলিয়নস অব ডলার ঋণ দিতে চায় বিশ্বব্যাংক, এডিবি, আইএমএফ, চাইনিজ ব্যাংকসহ অন্যরা। তাহলে আমরা কেন ডোনার ফান্ড চাইবো? তিনি আরো বলেছেন, অর্থনীতির চাকা ঘুরছে। মাথাপিছু আয় দ্রুত বাড়ছে। প্রয়োজন হলে আমরা ঋণ নেবো। আবার সময়মত পরিশোধও করবো। পরিকল্পনামন্ত্রীর এই বক্তব্যের মধ্যে আত্মশ্লাঘাবোধের পরিচয় আছে বলে অনেকে মনে করতে পারেন। আবার অনেকের মধ্যে প্রশ্ন উঠতে পারে, ডোনার ফান্ড নেয়াতে যদি জাতীয় মর্যাদার হানি ঘটে তবে ঋণের টাকা নেয়াতে সেই মর্যাদা সুরক্ষা হয় কিভাবে? বলা বাহুল্য, দান-অনুদান নেয়াতে জাতীয় মান-মর্যাদা ক্ষুন্ন হয়, অন্যের কাছে জাতি হেয় প্রতিপন্ন হয়। আমাদেরও একটা সময় ছিল যখন বিদেশ থেকে প্রচুর দান-অনুদান আসতো। তখন অনেকে আমাদের ‘হতদরিদ্র’ ‘মিসকিন’ বলে অভিহিত করতো। তখন দেশকে ‘তলবিহীন ঝুঁড়ি’র দুনাম পর্যন্ত দেয়া হয়েছিল। এখন আর সেদিন নেই। এখন বিদেশী দান-অনুদান কমতে কমতে প্রায় তলানিতে এসে ঠেকেছে। এই দান-অনুদান না হলেও চলে। এটা অবশ্যই দেশের ইতিবাচক অথনৈতিক পরিবর্তনের পরিচয় বহন করে। এটা যেমন সত্য, তেমনি বিগত দিনগুলোতে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ বাড়তে বাড়তে এখন এমন পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যে, ঋণের বার্ষিক সুদ পরিশোধ করতে গিয়ে জাতীয় বাজেটের সবচেয়ে বড় অংকটি বেরিয়ে যায়। মাথাপিছু, বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। জাতি ও জনগণের ঘাড়ে ক্রমবর্ধনমান হারে চেপে বসা ঋণের এই বোঝা পরিশোধ করতে হবে। ‘লাভের ধন পিঁপড়ায় খায়’ বলে একটি প্রবাদ আছে। ঋণের ক্ষেত্রে এ প্রবাদটি বিশেষভাবে প্রযোজ্য। ‘ঋণের টাকায় ঘি খাওয়া’ বলে আরো একটি কথা আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে। ঋণের টাকায় ঘি খাওয়া যায় বটে, কিন্তুু যারা এটা করে, তাদের তথাকথিত ‘সুখের দিন’ দ্রুত শেষ হয়ে যায়। ভিটে-মাটি হারিয়ে হাতে ওঠে লোটা-কম্বল। ঋণ দারিদ্র বৃদ্ধির একটা প্রধান কারণ। আর দারিদ্রের মধ্যে কোনো সম্মান নেই। একথা ব্যক্তির ক্ষেত্রে যেমন জাতির ক্ষেত্রেও সমান সত্য। কাজেই ঢাকার রাস্তায় ঋণদাতা হাজারে হাজারে ঘুরছে। ঋণদাতা সংস্থাগুলো হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে এক পায়ে খাড়া হয়ে আছে, এধরনের কথা বলে আত্মপ্রসাদ লাভ করার কোনো মানে হয় না। ঋণগ্রহীতার কোনো সম্মান নেই। ঋণের টাকায় বাহাদুরিরও কিছু নেই।
বিশ্বে দারিদ্রের ভুগোল বেশ বড়। কোটি কোটি মানুষ দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত। তৃতীয় বিশ্ব বলে কথিত বিশ্বের দেশগুলোতে দারিদ্র সেই যে কোনো এক কালে চেপে বসেছে, আজ পর্যন্ত তা থেকে তাদের রেহায় হয়নি। দারিদ্র বিমোচনে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন উদ্যোগ ও কর্মসূচী আছে। তবে অগ্রগতি সামান্যই। বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদী ও ধনী দেশগুলো দরিদ্র বিশ্বের জন্য কিছু দান-অনুদান প্রদান করে। আর দেয় উন্নয়নের নামে ঋণ। বিশ্বব্যাংক, এডিবি, আইএমএফ প্রভৃতি অর্থলগ্নিকারী সংস্থা দারিদ্র বিমোচনে ঋণ দিয়ে থাকে। এই সংস্থাগুলাও আসলে সাম্রাজ্যবাদী ও ধনী দেশগুলোর নিয়ন্ত্রণে। এইসব দেশ ও আর্থিক সংস্থার নীতি হলো, ঋণ-অনুদান এমনভাবে দেয়া যাতে দারিদ্র অবস্থা চরমে না ওঠে আবার দারিদ্র বিমোচনও না হয়। দারিদ্রের স্থায়ীত্বই তারা চায়, যাতে শোষণ ও নিয়ন্ত্রণ সহজে বজায় রাখা যায়। বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ’এর ঋণে কোনো দেশ দারিদ্রমুক্ত ও স্বচ্ছল হয়েছে, আজ পর্যন্ত এর কোনো প্রমাণ নেই। বরং এসব সংস্থার ঋণ নিয়ে কোনো কোনো দেশে দারিদ্র বৃদ্ধি পেয়েছে, জনগণ বিপর্যয় চরমে উঠেছে। এ কারণে বিশ্বের কিছু দেশ ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ থেকে ঋণ নেয়া বন্ধ করে দিয়েছে। এ দুটি সংস্থার ঋণের শর্ত এমন যে, তাতে কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও দরিদ্র বিমোচন সম্ভব নয়। মনে রাখতে হবে, অর্থলগ্নিকারী এই সংস্থা দুটি যেহেতু ঋণ দেয়ার জন্রই তৈরি, সুতরাং তারা ঋণের ফেরী করবে, এটাই স্বাভাবিক। যখন বিশ্বের আরো অনেক দেশ বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ’এর ঋণ না নেয়ার চেষ্টা করছে তখন বাংলাদেশকে স্বেচ্ছায় এই দুটি সংস্থার খপ্পরে পড়ার কোনো অর্থ হতে পারেনা। যতটা সম্ভব এদের থেকে দূরে থাকাই বিধেয়।
নিজের শক্তি ও সামর্থ অনুযায়ী উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন করতে পারলে সেটাই হতে পারে বাস্তবসম্মত ও টেকসই উন্নয়ন। তবে যেহেতু আমাদের অর্থনৈতিক শক্তি ও সামর্থ উন্নয়নের প্রয়োজন ও আকাঙ্খার তুলনায় যথেষ্ট নয়, তাই বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হতে হয়। এক্ষেত্রে আমাদের অবশ্যই ঋণের সুদ, পরিশোধের সময়সীমা ইত্যাদিসহ শর্তাদির প্রতি নজর রাখতে হবে। জাতীয় স্বার্থের অনুকূল হলেই কেবল সেই ঋণ নেয়া যেতে পারে। যে কোনো দেশ বা সংস্থার কাছ থেকে ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে এসব বিষয় কতটা বিবেচনা করা হয়, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। আরো একটি বিষয় স্মর্তব্য, ঋণ গ্রহণ করাই যথেষ্ট নয়, তা সুচারুরূপে ব্যবহার বা কার্যকর করার ওপরই প্রত্যাশিত সফল্য নির্ভর করে। ঋণের অর্থ ব্যবহার করার ক্ষেত্রে আমাদের দক্ষতা ও যোগ্যতার অভাব রয়েছে বলে বিভিন্ন সময় অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়টিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রণিধানযোগ্য যে, দেশে আইনের শাসন, সুশাসন, সুবিচার, দায়িত্বনিষ্ঠা ও জবাবদিহিতা নেই। এসব না থাকলে অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো অর্থনৈতিক ও উন্নয়নমূলক কার্যক্রমেও সফলতা আসতে পারে না। এখন আমাদের অর্থনীতির অধিকাংশ সূচকই নেতিবাচক। ঘুষ, দুর্নীতি, অর্থপাচার, লুটপাট সমানে চলছে। রাজস্ব আয় আশানুরূপ নয়, রফতানী আয় ও প্রবাসীদের রেমিটেন্স কমছে, আমদানী বাড়লেও রফতানী হ্রাস পাচ্ছে, গার্মেন্টসহ বিভিন্ন শিল্প কারখঅনা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে যাতে উৎপাদন ব্যহত হচ্ছে এবং হাজার হাজার শ্রমিক-কর্মচারী বেকার হয়ে যাচ্ছে। এসব দেশের জন্য, দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য অশনিসংকেত। এদিকে আমাদের বিশেষভাবে নজর দিতে হবে। ঘুষ, দুনীতি, চাঁদাবাজি, জুয়াসহ সকল দুর্বৃত্তাচার বন্ধ করতে হবে। ব্যাংক, শেয়ারবাজারসহ অন্যান্য ক্ষেত্রের ধস ঠেকাতে হবে। অর্থ পাচার, হুন্ডিকারবার রহিত করতে হবে। এসব ক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হলে উন্নয়নের জন্য অর্থের অভাব হবে না। পরনির্ভর নয়, আত্মনির্ভর অর্থনীতিই উন্নয়ন প্রত্যাশা পূরণ করতে পারে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।