Inqilab Logo

সোমবার ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কাশ্মীর ইসলাম : দুই সুফী সাধকের অবদান

মুনশী আবদুল মাননান | প্রকাশের সময় : ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

কাশ্মীরে ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে বেশী অবদান ইসলাম প্রচারক ও সূফী-দরবেশদের। মুসলিম শাসকরাও এক্ষেত্রে অনন্য ও অসাধারণ ভূমিকা পালন করেন।

একদা কাশ্মীরের জনগণের একাংশ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিল। হিন্দুর সংখ্যাও বৌদ্ধদের চেয়ে কম ছিল না। এই বৌদ্ধ ও হিন্দু জনগোষ্ঠী কালক্রমে প্রায় শতভাগ ইসলামের অনুসারী হয়ে যায়। ইতিহাস থেকে দেখা যায়, ইসলাম যেখানেই বিজয়ী ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেখানে স্থানীয়দের স্বাধীনতা, স্বকীয়তা এবং ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতির ওপর পারতপক্ষে হস্তক্ষেপ করেনি। ইসলামের মূল শিক্ষা, দর্শন এবং অনুসরণীয় অপরিহার্য বিষয়গুলোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিষয়াবলীই শুধু নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

কাশ্মীরের ক্ষেত্রেও এটা লক্ষ্য করা গেছে। কাশ্মীরিদের স্বাধীনতা বিনষ্ট না করে ইসলামের সঙ্গে বিরোধীয় নয়, এমন অনুসরণীয় আচার-সংস্কৃতির ওপর আঘাত না হেনে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সাধন করেছিলেন মুসলমান শাসকগণ। তাদের দিক-নির্দেশনা দানসহ সব রকমের সহযোগিতা প্রদান করেছিলেন সূফী-দরবেশগণ।

যতদূর জানা যায়, ১১১৮ সালে মধ্যএশিয়া থেকে আগত জুল কদর খান (যিনি তাতার জুলজু নামেও পরিচিত ছিলেন) কাশ্মীরে অভিযান চালান। তার কয়েক মাসের এই অভিযানের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো কাশ্মীরিদের সঙ্গে ইসলামের পরিচয় ঘটে।

তবে কাশ্মীরে ইসলামের গভীর প্রভাব বিস্তৃত হয় অষ্টম শতকের পরে। এক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করেন দু’জন সূফী সাধক। এদের একজনের নাম হযরত বুলবুল শাহ কলন্দর। অন্য জনের নাম সাইয়েদ আলী হামাদানি। হযরত বুলবুল শাহ কলন্দর ইরান বা মধ্যএশিয়ার কোনো দেশ থেকে ইসলাম প্রচারের জন্য কাশ্মীরে আসেন। তার প্রচারকর্মের মধ্যদিয়ে ইসলামের প্রসার ঘটতে থাকে।

তখন কাশ্মীরের শাসক ছিলেন বৌদ্ধ রাজা রিনচানা। তিনি হযরত বুলবুল শাহ কলন্দরের কাছে সপরিবারে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন। এটা ছিল সে সময় বিপুল আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা। কাশ্মীরি সমাজে এর ফলে এক বিরাট পরিবর্তনের সূত্রপাত হয়। রাজার অনুসরণে জনসাধারণের একটা বিরাট অংশ ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে যায়। রাজা রিনচানা সম্পর্কে যতদূর জানা যায়, তিনি ছিলেন লাদাখের এক অভিজাত পরিবারের সন্তান।

ফিদা হাসনাইন তার সম্পর্কে লিখেছেন, তিনি ছিলেন বিশ্বাসের দিক থেকে বৌদ্ধ। কিন্তু উপত্যকায় তাদের সংখ্যা ছিল কম। অধিকাংশ কাশ্মীরি ছিল ব্রাহ্মণ। এমতাবস্থায়, তিনি দেবস্বামী ব্রাহ্মণ সমাজের প্রধানের কাছে অনুরোধ করেছিলেন, তাদের সমাজে তাকে অন্তর্ভুক্ত করে নিতে। তার এ অনুরোধ প্রত্যাখ্যাত হয়। অত:পর তিনি সপরিবারের ইসলাম গ্রহণ করেন। তার মুসলমান নাম হয় শামসুদ্দীন (কারো কারো মতে সদরুদ্দিন)।

এরপর থেকে পরবর্তী কয়েক শতকে কাশ্মীরে ইসলামের নিরঙ্কুশ প্রতিষ্ঠা ঘটে। এ সময় বহু সূফী-দরবেশের কাশ্মীরে আগমন ঘটে এবং তারা ইসলামের প্রচার ও শিক্ষা বিস্তারে নিরলস ভূমিকা পালন করেন। ঐতিহাসিকদের মতে, হযরত বুলবুল শাহ কলন্দরের পর এক্ষেত্রে যার সবচেয়ে বেশি অবদান তিনি হলেন সাইয়েদ আলী হামাদানি।

তখন কাশ্মীরের শাসক ছিলেন সুলতান সিকান্দর শাহ (১৩৯৩-১৪১৩)। তিনি হযরত হামাদানির দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত ছিলেন। কাশ্মীরের সংস্কৃতিতে হযরত হামাদানির প্রভাব এখনো বিদ্যমান। কাশ্মীরের শিক্ষা ও অর্থনীতিতে তার অবদান ঐতিহাসিকভাবে স্মরণীয় হয়ে আছে। মনে করা হয় যে, তিনি ইরান থেকে এসেছিলেন এবং সেখান থেকে বেশ কিছু অনুসারী নিয়ে এসেছিলেন, যাদের মধ্য ছিলেন জ্ঞানী, গুণী, বিদ্বান ও শিল্পী।

কাশ্মীরে কার্পেট ও শাল শিল্পের সূচনা হযরত হামাদানির অনুসারীদের দ্বারাই হয়েছে, যা শত শত বছর ধরে ‘কাশ্মীরি ঐতিহ্য’ হিসাবে পরিগণিত। শত শত বছর ধরে কাশ্মীরি অর্থনীতির প্রধান স্তম্ভ হয়ে আছে এই কার্পেট ও শাল শিল্প।

আধ্যাত্মিকতা, সংস্কৃতি ও অর্থনীতিতে অসাধারণ অবদান রয়েছে হযরত হামাদানির। শুধু কাশ্মীর নয়, মধ্য এশিয়াজুড়ে তার আধ্যাত্মিক প্রভাব বিস্তৃত হয়ে আছে। তিনি এখনো অনুসারিত হয়ে থাকেন। বর্তমান পাকিস্তানের হাজারা জেলায় তিনি ইন্তেকাল করেন। তবে তাকে সমাহিত করা হয় কাজাখিস্তানে।

তার ইন্তেকালের পর তার পুত্র মীর মোহাম্মদ হামাদানি পরবর্তী ২২ বছর পিতার মতোই ইসলাম প্রচারে ভূমিকা রাখেন। কাশ্মীরে ইসলাম ও আধ্যাত্মিকতা হযরত বুলবুল শাহ কলন্দর ও সাইয়েদ আলী হামাদানিকে বাদ রেখে কল্পনাও করা যায় না।



 

Show all comments
  • Anwar Hossen Anik ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ২:০৮ এএম says : 0
    কাশ্মীরে ইসলাম আসার আগে সকলেই হিন্দু ছিলেন। এঁদের মধ্যে হিন্দু ব্রাহ্মণরাও ছিলেন। অন্যান্য জাতিরও বাস ছিল কাশ্মীরে। ব্রাহ্মণদের একটা অংশ শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আদি কাল থেকে। মূলত শিক্ষা দিতেন এঁরা
    Total Reply(0) Reply
  • মহররম আলী ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ২:০৮ এএম says : 0
    আল্লাহ তায়ালা তাদের ক্ষেদমত কবুল করে নিন। আমিন।
    Total Reply(0) Reply
  • বেনজির ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ২:০৯ এএম says : 0
    সুন্দর একটা আর্টিকেলের জন্য লেখককে ধন্যবাদ। অনেক কিছু জানতে পারলাম।
    Total Reply(0) Reply
  • মেরিন-500 ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ২:১৪ এএম says : 0
    আমার জানা মতে কাশ্মীরের মুসলিমরা সব খাঁটি মুসলিম। ভালো লোকজনই ওখানে ধর্ম প্রচার করতে এসেছিল।
    Total Reply(0) Reply
  • মহররম আলী ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ২:১৪ এএম says : 0
    আল্লাহ কাশ্মিরের মুসলমানতের সাহায্য কর, ভারতীয় নিপীড়কদের পরাজিত করো।
    Total Reply(0) Reply
  • Naim Hasan Rony ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১০:১৬ এএম says : 0
    ইতিহাসটি তুলে ধরায় মুনশী আবদুল মাননান সাহেবকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি
    Total Reply(0) Reply
  • Malek ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১১:০০ এএম says : 0
    We pray to Allhah help muslim in Kusmir.
    Total Reply(0) Reply
  • Ali hussain ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১:৩১ পিএম says : 0
    আলহামদুলিল্লাহ ইসলামের ইতিহাস তুলে ধরার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
    Total Reply(0) Reply
  • Lot of thanks for the article. ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১২:৩০ পিএম says : 0
    Good for us.
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: কাশ্মীর


আরও
আরও পড়ুন