Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

দেশ আজ অপরাধীচক্রের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে

মাওলানা আবদুল লতিফ নেজামী | প্রকাশের সময় : ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

দেশে ঘুষ-দুর্নীতি, গুম, খুন, নারী ধর্ষণ, এসিড নিক্ষেপ, গণপিটুনি ও অপহরণের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা জনগণের জন্যে গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত নারী ধর্ষণের মতো মর্যাদা এবং সম্ভ্রমহানিকর কর্মকান্ডের ভয়ে নারী পুরুষের মনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে ভীষণভাবে। এধরনের রহস্যজনক, অনাকাক্সিক্ষত ও হৃদয়বিদারক ঘটনায় দেশের জনগণ জানমালের নিরাপত্তাহীনতায় শঙ্কিত। সামাজিক মূল্যবোধের কোনো মাপকাঠি দিয়ে এই ভয়াবহ পরিস্থিতির অন্ত পাওয়া যাচ্ছে না।

অপরাধীচক্র তাদের অপকর্ম চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে অবলীলাক্রমে। অবস্থাদৃষ্টে অনুমিত হচ্ছে, এখন তাদের দাপট স্বাভাবিক হয়ে গেছে। ফলে এ ধরনের আতঙ্কজনক ঘটনার সংখ্যা বৃদ্ধি সমাজে নিরাপত্তাহীনতা ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে দিতেই সহায়তা করছে। এতে জনগণ উৎকন্ঠিত। এতে বিপন্ন হচ্ছে নৈতিক মেরুদন্ড। মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করছে মন-মননে, নীতি-নৈতিকতায় ও চিন্তা-চেতনায়। এসব অপরাধমূলক ঘটনার খবর গণমাধ্যমে প্রায় প্রতিদিন প্রকাশিত হলেও বাস্তব অবস্থার তুলনায় তা খুবই সামান্য। তাই বলতে হয়, দেশকি আজ অপহরণকারী, সন্ত্রাসী ও মাস্তানদের অভয়ারণ্যে ও স্বর্গ রাজ্যে পরিণত হয়েছে।

সমাজে অপরাধী চক্রের অবাধ পদচারণার সুযোগে এবং বিষ ফোঁড়ার মতো ভিসিআর, নগ্ন ও অশ্লীল ছায়া ছবি প্রদর্শন, পর্ন ও রম্য পত্র-পত্রিকা, চলচ্চিত্রের প্রসার, সুন্দরী প্রতিযোগিতায় ও মাদক দ্রব্যের সহজলভ্যতায় মানুষের কুপ্রবৃত্তিকে জাগিয়ে তোলার ফলে অসামাজিক কার্যকলাপ ও অপরাধ প্রবণতা বেড়ে চলেছে অস্বাভাবিকহারে। এছাড়া অপরাধী ও মাস্তানদের অবাধ পদচারণা ও অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। তাই আজ ভেসে আসছে এসব অপরাধের শিকার মজলুমদের আর্ত চিৎকার, আঘাত হানছে আকাশের দ্বারে উৎপীড়িতদের আহাজারী এবং সর্বত্র ধ্বনিত হচ্ছে ক্রন্দনরোল। শুরু হচ্ছে সর্বত্র নৈতিক অবক্ষয় । অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ায় অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার পথ প্রশস্ত হচ্ছে। অপরাধ সংস্কৃতির দূষিত জোয়ারে সুস্থ সংস্কৃতি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ভেসে যাচ্ছে চিরায়ত মূল্যবোধ, ধ্যান-ধারণা, চরিত্র, ধর্ম ও আদর্শ। বিপন্ন হয়ে পড়ছে নৈতিক মেরুদন্ড। মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করছে নীতি-নৈতিকতায়। অপরাধ সংস্কৃতির সকল বাহনের অপলুপ্তি প্রয়োজন।

অপরাধের ঘটনায় শক্তিমানদেরই বীভৎস্য চেহারা লুক্কায়িত রয়েছে বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে। তাই নিপীড়িত মানুষের নিঃশঙ্ক অকুণ্ঠ প্রতিবাদেরও সম্ভাবনা তিরোহিত। নানাভাবে সৃষ্ট নিবর্তমূলক বেড়াজালে মানুষের পক্ষে সুস্থভাবে নিঃশ্বাস গ্রহণও অসম্ভব হয়ে পড়েছে বললে অত্যুক্তি হবে না। অযাচিত নিয়ম-শৃংখল মানুষের শ্বাসরোধ করে ফেলেছে। শুরু হচ্ছে সর্বত্র নৈতিক অবক্ষয়। অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ছে এবং অপসংস্কৃতির পথ প্রশস্ত হচ্ছে। অপরাধ সংস্কৃতির দূষিত জোয়ারে শুধু সুস্থ সংস্কৃতিই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে না, বরং ভেসে যাচ্ছে চিরায়ত মূল্যবোধ, ধ্যান-ধারণা, চরিত্র, ধর্ম ও আদর্শ। বিপন্ন হয়ে পড়ছে নৈতিক মেরুদন্ড। মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করছে নীতি-নৈতিকতায়।

ধর্মীয় শিক্ষা বিবর্জিত ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালুর পর থেকে শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের সর্বত্র নৈতিক অবক্ষয় শুরু হয়। মুক্ত জীবনের নামে মহিলাদের দ্বারা অশ্লীল নৃত্য-গীত ও দেহবল্লরী প্রদর্শন করানোও এর কারণ। উন্মুক্ত নারীদের বেলেল্লাপনায় গা ভাসিয়ে দেয়ার মতো পর্নগ্রাফি সংস্কৃতি অনুশীলনের প্রভাবে পুরুষরা হিতাহিত জ্ঞান লুপ্ত হয়ে বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং অপরাধ কর্মকান্ডে জড়িত হয়। এ কথা জোর দিয়ে বলা যায়, অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ায় অপরাধ সংস্কৃতির পথ প্রশস্ত হচ্ছে।

এসব দেখেই হয়ত অধ্যাপক বার্বাস বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার ওপর জোর দিয়ে বলেন, ‘বাধ্যতামূলকভাবে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার অনুশীলন না করলে মানব সভ্যতাকে রক্ষা করা যাবে না।’ অধ্যাপক বার্বাস নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষার ওপর এই জন্যে গুরুত্বারোপ করেছিলেন যে, ধর্ম নির্দেশিত নৈতিকতা ও শালীনতার দ্বারাই কেবল অপরাধমুক্ত সমাজ গড়ে তোলার পথ প্রশস্ত করা সম্ভব। অপরাধ সাংস্কৃতিক আগ্রাসন থেকে তরুণ-তরুণীদের বাঁচাতে নির্মল, পবিত্র, স্বচ্ছ, নির্দোষ এবং নিজস্ব আদর্শের আলোকে শক্তিশালী সাংস্কৃতিক বলয় গড়ে তোলাই ধর্মীয় শিক্ষার লক্ষ্য। অপরাধ নির্মূলে প্রয়োজন মহানবীর আদশের্র প্রবহমানতা।

ইদানীং ক্রমবর্ধমান অপরাধ প্রবণতা রোধে ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে এই জন্যে যে, ধর্মই হলো মানুষের বিশ্বাসের মৌলিক বিষয়। এর মাধ্যমেই মানুষের মানবিক গুণাবলী অর্জিত হয়। তাই ছোট বেলায়ই ছেলে-মেয়েদের মসজিদ ভিত্তিক মক্তবে বা ফোরকানিয়া মাদ্রাসায় পাঠানোার পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। কারণ ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষা এদেশের গণজনতার পরম আকাক্সক্ষার সাথে মিশে আছে। এই ইসলামী শিক্ষাই ছাত্রদের সুকুমার বৃত্তির বিকাশ, নৈতিক উৎকর্ষতা সৃষ্টি, সৃজনশীল প্রতিভার উন্মেষ, তাদের স্বশিক্ষিত ও মার্জিত করে তুলতে সহায়ক হয়। তাই প্রকৃত মানব সৃষ্টির ক্ষেত্রে ধর্মীয় শিক্ষার বিকল্প নেই। কারণ ধর্মীয় শিক্ষা মানুষের মনে অপরাধ বিরোধী চেতনাকে শাণিত, কর্তব্যবোধে উজ্জীবিত, দীপ্ত পথে বলিয়ান ও উদ্দিপ্ত করতে সহায়তা করে এবং চিন্তাা-ভাবনার জগতে বিরাজমান নৈরাজ্যের উন্নতি ঘটাতে, উন্নত মানবিক জীবন ও সমাজের মনোভূমিতে শৃংখলা আনতে সাহায্য করে। এই শিক্ষা মানুষের অন্তরে পারস্পরিক ভালবাসা, সাম্য ও মৈত্রীর অনুভূতি স্বতঃস্ফূর্তভাবেই জাগ্রত করে। ধর্মীয় শিক্ষা মানুষের মনে ন্যায়বোধ, কর্তব্যপরায়ণতা, শৃঙ্খলা, শিষ্টাচারবোধ, মানবাধিকার, জীবন যাপনের মানসিকতা, সৌহার্দ্যবোধ, অধ্যবসায় ইত্যাদি নৈতিক ও আত্মিক গুণাবলী অর্জনের সহায়ক। ছাত্রদের সংস্কৃতিমনস্ক করা ও কুসংস্কারমুক্ত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে উৎসাহিত করার ক্ষেত্রে ইসলামী শিক্ষা সহায়ক। ঐশী বিধান এবং মহানবীর (সা.) নির্দেশিত পথে সঠিকভাবে অনুশীলনের মাধ্যমেই কেবল অপরাধ রোধ করা সম্ভব হবে।
দেশে বিরাজমান সন্ত্রাসসহ ক্রমবর্ধমান বিভিন্নমুখী অপরাধ দমনে ইসলামী আইন প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তাও অনেকে অনুভব করছেন। তাঁদের ধারণা ইসলামী আইনের প্রতি ধর্মগত বিশ্বাস ও শ্রদ্ধাবোধের কারণে মানুষ স্বশাসিত হয়। ধর্মীয় অনুশাসন যথাযথভাবে অনুশীলনের মাধ্যমে জনসাধারণের মধ্যে সার্বজনীন সাম্য, মৈত্রী, মানবিকতা সম্পন্ন মানসিকতা জোরদার এবং পারস্পরিক সহমর্মিতা ও সৌহার্দ্যবোধের চেতনা জাগ্রত হয়। যাতে পারস্পরিক সহমর্মিতার ক্ষেত্রে আমাদের বিশ্বাস, চেতনা ও উপলব্ধি প্রতিবিম্বিত হয় এবং মানুষের চিত্ত, মানসলোক ও চেতনারাজ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন দৃঢ় হয়। অপরাধ প্রবণতা রোধ করতে ইসলাম ভিত্তিক নৈতিকতা ও শালীনতার দ্বারা সদভ্যাস গড়ে তোলার প্রয়াস চালাতে হবে। এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের চিরায়ত মূল্যবোধ, ধ্যান-ধারণা, চরিত্র, ধর্ম ও আদর্শ রক্ষা এবং সর্বগ্রাসী অপরাধ প্রবণতা রোধে জনমত গঠনে সম্মিলিত প্রয়াস গড়ে তোলার ক্ষেত্রে দলমত নির্বিশেষে সকলেরই স্বচেষ্ট হওয়া উচিৎ।
অপরাধ দমনে ইসলামী আইন প্রবর্তনের প্রবক্তারা প্রচলিত আইন ও ইসলামী আইনের পার্থক্যের কথা উল্লেখ করে বলেন, বৃটিশ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত আইন ভিত্তিক দেশে বিরাজমান বিচার ব্যবস্থা দীর্ঘ মেয়াদী ও ব্যয় বহুল। এতে অপরাধীরা সহজে পার পেয়ে যায়। পক্ষান্তরে ইসলামী আইন ভিত্তিক বিচার ব্যবস্থা দৃষ্টান্তমূলক, অপরাধ প্রতিরোধক, স্বল্পমেয়াদী ও খরচবিহীন। তাছাড়া ইসলামী আইন ধর্মীয় বিশ্বাস ও মূল্যবোধের সাথে সম্পৃক্ততার কারণে ইসলামী আইনে প্রদত্ত দন্ড মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রহণ করে। তাছাড়া জনগণের ওপর ইসলামী আইনের প্রভাব অপরিসীম বিধায় ইসলামী আইন জনমনে ইসলাম ভিত্তিক নৈতিক উৎকর্ষতা সৃষ্টি, জনগণকে স্বশিক্ষিত ও মার্জিত করে তুলতে সক্ষম। ইসলামী আইন মানুষের অপরাধ বিরোধী চেতনাকে শাণিত, উজ্জীবিত ও উদ্দিপ্ত করতে পারে অনায়াসে। এই আইন মানুষের মনে বিরাজমান নৈরাজ্যের উন্নতি ঘটাতে, সমাজের মনোভূমিতে শৃঙ্খলা আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। মানুষের মনে অন্যায়ের পরিবর্তে ন্যায়বোধ, বিশৃঙ্খলার পরিবর্তে শৃঙ্খলা, শিষ্টাচার ও মানুষকে অপরাধ প্রবণতা থেকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে ইসলামী আইনের অবদান অনস্বীকার্য। শুধু ইসলামী আইন ভিত্তিক বিচার ব্যবস্থাই পারে অপরাধমুক্ত সমাজ গড়ে তুলতে।

অপরাধীচক্রের অপতৎপরতা সম্পর্কে গণসচেতনা বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ খুবই প্রয়োজন। এধরনের আতঙ্কজনক অপতৎপরতার মারাত্মক প্রতিক্রিয়া ও পরিণতি সম্পর্কে হুঁশিয়ার থেকে জনপ্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্যে দলমত নির্বিশেষে সকলেরই স্বচেষ্ট হওয়া দরকার। পাশব শক্তির বলে মানুষের জানমালের নিরাপত্তা বিঘিœত করার হীন প্রয়াসের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। দেশে বিরাজমান অপরাধ প্রবণতা রোধে শুধু বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে আত্মতৃপ্তি পাবার সুযোগ নেই। দেশের জনগণ যুগে যুগে মানবতা রক্ষার জন্যে আত্মত্যাগের যে নজির স্থাপন করে গেছেন, সেই ত্যাগের আদর্শ গ্রহণের মধ্যেই আজকের চেতনা নিহিত। আজ প্রয়োজন ত্যাগ-তিতিক্ষার সেই চেতনাকে উজ্জীবিত করা। অতীতে দেশের বিজয় পতাকাকে সমুন্নত রাখার জন্যে জনগণের আত্মত্যাগ আমাদের কাছে এক জীবন্ত ইতিহাস। এতে রয়েছে আত্মত্যাগের অণুপ্রেরণা এবং সেই সাথে ন্যায়, সত্য ও সততা প্রতিষ্ঠার দৃঢ় প্রত্যয়, যা যুগে যুগে আমাদের প্রেরণা যুগিয়ে আসছে। এসব ত্যাগ-তিতিক্ষা ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় প্রমাণিত, শাশ্বত ও জীবন্ত। তাই খুনি সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোন গদ্যন্তর নেই।
লেখক: ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান ও নেজামে ইসলাম পার্টির সভাপতি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন