পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
অভিযুক্ত কোনো আসামী যত বড় অপরাধী এবং তার বিরুদ্ধে যত মামলা থাকুক না কেন, সে যখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করে, তখন তার নিরাপত্তাবিধান করা ঐ বাহিনীর দায়িত্ব। তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ রয়েছে, সেগুলোর আলোকে তাকে আইন এবং আদালতের মাধ্যমেই বিচারের মুখোমুখি করা পুলিশের দায়িত্ব। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, এক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটতে দেখা যাচ্ছে। প্রায়ই দেখা যায়, অভিযুক্ত কোনো ব্যক্তি আত্মসমর্পনের পর পুলিশের সাথে ‘কথিত বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়। আইনের মুখোমুখি হয়ে যথাযথ বিচার না পেয়ে অভিযুক্ত ব্যক্তির মৃত্যু হচ্ছে। এ নিয়ে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা এবং আইনজ্ঞরা বহু বছর ধরে তীব্র প্রতিবাদ করলেও পুলিশের এই আচরণের কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। বরং উল্টো পুলিশের পক্ষ থেকে আসামীকে নিয়ে অস্ত্র উদ্ধার বা তল্লাশি করতে যাওয়ার পথে তার দলবলের হামলার মুখে বন্দুকযুদ্ধ হয় এবং পুলিশ আত্মরক্ষার্থে গুলি বর্ষণ করে-এমন গৎবাঁধা অজুহাত দেয়া হয়। কথিত বন্দুকযুদ্ধ নিয়ে পুলিশ যে অজুহাত দেখায় তা একজন সাধারণ মানুষের কাছেও কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না। গতকাল বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, চট্টগ্রামে ১৩ মামলার আসামি নিজের জীবন বাঁচাতে গত বুধবার দুপুুরে থানায় গিয়ে আত্মসমর্পণ করে। আইন অনুযায়ী এই আসামিকে বৃহস্পতিবার আদালতে হাজির করার কথা। অথচ আত্মসমর্পণের ১২ ঘন্টার মধ্যে সে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে যে ব্যক্তি সে যত বড় অপরাধী হোক না কেন স্বেচ্ছায় যখন আইনের হাতে নিজেকে সোপর্দ করে, সে কেন বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যার শিকার হবে? পুলিশ কেন তাকে সুরক্ষা দিয়ে আদালতে হাজির করতে পারল না? এটি কি পুলিশের চরম ব্যর্থতা নয়? আইনের মুখোমুখি না করে বন্দুকযুদ্ধের নামে একজনকে মেরে ফেলার এই অপসংস্কৃতি কি সরকারের আইনের শাসন প্রতিষ্ঠাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে না?
এখন এমন এক পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে, আইনের রক্ষক হিসেবে পরিচিত পুলিশ নিজেই ভক্ষকে পরিণত হয়েছে। এ কথা পুরো পুলিশ বাহিনীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য তা নয়, তবে এ বাহিনীর এক শ্রেণীর সদস্য এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে যে, এর পুলিশ বাহিনীর ওপর গিয়েই পড়ছে। পুলিশ একজন বা দুজন হোক, অপরাধ করলে তা ‘পুলিশ’ করেছে বলেই সাধারণ মানুষ মনে করে। একশ্রেণীর পুলিশের ভয়ংকর সব ঘটনার সাথে যুক্ত হয়ে পড়ায় পুলিশ বলতেই সাধারণ মানুষ যেন আঁৎকে উঠে। বিপদে পড়লেও তারা পুলিশের দ্বারস্থ হতে চায় না। তারা মনে করে, পুলিশের সাহায্য চাওয়া মনে উল্টো আরও বিপদে পড়া। ফলে শত বিপদেও অনেকে পুলিশের ধারেকাছে যেতে চায় না। পুলিশের প্রতি তাদের এই চরম আস্থাহীনতার মধ্যেই বাহিনীটির একশ্রেণীর সদস্য কর্তৃক ঘটে চলেছে, খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, মাদক চোরাচালানের মতো মারাত্মক অপরাধ। দেশব্যাপী যখন ধর্ষণ মহামারি আকার ধারণ করেছে, তখন ভুক্তভোগীদের অনেকেই থানা-পুলিশমুখী হয় না। তারা মনে করে, পুলিশের কাছে গেলেই উপযুক্ত ব্যবস্থা বা নিরাপত্তার পরিবর্তে উল্টো অপমানিত ও হেনস্থা হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এমনকি পুলিশ কর্তৃক ধর্ষিত হওয়ার শঙ্কা থাকে। গত মঙ্গলবার যশোরের শার্শায় থানায় গ্রেফতার হওয়া এক ব্যক্তির স্ত্রীকে পুলিশ ও তার সোর্স ধর্ষণ করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। শুধু ধর্ষণই নয়, অন্যান্য অপরাধেও পুলিশের একটি শ্রেণী এমনভাবে জড়িয়ে পড়েছে এবং পড়ছে যে, পুলিশ বাহিনীর ভাবমর্যাদা ও গ্রহণযোগ্যতা এখন প্রশ্নবিদ্ধ। বাহিনীটি যেন এখন ‘আতঙ্ক’ শব্দটির সমার্থক হয়ে উঠেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, সর্বক্ষেত্রেই পুলিশ বাহিনীর ব্যর্থতা স্পষ্ট। ট্র্যাফিক ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে অন্যান্য ক্ষেত্রে পুলিশের এই ব্যর্থতা নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। সড়কে যে বিশৃঙ্খলা তা নিয়ন্ত্রণে পুলিশের ব্যর্থতা অমার্জনীয়। এ ক্ষেত্রে পুলিশের একটি শ্রেণী চাঁদাবাজিতে ব্যস্ত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ট্র্যাফিক ব্যবস্থা না করে মোড়ে মোড়ে গাড়ি থামিয়ে চেকিংয়ের নামে এ অপকর্ম করে বেড়াচ্ছে। স্বয়ং ডিএমপি কমিশনার যখন বলেন, সেবা সংস্থার পরিবর্তে ডিএমপি রাজস্ব আদায়ের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে, তখন পরিস্থিতি কি, তা বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। সাধারণ মানুষের মধ্যে এখন এ আঁকুতি, আমরা পুলিশের সেবা চাই না, তাদের সৃষ্ট বিপদ থেকে বাঁচতে চাই। পুলিশ দেখলেই যেন তারা একশ’ হাত দূর দিয়ে চলাচল করে। সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশের একশ্রেণীর সদস্যর এমন অসদাচরণে সর্বত্রই এমন এক ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। পুলিশের বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, বাহিনীর একশ্রেণীর সদস্যর অপরাধের সংখ্যা যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি বিভাগীয় ব্যবস্থাসহ শাস্তিমূলক পদক্ষেপের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। তারপরও কেন পুলিশের অপরাধের হার কমিয়ে আনা যাচ্ছে না? গলদ কোথায়? এই অপরাধ বৃদ্ধি তো কোনোভাবেই পুলিশকে ‘সেবক’ হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। অথচ পুলিশ বাহিনীকে জনগণের বন্ধু বা সেবক হিসেবে আরও কাছাকাছি করার জন্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতার ঘাটতি নেই। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইজিপি থেকে শুরু করে অন্যান্য উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সুনাম সুবিধিত। জনসেবামূলক তাদের বক্তব্য ও উদ্যোগ কেন মাঠপর্যায়ে প্রতিফলিত হচ্ছে না, তা বোধগম্য নয়। তবে এটা বোঝা যাচ্ছে, মাঠপর্যায়ে একশ্রেণীর পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কোনো উদ্যোগ ও কথা আমলে নিচ্ছে না এবং তা বাস্তবায়নে আগ্রহী নয়। তারা নিজেদের মতো করেই চলছে। চেইন অব কমান্ডের ধার ধারছে না। তা নাহলে, পুলিশ কর্তৃক একের পর এক অকল্পনীয় অপরাধের ঘটনা ঘটত না।
আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে পুলিশ প্রশাসনের অনেক ভাল উদ্যোগও একশ্রেণীর সদস্যর অপকর্মের কারণে ভেস্তে যাচ্ছে। ভয়ংকর অপরাধী ও তাদের চক্রকে সুপথে আনার ক্ষেত্রে আত্মসমর্পনের মতো ভাল উদ্যোগকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে। আমরা দেখেছি, সুন্দরবনের ভয়ংকর ডাকাত দল, নৌ দস্যু, পাহাড়ি অঞ্চলের সন্ত্রাসী গোষ্ঠী, মাদক চোরাকারবারিদের মতো ভয়াবহ অপরাধে জড়িতদের নিবৃত্ত ও সুপথে আনার ক্ষেত্রে পুলিশ ও র্যাব স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পনের সুযোগ দিয়ে সুফল পায়। এতে গোটা এলাকা অনেকটা অপরাধমুক্ত হয়। বড় ধরনের সন্ত্রাসী ও অপরাধীদের সুপথে আনার এমন উদ্যোগ সারাবিশ্বেই রয়েছে। দুঃখের বিষয়, এই উদ্যোগে বাদ সাধছে একশ্রেণীর অসাধু পুলিশ সদস্য। আত্মসমর্পণকারীদের কাউকে কাউকে অযাচিত ও আইনবর্হিভূতভাবে বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যা করছে। ইতোমধ্যে উচ্চ আদালত পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে নির্দেশনা দিলেও পুলিশ তা থোড়াই কেয়ার করছে। এর মাধ্যমে পুলিশের একটি শ্রেণী এটাই প্রমাণ করতে চাচ্ছে, তাদের উপরে কেউ নেই। তাদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। এই মানসিকতার কারণেই ঐ শ্রেণীটির মধ্যে খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, মাদক চোরাচালানসহ প্রায় সব ধরনের অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে। এর বদনাম নিতে হচ্ছে পুরো পুলিশ বাহিনীকে। আমরা আশা করব, পুলিশের একটি শ্রেণীর মধ্যে যে হারে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে, তা নিরসনে অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে নির্মোহভাবে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। এক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করতে হবে। পুলিশের ভাবমর্যাদা ফিরিয়ে আনতে এবং জনবান্ধব করতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও এ ব্যাপারে দৃষ্টি দেবেন বলে আশা করি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।