Inqilab Logo

শক্রবার ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ কার্তিক ১৪৩১, ০৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

দাসত্ব, বর্ণবাদ এবং হত্যা-লুণ্ঠনের বিশ্বব্যবস্থার ইতিহাস

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ২৮ আগস্ট, ২০১৯, ১২:০১ এএম

এক জটিল ভূ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে গত রবিবার আমেরিকায় আফ্রিকান দাসদের পর্দাপণের ৪০০ বছর পূর্তির ইতিহাস স্মরণ করা হল। ইউরোপীয়রা আফ্রিকা উপকুল থেকে কালো মানুষদের ধরে ধরে শিকলবন্দি করে আমেরিকার ভার্জিনিয়া উপকুলে জাহাজ ভিড়িয়েছিল ১৬১৯ সালের ২৪ আগস্ট। মারনাস্ত্রের উন্নয়ন এবং নৌশক্তির উপর ভিত্তি করে ক্রমবর্ধমান উপনিবেশিক অঞ্চলের উৎপাদন ও শ্রম ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে স্পেনিশ, বৃটিশ ও ওলন্দাজরা সম্পদের পাহাড় গড়তে আফ্রিকা থেকে ধরে আনা কালো মানুষরাই ছিল বুনিয়াদি সম্পদ। ইউরোপে উৎপাদিত মদ ও বস্ত্রসহ নতুন নতুস সামগ্রির বিনিময়ে আফ্রিকা থেকে হাজার হাজার কালো আদমিদের জাহাজে ভরে আমেরিকায় পাড়ি দিত সেখানে বিকাশমান কৃষি ও শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় শ্রমিকের চাহিদা পুরণ করতে কালো আদমিদের উচ্চ মূল্যে বিক্রি করা হত। বিক্রিত অর্থে আমেরিকায় উৎপাদিত চা, কফি এবং মূল্যবান ধাতু কিনে জাহাজ বোঝাই করে ইউরোপে পাড়ি জমাতো। আফ্রিকা থেকে পালতোলা জাহাজে করে কালো মানুষদের আমেরিকায় পৌছানোর পথপরিক্রমায় রচিত হয়েছে অনেক মর্মান্তিক ইতিহাস। এসব মানুষকে জোর করে জাহাজে তোলার পর জাহাজের খোলের মধ্যে বন্য প্রাণীর মত শেকলবন্দি মানুষদের একই সঙ্গে অনেক সংখ্যককে গাদাগাদি করে বেঁধে রাখা হত। শক্ত সামর্থ্য দাসদের দিয়ে শেকলবন্দি অবস্থায় জাহাজের দাঁড়টানাসহ কঠোর শ্রম আদায় করা হলেও প্রয়োজনীয় খাদ্য ও পানীয় থেকে বঞ্চিত রাখা হত। কেউ অসুস্থ হলে শশ্রুষা বা চিকিৎসা না করে সমুদ্রে ফেলে দেয়া হত। এভাবেই শুরু হয়েছিল বেশিরভাগ আফ্রো-আমেরিকান পূর্ব পুরুষদের আমেরিকায় পদার্পণের ইতিহাস। ঘানা, ক্যামেরুন, এঙ্গোলা, কেনিয়া, নাইজেরিয়া, ম্জোাম্বিক থেকে লোকদের ভাগিয়ে বা অপহরণ করে নিয়ে আসা লোকগুলোর একটা বড় অংশই ছিল মুসলমান। বৃটিশ ও স্পেনিশ ঔপনিবেশিক শক্তির অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত করার অন্যতম সম্পদ এই দাসরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যত বিনির্মানের মূল ভূমিকা পালন করেছিল। আমেরিকার কৃষি উৎপাদন, খনিজ সম্পদ উন্নয়ন, রেললাইন নির্মান থেকে শুরু করে নতুন আমেরিকান সভ্যতার পেছনে এই কালোরা অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছিল। বৃটিশদের চাপিয়ে দেয়া ট্যাক্স ও সম্পদ লুন্ঠনের বিরুদ্ধে আমেরিকার জনগণের বিদ্রোহ ও ১৭৭৫ সালে শুরু হওয়া স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে বিপক্ষে আফ্রিকান-আমেরিকানরা অংশগ্রহন করলেও প্যাট্রিয়টিক বাহিনীতে কৃষ্ণাঙ্গরা অসম সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিল। আটবছর ধরে চলা যুদ্ধশেষে ১৭৮৩ সালে আমেরিকা স্বাধীন হওয়ার পেছনে আফ্রো-আমেরিকানদের অবদান অনেক। আমেরিকার স্বাধীনতার পর দেড়শ বছরেও প্রত্যাশিত ঐক্য, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দ্বন্দ দূর হয়নি। আমেরিকা থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্য ও ভারতীয় উপমহাদেশ পর্যন্ত বৃটিশ ও ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকরা তাদের ফেলে যাওয়া উপনিবেশগুলোতে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক, জাতিগত-সাংস্কৃতিক বিভেদের বীজ রেখে গেছে। আমেরিকার স্বাধীনতার ইশতেহারেই দাসত্বপ্রথা বিলুপ্তির প্রতিশ্রুতি থাকলেও প্রায় দেড়শ বছরেও সে প্রথা বিলুপ্ত করা সম্ভব হয়নি। আমেরিকান সিভিল ওয়ার বা উত্তর ও দক্ষিনের রাজ্যগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য বা দ্বন্দের মূল কারণই ছিল দাসত্ব বিলোপের দাবীর পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান। ১৮৬১ সালের নির্বাচনে রিপাবলিকান দল থেকে বিজয়ী প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন দাসপ্রথা বিলুপ্তির প্রশ্নে উত্তরের৭টি রাজ্যের ইউনিয়ন স্টেটের শক্তি নিয়ে প্রতিপক্ষ দক্ষিণের ১১টি অঙ্গরাজ্যের কনফেডারেশনের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। মূলত: দাসদের শক্তিই তাকে বিজয়ী শক্তিতে পরিনত করে। গৃহযুদ্ধে বিজয় লাভের পর আব্রাহাম লিঙ্কন ১৮৬৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে আমেরিকায় দাসপ্রথা নিষিদ্ধ করেন এবং দাসদের মুক্তির ঘোষণা দেন। দাস প্রথার সমর্থকরা পরাজিত হলেও ভেতরে ভেতরে সক্রিয় ছিল। তারা ১৮৬৫ সালে আব্রাহাম লিঙ্কনকে গুলি করে হত্যা করে।

জর্জ ওয়াশিংটন, ফ্রাঙ্কলিন, অ্যাডামস, জেফারসনসহ ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকার প্রতিষ্ঠাতা বা ফাউন্ডিং ফাদাররা যে গণতান্ত্রিক আমেরিকার স্বপ্ন দেখেছিল তা বাস্তবায়নে মূল বাঁধা ছিল দাস প্রথা ও ভ্রান্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। সিভিল ওয়ারের মধ্য দিয়ে দাসত্ব প্রথার আনুষ্ঠানিক বিলুপ্তি ঘটলেও কর্পোরেট অর্থনৈতিক লুণ্ঠন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে তেমন কোনো অগ্রগতি অর্জিত হয়নি। থিয়েটার হলের আঁধারিতে যে আততায়ি হাত আব্রাহামলিঙ্কনের বুকে গুলি করেছিল, সে হাত এখনো সক্রিয় আছে। দাসত্ব প্রথার বিলুপ্তি ঘটলেও স্বেতাঙ্গ বর্ণবাদ, ঘৃনা ও প্রতিহিংসার সংস্কৃতি থেকে আমেরিকা কখনো বেরিয়ে আসতে পারেনি। আব্রাহাম লিঙ্কনের শতবছর পর কৃষ্ণাঙ্গ নেতা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের নেতৃত্বে গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে আমেরিকায় কালোদের মানবাধিকার ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে সিভিল রাইটস মুভমেন্ট গড়ে ওঠে। সারাবিশ্ব থেকে আসা ইমিগ্র্যান্টদের নিয়ে গড়ে ওঠা আধুনিক আমেরিকার সবচেয়ে উজ্জ্বল সময়ে জ্বলে ওঠা আমেরিকান সিভিল রাইটস মুভমেন্টে সব বর্ণের মানুষের ব্যাপক সমর্থন ছিল। ১৯৬৩ সালে লিঙ্কন মেমোরিয়ালের সামনে লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে কিং তার বিখ্যাত ‘আই হ্যাভ অ্যা ড্রিম’ ভাষণ দেন। ১৯৫৫ সালের ডিসেম্বরে রোসা পার্কস নামের এক কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা পাবলিক বাসে সাদা চামড়ার ব্যক্তিকে সিট ছেড়ে না দেয়ায় পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়ার ঘটনার প্রতিবাদে লুথার কিং সিভিল রাইটস মুভমেন্টের সুচনা করেন। বৃটিশ আমলে আমাদের দেশে বৃটিশদের ক্লাব ও বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানের সময় গেটে শুধু ‘বৃটিশদের জন্য’, কুকুর ও ভারতীয়দের প্রবেশ নিষিদ্ধ’ ইত্যাদি সাইনবোর্ড ঝুলানো থাকতো। সিভিল রাইটস প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে আমেরিকায় কালোদের ভোটাধিকার ছিল না। হোটেল-রেস্তোঁরায় সাদাদের পাশে কালোদের বসার অনুমতি ছিল না। পাবলিক বাসে সাদাদের জন্য সিট ছেড়ে দেয়া কালোদের জন্য বাধ্যতামূলক ছিল। রোসা পার্কসকে গ্রেফতার করার পর বাস সার্ভিস বয়কটের ঘোষণা দিয়েছিলেন মার্টিন লুথার কিং। লাখ লাখ মানুষ পাবলিক সার্ভিস বাসে ওঠা থেকে বিরত থেকে ব্যক্তিগত গাড়ি অথবা পায়ে হেঁেট অফিসে ও কর্মস্থলে যাতায়াত করেছিলেন। এরই মধ্যে অ্যালাবামা রাজ্য সরকার গণপরিবহণে স্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ ভেদাভেদকে বেআইনী ঘোষণা করার মধ্য দিয়ে কিংয়ের আন্দোলনের প্রথম বিজয় সূচিত হয়। এরপর ১৯৬৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিক অধিকার আইন ও ১৯৬৫ সালে ভোটাধিকার আইন প্রতিষ্ঠিত হয়। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় কৃতিত্বের জন্য ১৯৬৪ সালে মার্টিন লুথার কিং শান্তিতে নোবেল পুরষ্কারে ভ’ষিত হন। তবে বর্ণবাদি-ঘৃনাবাদি সন্ত্রাসীরা লুথার কিংয়ের বুকে গুলি চালিয়ে প্রতিশোধ নিয়েছিল। ১৯৬৮ সালের এপ্রিলে স্বেতাঙ্গ উগ্রপন্থী সন্ত্রাসীদের গুলিতে লুথার কিং নিহত হন। মার্টিন লুথার কিং নিহত হওয়ার তিন বছর আগে ১৯৬৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গদের আরেক অবিসম্বাদিত নেতা ম্যাল´ এক্স (মালিক আল শাব্বাজ) স্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হন। নেব্রাডা অঙ্গরাজ্যের ওমাহাতে ১৯২৫ সালে জন্মগ্রহণকারী ম্যালকম-এক্স’র বয়েস যখন ৫ বছর, তখন তার পরিবার স্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসী গ্রুপ ক্লু ক্লাক্স ক্লানদের হাতে নির্মম নৃশংসতার শিকার হয়। ম্যালকম এক্সের চার চাচাকে তারা জবাই করে হত্যা করেছিল। এই হত্যাকান্ডের দৃশ্য দেখে তার মা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে পাগলা গারদে আশ্রয় পেয়েছিল। অসহায় শিশু ম্যালকমের স্থান হয় অনাথ আশ্রমে। তুখোড় মেধাবী হওয়া সত্বেও লেখাপড়া করে বড় এটর্নি হওয়ার স্বপ্ন ছিল তার। কালো হওয়ার কারণে সে স্বপ্নকে উচ্চাশা বলে টিপ্পনি কেটেছিল তার শিক্ষক। অবশেষে হতাশ হয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেন ম্যালকম-এক্স। স্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদি ভ’মিকা গ্রহণ করতে গিয়ে জেলে যেতে হয়েছিল। ১৯৫২ সালে জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর কিছুদিন নেশন অব ইসলামের নেতৃত্বে সক্রিয় ভ’মিকা পালন করেন। এরপর সউদি আরবে হজ্ব করতে গিয়ে তার চিন্তাধারার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। আমেরিকায় ফিরে তিনি ইসলামের শাশ্বত শান্তির বানী প্রচারে অক্লান্ত সময় ব্যয় করতে থাকেন। ১৯৬৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী নিউ ইয়র্কে একটি হলরুমে বক্তৃতা করতে দাঁড়ালে হঠাৎ একসাথে কয়েকটি বন্দুক গর্জে ওঠে। বুকে ৯৫টি গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান ম্যাল´ এক্স তথা মালিক আল শাব্বাজ। এভাবেই যুগে যুগে আমেরিকায় মানবতা, অহিংসা ও শান্তির কন্ঠস্বরগুলোকে বন্দুকের গুলি দিয়ে স্তব্ধ করে দেয়া হয়েছে। বর্ণবাদি সন্ত্রাস এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করছে। তাদের মদতে এখন তা সারাবিশ্বে বিস্তার লাভ করেছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম টমাস জেফারসন ১৭৭৬ সালে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বা প্রোক্লেমেশন অব ইন্ডিপেন্ডেন্স’এ লিখেছেন, “অল মেন আর ক্রিয়েটেড ইকোয়াল, অ্যান্ড ‘দ্যাট দে আর এনডাউড বাই দেয়ার ক্রিয়েটর উইদ সার্টেইন আনএলিনেবল রাইটস. সাচ এজ- লাইফ, লিবার্টি অ্যান্ড দ্য পারসুইট অব হেপিনেস।” যদিও জর্জ ওয়াশিংটন বা জেফারসনদের মত পাওয়ার এলিটরা তখনো দাসপ্রথা বিলোপের কথা চিন্তাও করেননি। তবে আড়াইশ বছর আগেই তারা আমেরিকার ব্যাংকিং সিস্টেম তথা ভ্রান্ত অর্থব্যবস্থা সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন ও চিন্তিত ছিলেন। আমেরিকান ব্যাংকিং সিস্টেমের বর্তমান বাস্তবতার সাথে টমাস জেফারসনের আশঙ্কা অনেকটাই মিলে গেছে। তিনি লিখেছিলেন, ‘যদি কখনো মার্কিন জনগণ কোনো প্রাইভেট ব্যাংককে কারেন্সি নিয়ন্ত্রণের অনুমোদন দেয়, তাহলে এসব ব্যাংক ও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো কখনো মূল্যস্ফীতি আবার কখনো মূদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটিয়ে জনগণের সব সম্পদ গ্রাস করে ফেলবে। একদিন ঘুম ভেঙ্গে আমাদের সন্তানরা দেখবে তাদের পূর্বপুরুষরা যে দেশটা অধিকার করেছিল সে দেশে নিজেরাই গৃহহীন... আমি মনে করি ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিপক্ষ সেনাবাহিনীর চেয়েও আমাদের স্বাধীনতার জন্য অনেক বেশি বিপজ্জনক’। বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে গ্রেট ডিপ্রেশন বিশ্বকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ঠেলে দিয়েছিল। একবিংশ শতকের শুরুতে আবারো গ্রেট ডিপ্রেশন দেখা দেয়ার পর হাজার হাজার কোটি ডলারের বেইল-আউট প্রোগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্থব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়ার মধ্য দিয়ে সামাজিক-রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা থেকে রক্ষার অস্থায়ী সমাধান তেমন কোনো কাজে আসছে না। কোথায় গেল বেইল-আউটের হাজার হাজার ডলার? আজকের বিশ্বের পুঁজিবাদি অর্থব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক ও দার্শনিক ভিত্তি রচনা করেছিলেন বৃটিশ-স্কটিশ অর্থনীতিবিদ স্মিথ। ১৭৭৬ সালে লেখা অ্যাডাম স্মিথের ‘ওয়েলথ অব দ্য ন্যাশনস’ গ্রন্থটিকে আধুনিক পুঁজিবাদি অর্থনীতির টেস্টামেন্ট হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ গ্রন্থে দার্শনিক অ্যাডাম স্মিথ পুঁজির একচ্ছত্র পুঞ্জিভবনের এক পর্যায়ে এক অদৃশ্য (ইনভিজিবল হ্যান্ডস)হাতের কারসাজিতে পুরো ব্যবস্থাটিই ভেঙ্গে পড়ার কথা বলা হয়েছে। আজকের বিশ্ববাস্তবতায় মার্কিন ফেডারেল রির্জাভ ব্যাংক ও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্বমানবতার প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমগ্র বিশ্বের ব্যাংকিং সিস্টেমের অন্যতম বড় নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান হয়ে দাঁিড়য়েছে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক। নামে এটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক হলেও এটি আদতে একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রিয় ব্যাংক বলে মনে করা হলেও এতে মার্কিন সরকারের, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি তথা জনগনের কোনো প্রকিনিধিত্ব বা নিয়ন্ত্রণ নেই। বিশ্বের প্রায়র সব দেশের সরকারী-বেসরকারী ব্যাংক এই ব্যাংকে তাদের রিজ্র্ভা গচ্ছিত রাখলেও এই ব্যাংক পরিচালনা বা নীতি নির্ধারণে এসব ব্যাংকের অংশগ্রহণমূলক নিয়মতান্ত্রিক প্রতিনিধিত্ব নেই। মূলত ইহুদি ব্যাংকার ও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের নেপথ্য পরিচালক। এভাবেই পুঁজিবাদি বিশ্বঅর্থনীতির নিয়ামক শক্তি অদৃশ্য অগণতান্ত্রিক একট চক্রের হাতে বন্দি। এই শক্তির হাতেই আজ সমগ্র বিশ্বের অর্থনীতি, বাণিজ্য, শান্তি ও স্থিতিশীলতা জিম্মি হয়ে আছে। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের নিয়ন্ত্রন কখনোই পশ্চিমা জনগণের হাতে ছিল না। এই বেসরকারী ও কর্পোরেট অর্থব্যবস্থাই নেপথ্যে থেকে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। সাম্প্রতিক দশকে চীন ও রাশিয়ার নেতৃত্বে বিকল্প অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগ এ কারণেই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ চ্যালেঞ্জে টিকে থাকতে প্রথম ধাপে মার্কিন প্রেসিডেন্ট চীন-রাশিয়ার সাথে বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু করেছেন। সামরিক-অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে চীন-রাশিয়াকে মোকাবেলা করে টিকে থাকার শক্তি থাকলে অনেক আগেই হয়তো চীন-রাশিয়ায় ইরাক-আফগানিস্তান ও সিরিয়ার মত হামলা চালিয়ে রিজিম চেঞ্জ ও ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিনত করার স্টেটে পরিনত করার পদক্ষেপ নিত।

আমেরিকায় দাসত্ব প্রথা চালু করেছিল ইউরোপীয়রা। কলম্বাস আমেরিকায় পদার্পণের আগে রেড ইন্ডিয়ানদের মধ্যে সেখানে দাসপ্রথা ছিল না। অমানবিক বাণিজ্য ও সম্পদ লুন্ঠনের অভিনব ও নৃশংস কায়দা-কৌশলও শিখেছে ইউরোপীয়দের কাছ থেকে। এটি সে সময়ের কথা যখন ইউরোপীয়রা আগের শতাব্দীগুলোকে মধ্যযুগ বা অন্ধকার যুগ বলে অভিহিত করতে শুরু করল। এটি সে সময়ের কথা যে সময়ে সমুদ্রে ভাইকিংদের লুণ্ঠনের ঘটনাগুলো ছাড়া দেশ দখল, অন্য মহাদেশে হানা দিয়ে কালো মানুষদের ধরে শেকলে বেঁধে জাহাজ বোঝাই করে ভেড়া-ছাগলের মত বিক্রি করার চিন্তা ছিল না। আমেরিকার আদিবাসি রেড ইন্ডিয়ানদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়ে, বেপরোয়া গুলি চালিয়ে হাজার হাজার রেড ইন্ডিয়ানকে হত্যা করে তাদের জমি ও দেশ দখল করার মধ্য দিয়ে ইউরোপীয়রা অন্ধকার থেকে আলোতে পৌঁছেছিল! অ্যাজটেক-ইনকাদের সমৃদ্ধ সভ্যতা ও জনপদকে পদানত করতে সেখানে রক্তের বন্যা বইয়ে দেয়া হয়েছিল। অথচ ত্রয়োদশ শতকের শুরুর দিকে ইংল্যান্ডে চার্চ ও সামন্তশাসকদের মধ্যে যে টানাপোড়েন দেখা দিয়েছিল, সে রাজনৈতিক সংকট উত্তরণে জনগনের সামনে যে নতুন চিন্তাধারা ও মানবিক প্রত্যাশার আলো জ্বালানো হয়েছিল তার নাম ম্যাগনা কার্টা। একদিকে সামন্ত রাজাদের বিদ্রোহ ও গৃহযুদ্ধ থেকে নিজেকে রক্ষা এবং চার্চের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের কৌশল হিসেবেই কিং জন ১২১৫ সালে ইংল্যান্ডে মানবাধিকারের ঐতিহাসিক দলিল ম্যাগনা কার্টায় স্বাক্ষর করেন। এর মধ্য দিয়ে রাজার একচ্ছত্র ক্ষমতা কমিয়ে প্রজাদের নিরাপত্তা ও মুক্ত জীবনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়। এই ম্যাগনা কার্টার প্রতিফলন বৃটিশ দিগি¦জয়ীদের মধ্যে তেমন দেখা যায় নি। তা না হলে ১৬১৯ সালে তারা আমেরিকায় দাসত্ব প্রথা চালু করত না। ১১৮৯ খৃস্টাব্দে নিজ দুই পুত্র রিচার্ড ও জনের অবাধ্য আচরণ ও অরাজক পরিস্থিতিতে রাজা দ্বিতীয় হেনরি মারা যাওয়ার পর একই বছর খৃষ্টানদের তৃতীয় ক্রুসেড শুরু হলে রিচার্ড তার প্রাসাদ ত্যাগ করে ক্রুসেডের জন্য সৈন্য নিয়ে বেরিয়ে গেলে অস্ট্রিয়া সীমান্তে রাজা লিওপোল্ডের বাহিনীর হাতে বন্দি হন। চারবছর পর বিপুল পরিমান মুক্তিপণের বিনিময়ে তিনি দেশে ফিরে আসতে সক্ষম হন। বাবা ও ভাইয়ের সাথে প্রতারণা এবং প্রজা ও সামন্ত রাজাদের প্রতি নির্মম ও বেপরোয়া রাজা জন ম্যাগনা কার্টার প্রবর্তন করলে ইতিহাসের কুখ্যাত রাজা হিসেবেই পরিচিতি লাভ করেছেন। ইউরোপীয় চার্চ ও রাজশক্তি যখন তৃতীয় ক্রুসেড চলছিল ভারতীয় উপমহাদেশে তখন ইরানি সুন্নী মতাবলম্বি ঘুরি রাজবংশের রাজ্য বিজয় ও সাম্রাজ্য বিস্তার চলছিল। গজনি থেকে উত্তর ভারত পর্যন্ত রাজ্য সীমা বিস্তারের পর মুইজুদ্দিন মুহম্মদ ঘুরি ১২০৬ সালে মারা যাওয়ার আগে তার এককালের বিশ্বস্ত ক্রীতদাস কুতুবুদ্দিন আইবেককে ভারতে ঘুরি সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার নিযুক্ত করে যান। দিল্লী সালতানাতকে আধুনিক ভারতের ভিত্তি নির্মানের কারিগর হিসেবে অভিহিত করা হয়। নি:সন্তান সুলতান মুইজুদ্দিন মুহাম্মদ ঘুরি কৃতদাসদের সন্তানের মত ভালবাসতেন এবং সেভাবেই রাজ্যাভিষেকের উপযুক্ত করে গড়ে তুলেছিলেন। চিশতিয়া তরিকার সুফী সাধক খাজা মইনুদ্দিন চিশতির শিস্য সূফী কুতুবুদ্দিন বখতিয়ার কাকীর স্মরণে কুতুবুদ্দিন আইবেক দিল্লীর উপকণ্ঠে যে মিনার নির্মান করেন তা এখন কুতুব মিনার নামে বিখ্যাত। দাস থেকে দিল্লীর সুলতান হওয়া কুতুবুদ্দিন আইবেক মাত্র ৪ বছর বেঁচেছিলেন। স্বল্প সময়ে তার ঔদার্য, মহত্ব ও দানশীলতার যে পরিচয় পাওয়া যায় তৎকালীন ইউরোপের কোনো রাজাকে তার সাথে মেলানো যায় না। ইংল্যান্ডে ম্যাগনা কার্টা স্বাক্ষরিত হওয়ার ৬০০ বছর আগে ইসলামের প্রফেট মুহাম্মদ (স.) এর বিদায় হজের ভাষণের মধ্য দিয়ে আরবের মক্কায় মানবেতিহাসের সবচে গুরুত্বপূর্ণ মুক্তির সনদ ঘোষিত হয়ছিল। সেই থেকে আজ পর্যন্ত দেশে দেশে পুঁজিবাদি অর্থনৈতিক লুণ্ঠন এবং মানবতার শত্রুদের মূল প্রতিপক্ষ হচ্ছে ইসলামের সাম্য ও শান্তির শিক্ষা। তারা এখনো সভ্যতার উপর বর্ণবাদি বৈষম্য, দাসত্বের শৃঙ্খল পরিয়ে বিশ্বকে শাসন করতে চায়।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন