পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
গত এক দশকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার গড়ে ৬ শতাংশ এবং তা এখন ৭-এর উপরে বলা হচ্ছে, যা দেশের জন্য খুবই কল্যাণকর সংবাদ। কিন্তু এই প্রবৃদ্ধি অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের কতটুকু ভূমিকা পালন করেছে? পরিসংখ্যান বলছে যে উচ্চ হারের প্রবৃদ্ধির সাথে সাথে বাংলাদেশের তরুণদের মাঝে বেকারত্বের হারও বেড়েছে। আইএলও ২০১৮ এর প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৩.৩২ থেকে বেড়ে ১২.৮ হয়েছে। কিন্তু বেকারত্বের হার আরো কমার কথা যেহেতু দেশের প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। উচ্চ প্রবৃদ্ধি দেশে আরো বেশি কর্মসংস্থান তৈরি করবে যার মাধ্যমে দেশের বেকারত্বের হার হ্রাস পাবে কিন্তু ঘটছে তার ঠিক উল্টো। ভুটান, নেপালের মত দেশগুলিও ইদানীং উচ্চহারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে এবং সেই দেশগুলিতে বেকারত্বের হারও হ্রাস পাচ্ছে, তাহলে বাংলাদেশে উচ্চ প্রবৃদ্ধি থাকা সত্তে¡ও বেকারত্ব কেন বাড়ছে? কারণ হিসেবে প্রায়ই বলা হয়ে থাকে যে দেশের প্রবৃদ্ধির সাথে সাথে দেশে দক্ষ জনশক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে না অথবা প্রবৃদ্ধি পর্যাপ্ত পরিমাণে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করছে না। সঠিক বিশ্লেষণ ছাড়া জানা সম্ভব নয় কোন বিবৃতিটি সম্পূর্ণভাবে সত্য।
অতীতের তুলনায় বর্তমান বাংলাদেশে শিক্ষার হার অনেক বেশি। সাধারণত বিদ্যালয়ে কাটানোর প্রত্যাশিত গড় সময় এবং প্রত্যাশিত গড় আয়ুষ্কাল দিয়ে মানব সম্পদ মাপা হয় আর উভয় ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ গত কয়েক বছর ধরে এগিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ব ব্যাংকের মানব সম্পদ ইনডেক্সে ১.০০ এর মধ্যে বাংলাদেশ পেয়েছে ০.০৪৮ যা আশেপাশের কিছু দেশের তুলনায় অনেক বেশি (ইন্ডিয়া ০.৪৪ আর পাকিস্তান ০.৩৯)।
অথচ বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় চার লাখ বিদেশি নাগরিক কর্মরত আছে এবং ২০১৬ সালে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ যে জনশক্তি রপ্তানি করে তার মোট ৫০ শতাংশই অদক্ষ। সুতরাং দেশে যে কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না তা নয় আর দেশে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান তৈরি না হলেও বহির্বিশ্বে বর্তমানে দক্ষ শ্রমশক্তির অনেক চাহিদা রয়েছে। আর বাংলাদেশ সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে দেশের বেকারত্বের হার হ্রাস করতে পারছেনা তার কারণ বাংলাদেশের শিক্ষিত জনশক্তির সংখ্যায় কোনো ঘাটতি নেই আছে মানের। যদিও শিক্ষার্জনের সংখ্যাগত পরিসংখ্যানের অভাব নেই তবে শিক্ষার মান সম্পর্কিত পরিসংখ্যানের ঘাটতি অনেক বেশি। তবে যেটুকু তথ্য পাওয়া যায়, তে থেকেই নির্দিষ্ট একটি উপসংহারে পৌঁছানো সম্ভব।
বাংলাদেশে বর্তমান শ্রমশক্তি বেশি সময় স্কুলে কাটালেও তাদের যোগ্যতা এবং দক্ষতার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। কারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো মানসম্মত নয় আর প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী উভয়ের অবস্থা একই। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী মাধ্যমিক পর্যায়ে প্রায় ৫০ ভাগেরো বেশি শিক্ষক সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরিতে অক্ষম আর ৩০ শতাংশেরও বেশি শিক্ষক সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরির ক্ষেত্রে তার সহকর্মী হতে সাহায্য নিয়ে থাকে।
অপর দিকে শিক্ষার্থীদের কৃতিত্বের মানও তেমন সন্তোষজনক নয়। যদিও সকল শিক্ষার সকল পর্যায়ে পাশের হার উচ্চ কিন্তু বিশ্ব ব্যাংকের মতে বাংলাদেশের শিশুদের বিদ্যালয়ে কাটানোর প্রত্যাশিত গড় সময় এগারো বছর হলেও নিম্ন মানের শিক্ষা গ্রহণের কারণে তারা প্রায় ৪.৫ বছরের মত সময় হারিয়ে ফেলে। তথ্য মতে, প্রায় ৩৫ শতাংশ গ্রেড থ্রির ছাত্রছাত্রীরা ঠিকমত বাংলা পাঠ করতে পারেনা আর গ্রেড ফাইভের শুধুমাত্র ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী গণিত পরীক্ষায় পাশ করে তাও আবার সর্বনিম্ন মানের পরীক্ষা। সুতরাং, সংখ্যায় যদিও শিক্ষার হার বেড়েছে কিন্তু মানের ক্ষেত্রে তা তুলনামূলক ভাবে বাড়েনি। দেশে এখনো এমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে যারা শিক্ষা নয় বরং সার্টিফিকেট বিক্রি করে। শুধু প্রাথমিক আর মাধ্যমিকই নয়, পিছিয়ে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিও। বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থানও নিচে নেমে এসেছে আগের তুলনায়।
তবে এমনটি ভাবা ঠিক হবে না যে বেকারত্ব শুধুমাত্র নিম্ন মানের শিক্ষার জন্য দায়ী। দেশের উন্নয়নের প্রক্রিয়াও তার জন্য আংশিকভাবে দায়ী। যদিও দেশের আয় বেড়েছে কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে নিচুস্তরে বসবাসকারী জনগণের আয় আরো কমেছে এবং যদিও দেশের শিল্প খাতে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান বৃদ্ধির কথা থাকলেও তা হচ্ছে না। গত পাঁচ বছরে কৃষি খাতে কর্মসংস্থান কমেছে ১.১ শতাংশ আর শিল্প খাতে কর্মসংস্থান বেড়েছে ০.৫ শতাংশ। অপরদিকে সেবা খাতে কর্মসংস্থান বেড়েছে ৪ শতাংশ। সর্বশেষ তথ্য মতে ২০১৬-১৭ বছরে যে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হয় তার প্রায় ৮৫ শতাংশই ইনফরমাল বা অনানুষ্ঠানিক খাতে যা ভালো মানের চাকরি হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। যদিও কিছু নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে তা পর্যাপ্ত নয় এবং মানেও যথেষ্ট নয়। প্রায় কয়েক বছর ধরে শুধু মাত্র গার্মেন্ট শিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিরাট চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করছে কিন্তু নতুন করে অন্যান্য কোনো শক্তিশালী শিল্প খাত তৈরি হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বলে থাকনে যে দেশের অর্থনীতি শুধু মাত্র গার্মেন্ট শিল্প আর বৈদেশিক মুদ্রার ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে।
পৃথিবীর সকল উন্নত দেশই উচ্চ প্রবৃদ্ধি লাভ করেছে শিল্প খাতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির মাধ্যমে, বাংলাদেশ তা পারছে না। অন্যান্য নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশগুলির (যেমন কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম) বেকারত্ব কমছে এবং তার সাথে সাথে শিল্প খাতে কর্মসংস্থানও বাড়ছে অন্যদিকে নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশ হলেও বাংলাদেশে বেকারত্ব হ্রাসে অক্ষম আর শিক্ষার হার বাড়লেও প্রকৃতপক্ষে দক্ষ এবং শিক্ষিত শ্রমশক্তি তৈরি হচ্ছে না।
দেশে দক্ষ মানব সম্পদ তৈরি করা নতুন কর্মসংস্থান থেকেও গুরুত্বপূর্ণ, কারণ দক্ষ এবং শিক্ষিত মানব সম্পদ শুধু দেশেই নয় বরং বিদেশের শ্রমবাজারে অংশগ্রহণের সুযোগ পাবে। কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো এর মতে, ২০০১-২০১৬ সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ যে জনশক্তি বহির্বিশ্বে চাকরির খোঁজে পাড়ি জমায় তার মাত্র ১.৩৬ শতাংশ হচ্ছে প্রফেশনাল আর ৩২.৩২ শতাংশ দক্ষ শ্রমিক। ভবিষ্যতে দক্ষ এবং প্রফেশনাল জনশক্তি রপ্তানির জন্য চাই মানসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থা।
শুধু নতুন কর্মসংস্থান বৃদ্ধির প্রকল্প নিয়ে এমন পরিস্থিতি মোকাবেলা করা সম্ভব নয় বরং প্রয়োজন দক্ষ এবং প্রকৃতপক্ষে শিক্ষিত শ্রমশক্তি তৈরি। যদিও শিক্ষা খাত অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা কিন্তু শিক্ষা খাতের মান উন্নয়নে সরকারের কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। বিগত কয়েক বছর বাজেটে শিক্ষার খাতের অংশ বাড়ছে না। এখন প্রাথমিক মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক, প্রায় সকল ক্ষেত্রেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো মান-হীনতায় ভুগছে। দেশে কর্মসংস্থান এবং শিক্ষিত জনশক্তি বৃদ্ধি করার জন্য সরকারি এবং বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসতে হবে। ২০১৮ সালের গ্লোবাল কম্পিটিটিভ ইনডেক্স (জিসিআই) বা বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা সূচকে বাংলাদেশ আগের চেয়ে এক ধাপ পিছিয়ে গেছে। উক্ত সূচকে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠান, অবকাঠামো এবং দক্ষ জনশক্তির দিক থেকে বিশ্বের ১৪০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০০ এর বাইরে। সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশে যথেষ্ট পরিমাণে কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না আর তার সাথে মানসম্মত শিক্ষিত মানব সম্পদ নেই। দেশে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য সরকারকে অবকাঠামো এবং এবং দক্ষ মানব সম্পদ তৈরির জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। শুধু সরকার নয়, দেশে যাতে কর্মসংস্থানের সাথে সাথে দক্ষ মানব সম্পদ বৃদ্ধি পায় তার জন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকেও এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।