পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ইসলাম নারীকে যেসব অধিকার প্রদান করেছে তন্মধ্যে অন্যতম একটি হলো বিবাহে দেনমোহর। এটি নারীর অগ্রিম অর্থনৈতিক নিরাপত্তা। সংকটকালে এর মাধ্যমে সম্মানজনক জীবনযাপনের একটি সুন্দর ও অর্থবহ ব্যবস্থা। দেনমোহর মুসলিম বিবাহিতা নারীর একচ্ছত্র অধিকার। মুসলিম বিবাহে দেনমোহর তথা মোহরানা নির্ধারণ গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। মোহরানা হল মুসলিম বৈধ বিবাহের সনদ। ইসলামী আইন অনুযায়ীও দেনমোহর হলো বিয়ের অন্যতম শর্ত। এই শর্ত অনুযায়ী বিয়ের সময় মর্যাদার প্রতীক হিসেবে স্বামী কর্তৃক স্ত্রী যে অর্থ-সম্পদ পান বা পাওয়ার অধিকার রাখেন সেটিই দেনমোহর। স্ত্রীর প্রতি স্বামীর সম্মান প্রদর্শনপূর্বক স্বামীকে তার স্ত্রীর মর্যাদার মূল্যায়ন হিসেবে তার ওপর দেনমোহরের দায়িত্ব অর্পণ করেছে। দেনমোহরের মাধ্যমেই দাম্পত্যজীবনে ভালোবাসার প্রথম বীজ বপন করা হয়। মোহরপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা স্ত্রীর মাঝে এই আত্মবিশ্বাস ও আত্মপ্রশান্তি তৈরি করে যে, দু’দিনের ভোগের জন্যই কেবল স্বামী তাকে বিয়ে করেননি বা দেহের স্বাদ ফুরিয়ে গেলেই তাকে রাস্তায় ফেলে দিয়ে অন্য নারীর সন্ধানে তিনি হন্য হয়ে ঘুরবেন না। ইসলামের রীতি অনুযায়ী বিবাহের শুরতেই মোহরানা পরিশোধ করতে হয়। তবে স্ত্রী নিজ থেকে মোহরানা মাফ করলে তা আলাদা বিষয়।
মুসলিম পারিবারিক আইন ১৯৬১ অনুসারে চাহিবা মাত্র স্ত্রীকে দেনমহর প্রদানের কথা উল্লেখ রয়েছে। স্ত্রীকে স্পর্শ করার পূর্বে স্বামীর মৃত্যু হলে কিংবা তালাক হলে মোহরানা পরিশোধ করতে হবে। এক্ষেত্রে যদি মৃত্যু হয় তবে সম্পূর্ণ এবং তালাক এর ক্ষেত্রে অর্ধেক মোহরানা প্রদানের বিধান রয়েছে। ইসলামের বিধি অনুযায়ী বিয়ের শুরুতেই মোহরানা পরিশোধ এর কথা উল্লেখ আছে। স্ত্রী যখন মোহরানা দাবী করে তখনই স্বামী তা প্রদানে বাধ্য থাকবে। এক্ষেত্রে মোহরানা ২ অংশে বিভক্ত করে রাখা হয়, যা হতে এক অংশ বিয়ের সময় এবং আরও এক অংশ বিবাহ বিচ্ছেদ কিংবা স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রীকে প্রদান করতে হয়। দেনমোহর আদায় করতে স্ত্রী চাইলে স্বামীর সম্পত্তি বিক্রয় করতে পারেন, এমনকি যতক্ষণ পর্যন্ত তা প্রদান করা হয় না স্ত্রীর অনুমতি ব্যতিত স্বামী দাম্পত্য জীবনে প্রবেশ করার অধিকার রাখে না। সামর্থ্য অনুযায়ী মোহর নির্ধারণ এবং পরিশোধ করার জন্য ইসলাম নির্দেশ দিয়েছে। যাতে করে স্ত্রীকে তা যথাযতভাবে প্রদানে স্বামী অপারগ না হয়।
দেনমোহরের প্রচলন নতুন নয় বরং প্রাক ইসলামী যুগেও এর রেওয়াজ ছিল। জাহেলি সমাজে বিয়েতে মেয়ে পক্ষকে সদকা দেওয়ার রীতি ছিল। সদকার মালিক হতেন মেয়ের পিতা-মাতা। পরে রাসুল (সা.) সদকা প্রথায় কিছুটা সংশোধন করে এটাকে দেনমোহরের সঙ্গে একত্র করে দেন এবং দেনমোহরকে স্ত্রীর একক প্রাপ্য বলে ঘোষণা করেন। ইসলামী আইনে দেনমোহর স্ত্রীর বিশেষ অধিকার। কোরআন মাজিদে স্ত্রীকে তার এ অধিকার বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য বারবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এমনকি বলা হয়েছে, স্ত্রী ক্রীতদাসী হলেও তাকে মোহর প্রদান করতে হবে। হ্যাঁ, স্ত্রী যদি সেচ্ছায় তা গ্রহণ করতে না চান বা আংশিক গ্রহণ করতে চান, তাহলে তা ভিন্ন কথা। এ প্রসঙ্গে আলাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘হে নবী! আমি আপনার স্ত্রীগণকে আপনার জন্য বৈধ করেছি, যাদেরকে তুমি মোহরানা প্রদান করেছে’। (সূরা নিসা : ৩৩)। কুরআন কারিমে আরও এরশাদ হয়েছে,-যদি তাদেরকে মোহরানা প্রদান করে থাক, তবে তাদেরকে বিবাহ করায় তোমাদের কোন অপরাধ নেই। (সূরা নসা : ৬০)। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা আরও এরশাদ করেন, তোমাদের স্ত্রীদের মোহরানা তাদেরকে সদকা স্বরুপ দাও, অবশ্য যদি তারা এর কিছু অংশ ক্ষমা করে দেয় তবে তা সন্তুষ্টিচিত্তে ভোগ করতে পার’। (সূরা নিসা : ৪)।
বিশুদ্ধ হাদিস গ্রন্থেও মোহরের গুরুত্ব বর্ণনা করা হয়েছে। হজরত আবু সালমা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি হজরত আয়েশাকে (রা.) জিজ্ঞেস করলাম, নবীজির (সা.) বিয়েতে মোহরের পরিমাণ কত ছিল? তিনি বললেন,তার বিবাহের মোহর ছিল ‘বার উকিয়া’ ও ‘এক নাশ্ব’ যার পরিমাণ ছিল ‘পাঁচশত দিরহাম’। (মুসলিম : ২৯৪৭)। হজরত ওমর (রা.) বলেছেন, সাবধান! তোমরা স্ত্রীদের মোহর বেশি ধার্য করবে না, কেননা তা যদি দুনিয়াতে সম্মানের এবং আখেরাতে আলাহর নিকট তাকওয়ার বিষয় হত, তবে সেই ব্যাপারে তোমাদের চেয়ে রাসুল (সা.) অধিক উপযোগী ছিলেন। কিন্তু রাসুলুল্লাহ (সা.) বার উকিয়ার বেশি দিয়ে তাঁর কোন স্ত্রীকে বিবাহ করেছেন, তাঁর কোন কন্যাকে বিবাহ দিয়েছেন বলে আমার জানা নেই। তিরমিজি : ২৬৯১)।
হজরত ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাাহ (সা.) ‘শেগার’ নিষেধ করেছেন। শেগার বলতে বুঝায়, কোন ব্যক্তি তার কন্যাকে এ শর্তে বিবাহ দেয়া যে, তার কন্যাকে তার কাছে বিনিময়ে বিবাহ দেবে এবং কোন মোহরানা তাদের মধ্যে থাকবে না’। (বুখারি : ২৭৩৬)। রাসুল (সা.) আরও বলেছেন, যে ব্যক্তি কোনো নারীকে কম বা বেশি মোহর ধার্য করে বিয়ে করল অথচ তার অন্তরে মোহরের সে হক আদায়ের আদৌ কোনো ইচ্ছাই নেই, সে ব্যক্তি কেয়ামতের দিন আল্লাহর দরবারে ব্যভিচারী হিসেবে উপস্থিত হবে। (তাবারানি)। হজরত আমির বিন রাবিয়া (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন বনু ফাজারা সম্প্রদায়ের কোন স্ত্রীলোককে এক জোড়া জুতার বিনিময়ে বিবাহ দেয়া হয়েছিল। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন তুমি কি তোমার দেহ এবং সম্পদের পরিবর্তে এক জোড়া জুতা পেয়ে সন্তুষ্ট হয়েছো? স্ত্রীলোকটি বললো হ্যাঁ। তারপর তাকে তিনি অনুমতি দিলেন।(তিরমিজি : ১৯৭৪)। হজরত ওকবাহ বিন আমর (রা.) হতে বর্ণিত রাসুলুলাহ (সা.) বলেছেন, বিবাহে যে শর্ত সর্বপ্রথম পূরণীয় তা হল তা (মোহর) যা দ্বারা গুপ্তাঙ্গ বৈধ করা হয়েছে। (বুখারি : ২৭৪১)।
মুসলিম আইন অনুসারে একটি বিয়ে বৈধ বা শুদ্ধ হতে হলে ৫টি শর্ত পূরণ করতে হয়। মোহর প্রদান ৫টি শর্তের অন্যতম একটি শর্ত। মোহর ছাড়া বিয়ে পুরোপুরি বাতিল না হলেও এ ধরণের বিয়ে ফাসিদ বা ত্রুটিযুক্ত। যে কোনো সময় মোহর নির্ধারণ বা পরিশোধ করা হলে ফ্যাসিদ বিয়েটি বৈধ হয়ে যাবে। মোহর বিয়ের আগে, বিয়ের সময় বা পরেও নির্ধারণ করা যায়। বিয়ের সময় যদি মোহর নির্ধারিত না হয়ে থাকে, এমনকি স্ত্রী কোনো মোহর দাবি করবেন না শর্তে বিয়ে সম্পাদিত হয় তাহলেও স্ত্রীকে মোহর দিতে হবে। স্বামী কোনো অজুহাত দেখিয়েই স্ত্রীকে মোহর দেওয়া থেকে বিরত থাকতে পারবেন না। মোহরানা ব্যাপারটি যতক্ষণ পযন্ত ফয়সালা না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত কোন বিয়ে ইসলামী আইনে বৈধ হতে পারে না। কারণ মোহরানা ফরজ একটি বিধান। বিয়ের সময় দেনমোহর পুরোটা পরিশোধ করা যায়। আবার খরচাপাতি (গহনা, অলঙ্কার) করে পরিশোধ করা যায়। আবার সংসার জীবনে ধীরে ধীরে পরিশোধও করতে পারবেন স্বামী। তবে যখনই স্ত্রী স্বামীকে দেনমোহর দেয়ার কথা বলবে তখনই স্বামী দেনমোহর পরিশোধ করতে হবে। আর যদি স্ত্রী স্বামীকে দেনমোহরের ব্যাপারে স্বামীকে না বলে তাহলে স্বামীর ওপর দায়িত্ব হলো স্বেচ্ছায় স্ত্রীর দেনমোহর পরিশোধ করা। যে পরিমাণ অর্থ উল্লেখ থাকবে সে পরিমাণ অর্থই দিতে হবে। এর সামান্য পরিমাণ কম দিলেও মোহর আদায় হবে না। তবে স্ত্রী যদি স্বেচ্ছায় স্বামীর ওপর অনুগ্রহ করে মোহর কমিয়ে দেন তখন কম দিলে অসুবিধে নেই। মোহরানার মালিকানা স্বত্ব একমাত্র স্ত্রীরই। স্ত্রী ইচ্ছা করলে স্বামীকে পুরো মোহরও মাফ করে দিতে পারেন। কিন্তু স্বামীকর্তৃক চাপে বাধ্য করে মোহরানা কমানো বা মাফ করানো যাবে না। স্ত্রী মোহরানা মাফ না করলে কখনও স্বামী এ দায়িত্ব থেকে নিষ্কৃতি পাবেন না। বিয়ে বিচ্ছেদের সময় স্ত্রীর মোহরানা পরিশোধ করা স্বামীর ওপর একান্ত অপরিহার্য দায়িত্ব। রাসুল (সা.) এরশাদ করেন-যে ব্যক্তি কোন নারীকে মোহর দানের শর্তে বিয়ে করেছে অথচ মোহর আদায়ের নিয়ত তার নাই তবে সে ব্যভিচারি। (তিরমিজি : ২৪৬১ )। লোক দেখানো মাত্রা অতিরিক্ত মোহর ধার্য না করে যার যতটুকু সামর্থ্য আছে সে পরিমাণ মোহর নির্ধারণ করা এবং পরিপূর্ণ আদায় করা ইসলামের নির্দেশ। কোনো অবস্থায় মোহর খুব বেশি হওয়া উচিত নয়, যা স্বামীর পক্ষে পরিশোধ করা সম্ভব নয়। আবার খুব কম হওয়াও উচিত নয়, যা স্ত্রীর আর্থিক নিরাপত্তা দিতে পারে না। এ জন্য বিয়েতে রাসুলের (সা.) সুন্নত ‘মোহরে ফাতেমি’ নির্ধারণ করা উত্তম।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট ও শিক্ষক
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।