Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নদ-নদীর দখল-দূষণ কি চলতেই থাকবে

| প্রকাশের সময় : ২৫ আগস্ট, ২০১৯, ১২:০২ এএম

হাজারিবাগের ট্যানারি শিল্প থেকে নিঃসৃত বিষাক্ত বর্জ্যদূষণ থেকে বুড়িগঙ্গা ও আশপাশের পরিবেশকে বাঁচাতে এই শিল্পকে সাভারস্থ আধুনিক ট্যানারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে স্থানান্তর করা হয়েছিল। ট্যানারি মালিকদের সেখানে যেতে গড়িমসি এবং সরকারের চাপে অনেকটা অসম্পূর্ণ অবস্থায় ১৫৪টি ট্যানারি শিল্প স্থানান্তরিত হয়। এর মধ্যে মাত্র ১২৩টি ট্যানারি কার্যক্রম শুরু করেছে। দেখা যাচ্ছে, যে দূষণের কারণে বুড়িগঙ্গাকে বাঁচাতে এই শিল্প স্থানান্তরিত করা হয়েছে, তাতে কোন লাভ হচ্ছে না। বরং সেখানের ধলেশ্বরী নদী ও আশপাশের পরিবেশ, কৃষিজমি এই শিল্প থেকে নিঃসৃত বিষাক্ত কঠিন ও তারল বর্জ্য মারাত্মকভাবে দূষিত করে চলেছে। ট্যানারি বর্জ্য পরিশোধনের জন্য যে সিইটিপি বা কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার তৈরি করা হয়েছে, তা এখনও অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। শোধনাগারটি সম্পূর্ণ করার জন্য আটবার সময় বেঁধে দেয়া হলেও তা পুরোপুরি প্রস্তুত হয়নি। পরিস্থিতি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, ট্যানারির কঠিন ও তরল বিষাক্ত বর্জ্য এখন সরাসরি খোলা জায়গা ও নদীতে গিয়ে পড়ছে। ট্যানারি মালিকরা বলছেন, চামড়ার পিক টাইমে যে পরিমাণ বর্জ্য উৎপাদিত হয়, সে পরিমাণ বর্জ্য শোধনের সক্ষমতা সিইটিপির নেই। অন্যদিকে প্রকল্প পরিচালক বলছেন, ট্যানারিগুলো চামড়া ট্যান করার জন্য অতিরিক্ত পানি ব্যবহারের ফলে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, সিইটিপি সম্পূর্ণ না করা এবং অব্যবস্থাপনার কারণে কর্তৃপক্ষ এ ধরনের অজুহাত দেখাচ্ছে। ফলে ট্যানারির বিষাক্ত বর্জ্য উপচে পড়ে ধলেশ্বরি ও আশপাশের পরিবেশকে মারাত্মক দূষিত করে চলেছে। এদিকে একটি ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, দেশের অন্যতম প্রধান নদী মেঘনাও শিল্পবর্জ্য এবং অন্যান্য উৎস থেকে নিঃসরিত বিষাক্ত বর্জ্যে মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে। এডিবি’র গবেষণায় বলা হয়েছে, এখন থেকে যদি এই দূষণ রোধে কার্যকর পদেক্ষেপ না নেয়া হয়, তবে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে নদীটির পানি পরিশোধনের অযোগ্য হয়ে পড়বে। উল্লেখ্য, মেঘনা নদীর পানি পরিশোধনের মাধ্যমে রাজধানীর শতকরা ৪০ ভাগ পানি সরবরাহ করা হয়।

শিল্পকারখানা ও হাসপাতালের বিষাক্ত কেমিক্যাল বর্জ্য, গৃহস্থালি ও পয়ঃনিষ্কাশনের অপরিশোধিত বর্জ্যরে কারণে দেশের নদ-নদীগুলোর দখল-দূষণ বছরের পর বছর ধরে চলছে। এ নিয়ে পরিবেশবিদদের আন্দোলনসহ পত্র-পত্রিকায় বিস্তর লেখালেখি হয়েছে। এতে স্থানীয় প্রশাসন, জেলা প্রশাসক, সর্বোপরি সরকারের কোনো টনক নড়েছে বলে মনে হয় না। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও সরকারের মধ্যে এক ধরনের উদাসীনতা বরাবরই পরিলক্ষিত হচ্ছে। কিছুদিন নদীদখলমুক্ত করার ফটোসেশন করে দেখানো হয় উচ্ছেদ করা হচ্ছে। তারপর আবার নীরব হয়ে যায়। অথচ দেশের শ্যামলিমা এবং কৃষি ও যোগাযোগ খাতের অন্যতম প্রধান উৎস নদ-নদীগুলো দখল-দূষণের কবলে পড়ে দিনের পর দিন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। গতিপথ হারিয়ে মৃতপ্রায় অবস্থায় উপনীত। ভাবা যায়, দেশের অন্যতম প্রধান নদী মেঘনার পানি এখন ভয়াবহ দূষণের কবলে! ছোট ছোট নদী বা শাখা নদীর কথা বাদই দেয়া যাক। রাজধানীর প্রাণখ্যাত বুড়িগঙ্গা তো অনেক আগেই মরেছে। তুরাগ, বালুও মরেছে। এখন মরছে ধলেশ্বরী। দেশের রুই জাতীয় মাছের প্রজননের একমাত্র প্রাকৃতিক নদী হালদাও দখল-দূষণে শেষ হয়ে যাচ্ছে-এমন গুরুত্বপূর্ণ আরও অনেক নদ-নদীই মরার পথে। কয়েক মাস আগে দেশের নদীরক্ষা বিষয়ক কমিশন জেলা প্রশাসকদের চিঠি দিয়ে অনুরোধ করেছিল, তাদের স্ব স্ব এলাকায় নদ-নদী দখলকারিদের নামের তালিকা কমিশনে প্রেরণ করতে। কোনো কোনো জেলার প্রশাসক এ ধরনের নামের তালিকা কমিশনে প্রেরণ করে। শুধু ঢাকা, নারায়ণগঞ্জসহ আশপাশের জেলাগুলো থেকে এ তালিকা দেয়া হয়নি। নদীরক্ষা কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যারা নদ-নদী অবৈধভাবে দখল করে আছে তাদের নামের তালিকা প্রকাশ করবে। দেখা গেল, প্রাপ্ত জেলার তালিকানুযায়ী দখলকারিদের সংখ্যা প্রকাশ করা হয়েছে। প্রাথমিক সংখ্যা অনুযায়ী অবৈধভাবে দখলকারির সংখ্যা পঞ্চাশ হাজারের বেশি। এদের মধ্যে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিসহ ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক নেতার নাম রয়েছে। তবে নামের তালিকা পুরোপুরি প্রকাশ করা হযনি। কিছু জেলায় স্থানীয় প্রশাসন কর্তৃক দখলকারিদের নাম প্রকাশ করা হয়। এরপর তা থেমে যায়। বলা যায়, নদীরক্ষা কমিশনের একটি মহতী উদ্যোগ ডিপ ফ্রিজে চলে গেছে। এর কারণ সম্পর্কে সবারই জানা। এসব তালিকায় অনেক ক্ষমতাধর রাঘব-বোয়ালরা রয়েছে, যাদের প্রভাব-প্রতিপত্তির কাছে অনেক সময় প্রশাসনও অসহায় হয়ে পড়ে। মাস কয়েক আগে মেঘনা নদী দখল করে গড়ে উঠা শিল্প প্রতিষ্ঠানে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়। কিছু কিছু উচ্ছেদও হয়। তারপর তা থেমে গেছে। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু নদী থেকেও অবৈধ দখলকারিদের অনেককে উচ্ছেদ করা হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে এই উচ্ছেদ কার্যক্রম ছিল সবচেয়ে সফল। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে উচ্ছেদকৃত জায়গা সংরক্ষণে পার্ক, ওয়াক ওয়ে, প্রাকৃতিক দৃশ্যসম্বলিত পার্ক নির্মাণের সুন্দর পরিকল্পনার কথা বলা হয়। এজন্য একটি প্রকল্পও হাতে নেয়া হয়। দেখা যাচ্ছে, এই প্রকল্পের কাজ আটকে গেছে। ফলে আশঙ্কা করা হচ্ছে, অচিরেই উচ্ছেদকৃত জায়গা আবার দখল হয়ে যাবে এবং নদ-নদী দখল ও দূষণের কবলে পড়বে। দেশের শিল্পকারখানা থেকে বছরে যে হাজার হাজার টন বিষাক্ত কেমিক্যাল বর্জ্য পরিশোধনহীনভাবে সরাসরি নদ-নদীগুলোতে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে, তাতে অদূর ভবিষ্যতে কোনো নদ-নদীতেই স্বচ্ছ পানি বলে কিছু থাকবে না। দূষণের কারণে আগামী ৫ বছরের মধ্যে মেঘনা নদীর পানি পরিশোধন অযোগ্য হয়ে পড়বে বলে বলা হচ্ছে এবং সাভারের ট্যানারির বিষাক্ত বর্জ্য যেভাবে নিঃসরিত হচ্ছে, এর প্রভাব যে অন্যান্য নদ-নদীকেও দূষিত করবে, তাতে সন্দেহ নেই। এসব ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের তেমন কোনো কার্যকর উদ্যোগই পরিলক্ষিত হচ্ছে না। তাদের আচরণ অনেকটা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, বৃষ্টি বা বর্ষা হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, বৃষ্টি এবং বর্ষার পানিও এসব নদ-নদীর দূষণ রোধ করতে পারছে না। নদ-নদী দূষণকারীদের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ না নিয়ে সংশ্লিষ্টরা যেন প্রকৃতির ওপর ভরসা করে বসে আছে।

খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধে র‌্যাবসহ ভ্রাম্যমান আদালত প্রায়ই অভিযান চালায় এবং দায়ীদের জেল-জরিমানা করে থাকে। অথচ যে কাজগুলো সরকারের এবং প্রশাসন সংশ্লিষ্ট সেগুলোতে কোনো হাত দেয়া হচ্ছে না। সাভারের ট্যানারি শিল্প সরকারের, নদ-নদী সরকারের, দেখা যাচ্ছে এসব ক্ষেত্রে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি হলেও সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই। শিল্পকারখানার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং দূষণের বিষয়টি সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দেখার কথা। বছরের পর বছর ধরে এক্ষেত্রে চরম অনিয়ম চলতে থাকলেও তার কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। অসংখ্য শিল্পকারখানা কোনো ধরনের পরিশোধন ছাড়াই নির্বিঘ্নে বিষাক্ত কেমিক্যাল সরাসরি নদ-নদীতে ফেলছে। এ ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রীয় এবং স্থানীয় প্রশাসনের কোনো পদক্ষেপ নেই। তাহলে এসব প্রশাসনের কাজ কি? জেলা প্রশাসকদেরই বা কাজ কি? তারা কি এ বিষয়গুলো দেখতে পারে না? বিশ্লেষকরা বলছেন, সর্ষের ভেতর ভূত বসে থাকলে, সে ভূত তাড়ানো কোনোভাবেই সম্ভব নয়। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও কর্তৃপক্ষের মধ্যে এই ভূত বসবাস করছে বলেই কোনো প্রতিকার হচ্ছে না।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন