পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
মানুষ সহ পৃথিবীর সকল স্তন্যপায়ী প্রাণী ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর যে খ্যাদ্যটি গ্রহণ করে তা হলো দুধ। মায়ের দুধের পর মানুষ সাধারণত গরু, মহিষ, ছাগল বা ভেড়ার দুধ পান করে। দুধ সব বয়সের মানুষের সুস্বাস্থ্যর জন্য গুরুত্বপূর্ণ, এতে রয়েছে আমিষ, শর্করা, চর্বি, অসংখ্য খনিজ উপাদান এবং ভিটামিনের এক চমৎকার সংমিশ্রণ, যে কারণে দুধকে বলা হয় আদর্শ খাবার। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য মোতাবেক গত এক দশকে দুধের উৎপাদন বেড়েছে সাড়ে তিনগুন, যা নিকট ভবিষ্যতে দেশকে দুধ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ করণের এক বিশাল হাতছানি। কিন্তু, নানাবিধ সমস্যার কারণে উদীয়মান দুগ্ধশিল্প আজ অস্তিত্ব সংকটের মুখোমুখি।
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. আ ব ম ফারুক স্যার পাস্তুরিত দুধের ১০ টি নমুনা পরীক্ষা করে সিপ্রোফ্লক্সাসিন, এজিথ্রোমাইসিন, এনরোফ্লক্সসিন এবং লেভোফ্লক্সাসিন এন্টিবায়োটিকের মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতির কথা সংবাদ সম্মেলন করে দেশবাশীকে অবগত করেন। কিন্তু, মাঠ পর্যায়ে কর্মরত ভেটেরিনারি ডাক্তারদের ভাষ্যমতে গবাদিপশুর চিকিৎসায় এনরোফ্লক্সাসিন এবং লেভোফ্লক্সাসিন এন্টিবায়োটিক কখনো ব্যবহার করা হয়না, এই ২টি হলো মানুুষে ব্যবহৃত এন্টিবায়োটিক। কাজেই, প্রশ্ন হলো ঐ এন্টিবায়োটিকগুলো দুধে প্রবেশের উৎস কি?
পরবর্তীতে দেশের ৪ টি গবেষণাগারে ১৪ টি কোম্পানির পাস্তুরিত দুধের নমুনা পরীক্ষায় এন্টিবায়োটিক ও সিসার উপস্থিতি পাওয়ায় ঐ সকল প্রতিষ্ঠানকে পাস্তুরিত দুধ উৎপাদন ও বিপণন থেকে আগামী ৫ সপ্তাহ বিরত থাকার একটি নির্দেশ গত ২৮ই জুলাই মহামান্য হাইকোর্ট দিয়েছে (যদিও কিছু কোম্পানির আদেশ পরে স্থগিত হয়েছে)। পৃথিবীর অনেক দেশের গরুর দুধেই এন্টিবায়োটিক ও ভারী ধাতু পাওয়া যায় এবং একটি নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত এদের উপস্থিতি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয়। আর সেজন্যই আন্তর্জাতিকভাবে দুধে এন্টিবায়োটিক ও অন্যান্য ক্ষতিকারক উপাদানের জন্য নির্দিষ্ট ম্যাক্সিমাম রেসিডিও লিমিট (এমআরএল) রয়েছে। হাইর্কোটের আদেশের পর, কোম্পানিগুলো তরল দুধ কেনা কমিয়ে দিয়েছে। প্রশ্ন হল, কৃষকের গাভীগুলো কি দুধ উৎপাদন এবং খাওয়া বন্ধ রাখবে? উপার্জনের একমাত্র মাধ্যম গাভীর দুধ বিক্রি করতে না পেরে খামারিরা ভাষাহীন, প্রতিবাদ জানাচ্ছে সড়কে দুধ ঢেলে। গাভীর জীবন বাঁচাতে কৃষক সর্বস্ব হারিয়ে হলেও উচ্চমূল্যের গোখাদ্য খাওয়াবে। অথচ কৃষককে বাঁচিয়ে আমরা দুধের ভেজাল নির্মূলের বিকল্প উপায় পেলাম না!
বাজারের দুধে এন্টিবায়োটিকের মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতির বিষয়েকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন মহলকে সরব মনে হচ্ছে। খবরটি সাধারণ জনমনে এমন প্রভাব ফেলছে যেন দুধে এন্টিবায়োটিক নয়-বিষের উপস্থিতি শনাক্ত করা হয়েছে। কিন্তু, দুধে ক্ষতিকারক উপাদানের প্রকৃত উৎস এবং সেগুলো প্রবেশ রোধে কার্যকরী পদক্ষেপ তথা দেশকে দুধ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার লক্ষ্যে করণীয় সম্পর্কে কথা বলার লোকের বড্ড অভাব। একইভাবে বিদেশ থেকে আমদানিকৃত নিম্নমানের গুঁড়ো দুধের ভেজাল নির্ণয়েও আমাদের আগ্রহ কম। এই সমস্যাটি মোকাবেলা করার লক্ষ্যে ডেইরি শিল্প ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সকল বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে দুধে এন্টিবায়োটিকের উৎস ও প্রবেশ রোধে করণীয় বিষয়ে আজও কোনো সভা বা সেমিনার জাতীয় পর্যায়ে অনুষ্ঠিত হল না। আমাদের সমস্যা হলো আমরা কোন জাতীয় বা জনস্বাস্থ্য বিষয়ে একসাথে বসে সম্মিলিত উদ্যোগ ও করণীয় ঠিক করতে পারিনা। দুধের দূষণ সমাধানে যেমন আমারা একসাথে বসতে পারিনা-তেমনি বসতে পারিনা ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধের সমাধানেও। আর সে কারণেই দূষণ আজ সমাজের রন্দ্রে-রন্দ্রে, শুধু গরুর দুধেই নয়।
দুগ্ধশিল্প বিকাশে আরেকটি বড় বাধা হল প্রান্তিক খামারীদের নিকট ভেটেরিনারি সেবার অপ্রতুলতা। বর্তমানে একটি উপজেলার ৭-৮ লাখ গবাদিপশু-পাখির স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা ও চিকিৎসার জন্য মাত্র ১ জন ভেটেরিনারি ডাক্তার নিয়োজিত রয়েছেন। ভেটেরিনারি ডাক্তারের অভাবে খামারিরা কোয়াকদের পরামর্শে গবাদিপশু-পাখিতে যাচ্ছেতাই বিভিন্ন ওষুধ ব্যবহার করছে। এছাড়া, অনেক সময় পশুপাখির চিকিৎসায় এন্টিবায়োটিক ব্যবহারের পর নির্দিষ্ট রেসিডুয়াল পিরিয়ড না মেনে গাভীর দুধ বিক্রি করছেন। পশুতে অপ্রয়োজনীয় এন্টিবায়োটিক ব্যবহারের কুফল সম্বন্ধে ভেটেরিনারি ডাক্তার কর্তৃক প্রান্তিক খামারিদের সচেতন করার উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি কোম্পানিগুলোকে দুধ সংগ্রহের পূর্বে আধুনিক যন্ত্র দ্বারা ক্ষতিকারক পদার্থের অনুপস্থিতি নিশ্চিত করে কেবল নিরাপদ দুধ সংগ্রহ করতে হবে। বর্তমানে হাজার হাজার বেকার ভেটেরিনারি ডাক্তার চাকুরী প্রত্যাশায় হতাশ জীবনযাপন করছে। কাজেই, সরকারের উচিত প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে অতিরিক্ত জনবল সংবলিত নতুন অর্গানোগ্রাম পাশ করে প্রতি উপজেলায় কমপক্ষে ৬ জন করে ভেটেরিনারি সার্জন নিয়োগ দিয়ে খামারিদের দোরগোড়ায় ভেটেরিনারি সেবা পৌঁছে দেওয়া।
সম্প্রতি মানুষের চিকিৎসায় রেজিস্টার্ড ডাক্তারের এবং পশু-পাখির চিকিৎসায় রেজিস্টার্ড ভেটেরিনারি ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ব্যাতিত কোন এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা যাবে না এই মর্মে মহামান্য হাইকোর্ট ২টি আলাদা আদেশ জারি করেছে। যাচ্ছেতাই এন্টিবায়োটিক ব্যবহারের ফলে ক্ষতিকারক ব্যাক্টেরিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবহৃত নির্দিষ্ট এন্টিবায়োটিক তার কার্যকারিতা হারায়। অধিকন্তু, মানুষ ও পশু-পাখিতে ব্যবহৃত এন্টিবায়োটিক বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপায়ে খাদ্য চেইন ও পরস্পরের মাঝে ছড়িয়ে পরার আশংকা থাকে। কাজেই, নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে এন্টিবায়োটিকের সুুনির্দিষ্ট ও সীমিত ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে এবং এন্টিবায়োটিক ব্যবহারে হাইকোর্টের আদেশকে মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন সহ আদেশ অমান্যকারীদের শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
প্রাণীসম্পদ অধিদপ্তরের উপাত্ত মোতাবেক দুধের বর্তমান উৎপাদন বাৎসরিক চাহিদার প্রায় দুই তৃতীয়াংশ (৬২.৫৮%)। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে বিদেশ থেকে নিম্নমানের গুঁড়ো দুধ আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ২৭০০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স এসোসিয়েশন এবং জাতীয় ডেইরি উন্নয়ন ফোরাম এদেশে দুগ্ধ বিপ্লব ঘটনার লক্ষ্যে বিদেশি গুঁড়ো দুধে আমদানি শুল্ক ৫০% করার দাবি করে আসছিলেন। কিন্তু, জাতীয় সংসদের ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে গুঁড়ো দুধ আমদানিতে মাত্র ১০ শতাংশ শুল্ক ধার্য করা হয়েছে। দুঃখের বিষয়, কিছু বাংলাদেশি পন্ডিত বিদেশি কোম্পানির গুঁড়ো দুধে আমদানি শুল্ক বাড়ানোর বিপক্ষে অবস্থান নেন। নিকট ভবিষ্যতে আমরা যদি নিরাপদ দুধ উৎপাদনে স্বনির্ভর হতে চাই, তবে বিদেশি উন্নত জাতের ষাঁড়ের বীজ দিয়ে দেশীয় গাভীগুলোকে কৃত্রিম প্রজনন করতে হবে। ফলস্বরূপ আমাদের দেশীয় গাভীর জাত উন্নয়ন ও দুধ উৎপাদন বাড়বে। পাশাপাশি ভ্রুণ স্থানান্তর প্রযুক্তি প্রয়োগ করে অল্প সময়ে অধিক সংখ্যক এই ভালো মানের গাভীর সংখ্যা বৃদ্ধি করে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিতে হবে। অধিকন্তু, আমাদের পর্বতসম বেকার জনগোষ্ঠীকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে দুগ্ধ উৎপাদনকারী পশু পালনে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে তরল দুধের সংরক্ষণ, সরবরাহ ও ন্যায্যমূল্য, পর্যাপ্ত ভেটেরিনারি সেবা ও এন্টিবায়োটিকের যথার্থ ব্যবহার। এতে একদিকে যেমন দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আত্মকর্মসংস্থান হবে, অন্যদিকে দেশের চাহিদার দুধ উৎপাদনসহ বিদেশে আমাদের প্রস্তুতকৃত গুঁড়ো দুধ রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ক্ষেত্রে সৃষ্টি হবে।
দুধের সমস্যায় অবশ্যই কথা বলতে হবে এবং সে সমস্যা নিরুপনে সরকারকে কার্যকারী পদক্ষেপ নিতে বাধ্যও করতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে আমাদের সিদ্ধান্তের ত্রুটির কারণে যেন দরিদ্র দুগ্ধ খামারিদের পথে বসতে না হয় এবং বিদেশি গুঁড়ো দুধ কোম্পানিগুলো দুগ্ধশিল্পের সিংহভাগ দখলে না নিয়ে যায়। কাজেই, দুধ উৎপাদন ও বিপণনে নিষেধাজ্ঞা নয়, বরং দুধে ক্ষতিকারক উপাদানের উৎস নির্ণয় করে তা অনুপ্রবেশের সকল রাস্তা বন্ধ করণে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। চলুন নিজেদের মনকে দূষণমুক্ত করি এবং আমাদের সকল খাবারকে দূষণমুক্ত করতে পরস্পরকে সহযোগিতা করি। কেবল তাতেই, ভেজালমুক্ত বাংলাদেশে নির্ভেজাল গরুর দুধ পাওয়া যাবে।
লেখক: পোস্ট-ডক্টরাল গবেষক ( সহকারী অধ্যাপক, গণবিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ)।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।