Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সীমান্তে হত্যা বন্ধে প্রতিবাদ প্রয়োজন

মো. তোফাজ্জল বিন আমীন | প্রকাশের সময় : ২১ আগস্ট, ২০১৯, ১২:০২ এএম

বাংলাদেশের সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)-এর নিষ্ঠুরতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। পাখি শিকারের মতো ঠান্ডা মাথায় তারা বাংলাদেশী নাগরিকদেরকে গুলি করে হত্যা করছে। অথচ জোরালো প্রতিবাদ নেই। নতজানু পররাষ্ট্রনীতির কারণে ভারতীয় সীমান্তরক্ষাকারী বাহিনী তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে মানুষকে হত্যা করছে। জাতীয় নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের মতে পাশ্ববর্তী রাষ্ট্র হচ্ছে সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর প্রকৃতিগত শত্রু। তার অন্যতম কারণ হচ্ছে পাশ্ববর্তী রাষ্ট্রের জন্যই সীমান্ত পাহারার আয়োজন করে পৃথিবীর সকল রাষ্ট্র। এর ব্যতিক্রম নয় বাংলাদেশ। আমাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর জন্য সবচেয়ে বড় বিপজ্জনক হচ্ছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে নেপাল ভুটান যেমন আমাদের বন্ধু সে হিসেবে ভারতও আমাদের বন্ধু। তবে বন্ধুত্বের ভালোবাসা তো এক পক্ষের ইচ্ছের উপর হয় না, দু’পক্ষরই হাত প্রসারিত করতে হয়। ভারতের বিএসএফের নির্মমতা আর পাশবিকতার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে ভারতকে কখনো আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে প্রতীয়মান হয় না। বন্ধুত্বের নামে নতজানু পররাষ্ট্রনীতিও যদি ভারতকে সন্তুষ্ট করতে না পারে,তাহলে রাষ্ট্রের ভেবে দেখা দরকার আসলে ভারত কী চায়? সীমান্তের নিরীহ নাগরিকদের রক্তের মূল্যে ভারতের বন্ধুত্বকে টিকিয়ে রাখতে আর কত মানুষের প্রাণ দিতে হবে? সরকারের নীতি নির্ধারকদের পক্ষ থেকে জোড়ালো প্রতিবাদ না করায় বিএসএফের নিষ্ঠুরতা সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ভারত নিজেদেরকে গণতান্ত্রিক দাবি করে অথচ প্রতিবেশী রাষ্ট্রের নাগরিকদের সাথে অগ্রণতান্তিক আচরণ করছে,যা সত্যিই দুঃখজনক।

ভারত সীমান্তে বাংলাদেশী নাগরিকদের হত্যা নিয়ে অনেক লেখালেখি হলেও হত্যার হার কমেনি। একতরফাভাবে শুধুমাত্র বাংলাদেশীরা সীমান্তে হত্যার শিকার হচ্ছে। ভারত আমাদের বন্ধুপ্রতীম দেশ এটা কাগজে কলমে থাকলেও বাস্তবে তার কাছ থেকে আমরা বন্ধুসুলভ আচরণ পাইনি। পত্রিকার পাতায় চোখ ভুলালেই ভারতের বিএসএফ বাহিনী কর্তৃক নিরীহ বাংলাদেশী মানুষকে হত্যার সংবাদ প্রায়ই দেখা যায়। এই যদি হয় প্রতিবেশী বন্ধু দেশের আচরণ তাহলে প্রতিবেশীর সংজ্ঞা অভিধান থেকে ডিলিট করাই শ্রেয়। প্রতিবেশী দেশের এমন নিষ্ঠুর আচরণ মোটেও কাম্য নয়। ভারত বন্ধুত্বের যে অঙ্গীকার করে যাচ্ছে তার সাথে সীমান্তে আচরণের মিল খুঁজে পাওয়া মেলা ভার। সীমান্তে হত্যার শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা হত্যার প্রতিকার চাওয়ার সাহসটুকু হারিয়ে ফেলছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে সহযোগিতার অভাব দেখা যাচ্ছে। যেখানে ভারতীয় মানবাধিকার কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে সীমান্তে হত্যা বন্ধে বাংলাদেশের যতটা জোরালো প্রতিবাদ জানানো উচিত বাংলাদেশ ততটা জোরালো প্রতিবাদ করছে না। সেখানে সরকার এ দায় এড়াতে পারে না। দেশের নাগরিকদের হত্যার প্রতিবাদ জানাতে সরকারের এমন উদাসীনতা বেদনাদায়ক।

একটি আধুনিক রাষ্ট্র যখন তার সন্তানতুল্য নাগরিকদের ওপর প্রতিবেশীর বর্বর হত্যাকান্ডের প্রতিবাদ করাটাও ভুলে যায় তখন এর চেয়ে দুঃখের কিছু হতে পারে না। স্বাধীনতার ৪৭ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে ভারত তাদের অধিকার আদায় করা ব্যতিত বাংলাদেশকে কিছুই দেয়নি। ভারত কারণে অকারণে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সীমান্তে মানুষ হত্যার করছে। আর প্রতিটি ঘটনার পর পরই লোক দেখানো পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে তা আড়াল করার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশই সীমান্ত হত্যার সংখ্যা শূন্যের কোঠায় আনার ব্যাপারে একমত হয়েছিল। কিন্তু অদ্যাবধি সীমান্তে মানুষ হত্যা বন্ধ হয়নি। দেশের বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) ও অধিকারের ভাষ্যমতে,চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সীমান্তে ভারতীয় বিএসএফের গুলিতে ১৮ জন নিহত হয়েছেন। গত ১০ মে সাতক্ষীরার কুশখালী সীমান্তের কাছে কবিরুল ইসলাম নামের একজনকে পায়ুপথ ও মুখে পেট্রল ঢেলে হত্যা করা হয়েছে যা বিভিন্ন গণমাধ্যমেও প্রকাশিত হয়েছে। গত ২৭ মে নওগাঁরও সাপাহার সীমান্তে আজিম উদ্দিন নামের এক বাংলাদেশি রাখালের দুই হাতের ১০ আঙুলের নখ উঠিয়ে নেওয়া হয়। এর আগে আমরা উলঙ্গ করে তেল মেখে বাংলাদেশীদের নির্মম নির্যাতন করার ঘটনাও গণমাধ্যমে মুদ্রিত হয়েছে। আইন ও সালিস কেন্দ্রের তথ্যমতে ২০১৩ সালে ২৭ জন, ২০১৪ সালে ৩৩ জন, ২০১৫ সালে ৪২ জন,২০১৭ সালে ১৮ জন বাংলাদেশিকে বিএসএফ হত্যা করেছে। বিজিবির তথ্য অনুযায়ী ২০০১ থেকে ২০১৭ সালের ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত সীমান্তে বিএসএফ ও ভারতীয় নাগরিকদের হাতে ৯৩৬ জন বাংলাদেশি নিহত হন। ২০১১ সালে ফেলানীকে হত্যা করে লাশ সীমান্ত কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। বিএসএফের গুলিতে ফেলানী নিহত হওয়ার পর জোরালো প্রতিবাদ হয়। কিন্তু ওই পর্যন্তই শেষ। অথচ প্রতিবেশীদের ওপর এমন নিষ্ঠুর নৃশংসতার প্রয়োগ অন্য রাষ্ট্রে দেখা যায় না।

গত ১২-১৫ জুলাই ঢাকার পিলখানায় উভয় দেশের মহাপরিচালক পর্যায়ের বৈঠক শেষে বিএসএফের শীর্ষ কর্মকর্তা সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জানান,সীমান্তে হত্যাকান্ড হচ্ছে না; অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যু হচ্ছে। ভারতের বিএসএফ প্রকাশ্যে পিটিয়ে গুলি করে বাংলাদেশী নাগরিকদের হত্যা করলেও সেটা বাহিনী প্রধানের ভাষায় অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যু। এভাবে সত্য এড়িয়ে যাওয়ার প্রবনতা ভারতীয়দের নতুন নয়। কিন্তু বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একই সূরে সংসদে বলেছেন,সীমান্তে হত্যা নাকি কমে আসছে। তার হিসাবে ২০১৮ সালে মাত্র তিনজন মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। অথচ বাস্তবে এ সংখ্যা ছিল ১৪। ভারতীয় বিএসএফ এর নিষ্ঠুরতা বন্ধে সরকারের উচিত ছিল প্রতিবাদের ভাষা কঠোর করার। কিন্তু তা না করে উল্টো হত্যার সংখ্যা কমিয়ে দেখানোর প্রবণতা দুঃখজনক। ফেলানী হত্যার পর ভারত সরকার আশ্বস্ত করেছিল সুষ্ঠু বিচার হবে। কিন্তু বিচার তো দূরের কথা উল্টো দায়মুক্তি প্রতিষ্ঠিত করেছে।

পৃথিবীর যে কোনো দেশের নাগরিক বিনা অনুমতিতে অন্যদেশে প্রবেশ করলে তাকে অনুপ্রবেশ হিসেবে চিহ্নিত করে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু গুলি করে নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করা হয় না। অথচ ভারত সীমান্তে প্রায়ই বাংলাদেশী নাগরিকদেরকে তুচ্ছ ঘটনায় হত্যা করা হচ্ছে। গরু ব্যবসায়ীরা সীমান্তে ঢুকে অপরাধ করলে আইনের আওতায় এনে তাদেরকে শাস্তি দেওয়ার সুযোগ যেখানে অবধারিত সেখানে হত্যা কেন? বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনী বিজিবি ভারতীয় নাগরিকদেরকে সীমান্তে হত্যা করেছে এমন নজির ভারত দেখাতে পারবে না। নিকট অতীতে ১২২ ভারতের নাগরিক অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করতে গিয়ে ধরা পড়েছে তাদের কেউই শারীরিক আঘাতের শিকার হননি। অথচ বাংলাদেশের কোনো নাগরিক যদি অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করে তাহলে তার বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা না নিয়ে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হচ্ছে। পাকিস্তান ও নেপালের সঙ্গেও তো ভারতের সীমান্ত আছে সেখানে তো এসব হচ্ছে না। বাংলাদেশ সীমান্তে হচ্ছে কেন? ভারত দাবি করে তারা বাংলাদেশের বন্ধু ও প্রতিবেশী রাষ্ট্র। কিন্তু সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যা বন্ধ হচ্ছে না। দু-দেশের সীমান্তে নিয়োজিত বাহিনীগুলোর মধ্যে একাধিক পতাকা বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়া সত্তে¡ও হত্যাকান্ড থামেনি। ভারতের প্রয়োজনে তারা আমাদেরকে বন্ধু বানাতে পারে,আবার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে আমাদের ক্ষতি করতে পারে। বিএসএফ এর নিষ্ঠুরতারা থেকে এদেশের মানুষের জীবনকে রক্ষা করার দায়িত্ব সরকারের। নতজানু পরাষ্ট্রনীতি পরিহার করে সীমান্তে হত্যা বন্ধের ব্যাপারে সরকার জোরালো প্রতিবাদ করবে,এমনটিই দেশবাসীর প্রত্যাশা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন