পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বর্তমান বিশ্বে যতগুলো সংঘাতপূর্ণ অঞ্চল রয়েছে তার মধ্যে কাশ্মীর অন্যতম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে কাশ্মীরকে ভূ স্বর্গ বলা হয়ে থাকে। শুধু সৌন্দর্যের কারণে নয় অবস্থানগত কারণেও কাশ্মীর ভারত, পাকিস্তান ও চীনের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে ভারত পাকিস্তান তিনবার যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। বর্তমানে পারমানবিক শক্তিধর তিনটি দেশই কাশ্মীরের বিভিন্ন অংশ শাসন করে আসছে। ভারত শাসন করছে জুম্মু, কাশ্মীর উপত্যকা, লাদাখ ও সিয়াচেন হিমবাহ। পাকিস্তান শাসন করছে আজাদ কাশ্মীর ও গিরগিট বাল্টিস্থান এবং চীন শাসন করছে ডেমচক জেলা, শাকসগাম উপত্যকা ও আকসাই অঞ্চল। সে হিসেবে ভারতের দখলে আছে ৪৩% এলাকা এবং পাকিস্তান ও চীনের দখলে যথাক্রমে ৩৭% ও ২০% এলাকা। কিন্তু তার পরেও এই অঞ্চলকে জুড়ে অস্থিরতা কমে নি ।
কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে রয়েছে এক সুদীর্ঘ ইতিহাস। এত দিন ভারতের একটি সায়ত্বশাসিত অঞ্চল হিসেবে ছিল কাশ্মীর। কিন্তু ৫ আগস্ট ভারতের সংবিধানের ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ রদের মাধ্যমে কাশ্মীরের সায়ত্বশাসনের অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে। জুম্মু কাশ্মীর থেকে আলাদা করা হয়েছে লাদাখকে।
কৌতূহল হওয়া স্বাভাবিক যে কেন কাশ্মীরকে ভারতের সংবিধানের আলাদা অনুচ্ছেদে ঠাঁই দেয়া হয়েছিল আবার ৭০ বছর পর তা কেন রদ করা হল। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট বর্তমান ভারতের সবটুকু অংশ নিয়ে ভারত স্বাধীন হয় নি। ব্রিটিশ সরকার সরাসরি যে অংশটুকু শাসন করত শুধু সে অংশটুকু স্বাধীন হয়েছিল। ভারতের স্বাধীনতার সময় প্রিন্সলি স্টেটগুলোকে প্রস্তাব দেয়া হয়ছিল যে তারা যেন তাদের ইচ্ছামত ভারত বা পাকিস্তানের সাথে যোগ দেয়। ভারতের মানচিত্র ১৯৫১ সাল থেকেই বিভিন্ন স্বশাসিত রাজ্যের অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে বদলাচ্ছে। কাশ্মীর ঐ অঞ্চলগুলোর মধ্যে অন্যতম। ভারতের স্বাধীনতার সময় কাশ্মীরের রাজা হরি সিং স্বাধীন থাকার সিধান্ত নিলেন। কিন্তু কাশ্মীর মুসলিম প্রধান হওয়ায় প্রথম থেকেই পাকিস্তানের দৃষ্টি ছিল কাশ্মীরের উপর। ১৯৪৭ সালের ২২ অক্টোবর পাকিস্তানের পাখতুন উপজাতিরা কাশ্মীরে দখল করার চেষ্টা করে। তাদের সাথে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীও। সংকটের মুখে হরি সিং ভারতের সহযোগিতা নেন এবং সায়ত্বশাসিত একটি অঞ্চল হিসেবে ভারতের সাথে যোগ দেন। ২৬ অক্টোবর ভারতের সেনাবাহিনী শ্রীনগরে গিয়ে পৌঁছালে শুরু হয় ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ। টানা ১৪ মাসের যুদ্ধের পর ভারতীয় বাহিনী কাশ্মীরের দুই তৃতীয়াংশ এলাকা দখল করে নিতে সক্ষম হয়। বাকি অংশটুকু দখল করে নেয় পাকিস্তান যা এখন আজাদ কাশ্মীর নামে পরিচিত। কাশ্মীর ইস্যুতে ভারতকে যুদ্ধ করতে হয়েছে চীনের সাথেও। ১৯৬২ সালে চীন লাদাখের কিছু অংশ দখল করে নেয় আর তার নাম দেয় আকসাই চীন। অবশ্য চীন লাদাখের পুরো অংশটুকুই নিজেদের মনে করে।
১৯৪৭ সালে প্রস্তুত করা হয় ৩৭০ ধারা। প্রথমে এই ধারা ছিল ৩০৬এ আকারে। পরবর্তীতে ১৯৫২ সালের ১৭ নভেম্বর তা ৩৭০ অনুচ্ছেদের পরিচয় লাভ করে। ভারতের সংবিধান প্রণয়নকালে সেখানে ৩৭০ নম্বর ধারাটি যুক্ত হয়। ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী শুধু মাত্র প্রতিরক্ষা, বিদেশ, অর্থ এবং যোগাযোগ ছিল কেন্দ্রের হাতে। বাকি সব ছিল রাজ্যের হাতে। জুম্মু কাশ্মীরে কেন্দ্রের কোন আইন প্রণয়নের ক্ষমতা ছিল না। আইন প্রণয়ন করতে হলে রাজ্যের সম্মতি নিতে হত। সেখানে আলাদা পতাকা, প্রধানমন্ত্রী এবং সংবিধান ছিল। কেন্দ্রের ইচ্ছা মত জুম্ম কাশ্মীরে আর্থিক জরুরী অবস্থা বা সাধারণ জরুরী অবস্থা ঘোষণা করা যেত না। দেশের অন্যন্য স্থানে বিধান সভার মেয়াদ ৫ বছর হলেও সেখানে ছিল ৬ বছর। এর পর ১৯৫৪ সালে সংবিধানে যুক্ত হয় ৩৫এ ধারা। এই ধারা অনুযায়ী জুম্ম কাশ্মীরের অধিবাসীরা কিছু বিশেষ সুযোগ সুবিধা পেত। এই ধারার ফলে কে জুম্ম কাশ্মীরের স্থায়ী বাসিন্দা তা জুম্ম কাশ্মীরের বিধানসভা স্থির করত। ৩৫এ ধারার জন্য স্থায়ী বাসিন্দা ছাড়া কেউ জুম্মু কাশ্মীরে জমি কিনতে পারতেন না, ওই রাজ্যে চাকরির আবেদন করতে পারতেন না, ভোটও দিতে পারতেন না। এমনকি অন্য রাজ্যের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করলে মেয়েদের সম্পত্তি থেকে বঞ্ছিত হতে হত। ৩৭০ ধারা রদের ফলে কাশ্মীরবাসী এ সকল সুবিধা থেকে বঞ্ছিত হবে। ৩৭০ বাতিলের পাশাপাশি জুম্মু কাশ্মীরকে ভেঙ্গে লাদাখকে আলাদা করা হয়েছে এবং জুম্মু কাশ্মীর ও লাদাখে কেন্দ্রের শাসন জারি করা হয়েছে। এর ফলে কাশ্মীরের মর্যাদার অবনমন হল। এখন কাশ্মীরের শাসন ক্ষমতা থাকবে একজন লেফটেন্যান্টের হাতে।
অবশ্য ভারতে যে শুধু কাশ্মীরই একটু ভিন্ন সুবিধা পেয়ে থাকত তা নয়। ভারতের আরও অনেকগুলো রাজ্য এ ধরনের সুবিধা পেয়ে থাকে। যেমন অন্য রাজ্যের কেউ জমি কিনতে পারবে না এই আইন হিমাচল, অরুনাচল, নাগাল্যান্ড এবং আন্দামান নিকোবর দীপপুঞ্জেও আছে। ৩৭১এ ধারা অনুযায়ী নাগাল্যান্ডকে বিশেষ মর্যাদা দেয়া আছে। ৩৬৮ নম্বর অনুচ্ছেদের ভিত্তিতে ৩৭১ নম্বর অনুচ্ছেদে মহারাষ্ট্র ও গুজরাটকে বিশেষ সুবিধা ও অধিকার দেয়া হয়েছে।
এছাড়া আসাম ৩৭১(বি), মনিপুর ৩৭১ (সি), অন্ধপ্রদেশ ও তেলেঙ্গানা ৩৭১ (ডি), সিকিম ৩৭১ (এফ), মিজোরাম ৩৭১ (জি), অরুণাচল ৩৭১ (এইচ) এবং কর্ণাটক ৩৭১ (আই) ধারায় বিশেষ সুবিধা পেয়ে থাকে। এখন জনসাধারণের মনে প্রশ্ন উঠবে যে সরকার ঐ রাজ্যগুলোতেও কি একই ব্যবস্থা নেবে? যদি না নেয় তাহলে কেন শুধু কাশ্মীরের ক্ষেত্রেই ৩৭০ ধারা রদ করা হল?
এর উত্তর হতে পারে কাশ্মীরের জনমিতি বদলে দেয়া। অর্থাৎ মুসলিম প্রধান রাজ্যটিতে হিন্দু ধর্মালম্বীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ করা। সঙ্ঘ পরিবার ২০২৮ সাল নাগাদ ভারতকে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়। আরএসএসের প্রধান মোহন ভাগবত বলেছেন, ‘ভারতীয়দের প্রধান পরিচয় হবে হিন্দুত্ব। অহিন্দু এলাকায় হিন্দুদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা তৈরি করা হবে’। তাই আপাত দৃষ্টিতে এটা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে অহিন্দু এলাকা কাশ্মীরে ভারত সরকার সে প্রচেষ্টাই চালাচ্ছে। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক ডগলাস হারবার্ট বলেছেন, ‘মোদী সরকারের এজেন্ডা হল কাশ্মীরের জনসংখ্যাগত চরিত্র এমনভাবে বদলে দেয়া যা হিন্দুদের পক্ষে যায় এবং ভারতের একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্যকে বদলে দেয়া’।
আসলে কাগজে কলমে কাশ্মীরকে সায়ত্বশাসনের অধিকার দেয়া হলেও আদতে সেই সুবিধা কাশ্মীরবাসী কতটুকু ভোগ করতে পেরেছে সে বিষয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। কারণ গত ৭০ বছরে অন্য যে কোন রাজ্যের থেকে কাশ্মীরে কেন্দ্রের হস্তক্ষেপ হয়েছে সব থেকে বেশি। কেন্দ্রের ইচ্ছা মাফিক সরকার বাতিল করে দেয়ার ঘটনা ঘটেছে বহুবার। কাশ্মীর পৃথিবীর সব থেকে বেশি মিলিটারাইজ জোন বলে পরিচিত। আগে থেকেই সেখানে প্রায় ৬ লক্ষ ভারতীয় সৈন্য ছিল। বর্তমানে সংখ্যাটি ৫০ লাখের বেশি। কাশ্মীরি গ্লোবালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কাশ্মীরে গত ৩ দশকে ৯৫ হাজার ২৩৮ কাশ্মীরিকে হত্যা করেছে ভারতীয় বাহিনী। এই পরিসংখ্যান ১৯৮৯ এর দশক থেকে।
কাশ্মীর প্রশ্নে ভারতের রাজনীতিবিদরা আলাদা আলাদা অবস্থান নিয়েছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেন, ‘৩৭০ ধারা কাশ্মীরকে দেশের অন্য অংশের সাথে এক হতে দেয় নি’। অন্যদিকে রাহুল গান্ধী বলেছেন, ‘ একতরফা জুম্ম কাশ্মীরকে ভেঙ্গে টুকরো করে, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের জেলবন্দি করে, আমাদের সংবিধান লঙ্ঘন করে জাতীয় সংহতি মজবুত করা যায় না। এই দেশটাকে তৈরি করেছে তার জনগণ, জমিজিরেত নয়। সরকারি ক্ষমতার এই অপব্যবহারের ফলে আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে’। ভারতের সাবেক অর্থমন্ত্রী যশবন্ত সিনহা বলেন, ‘ ভারতের অন্যান্য অংশের জনগণ কাশ্মীরের ভাগ্য নির্ধারণ করতে পারে না। এটি খুবই বিতর্কিত একটি পদক্ষেপ। আমি নিশ্চিত কেউ এর বিপক্ষে সুপ্রিম কোর্টে যাবে’। ৩৭০ ধারা বাতিলের ইস্যুতে কাশ্মীরের জনগণকে যেভাবে আলোচনার টেবিলের বাইরে রাখা হয়েছে তা বিতর্কের জন্ম দেবেই। ৩৭০ ধারা রদের ক্ষেত্রে সেখানকার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের পরিবর্তে গভর্নরের কাছ থেকে অনুমোদন নেয়া হয়েছে। আর গভর্নর কেন্দ্রীয় সরকারেরই প্রতিনিধি। অথচ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কোন সাংবিধানিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে তা দীর্ঘ বিতর্ক ও আলোচনা সমালোচনার দাবি রাখে।
৫ আগস্ট রাজ্য সভায় “ জুম্ম কাশ্মীর পুনর্গঠন বিল” পাস হওয়ার পর ৭ আগস্ট লোক সভায়ও বিলটি পাস হয়। সেদিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং বিজেপির সভাপতি অমিত
শাহ কাশ্মীরের পাকিস্তান ও চীন নিয়ন্ত্রিত অংশটুকুও উদ্ধার করার কথা বলেছেন। শিব সেনা নেতা সঞ্জয় রাউত বলেন, ‘ মোদী সরকার বেলুচিস্তান ও পাকিস্তান
অধিকৃত কাশ্মীরকে পুনরায় দাবি করবে’। জাতিসঙ্ঘে চীন পাকিস্তানকে সমর্থন দেবে বলে জানিয়েছে। ভারতের পাশে থাকার আশ্বাস জানিয়েছে আর এক বিশ্ব পরাশক্তি রাশিয়া। তাই স্বভাবতই ভারত যতই কাশ্মীর ইস্যুটাকে তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে দাবি করুক আদতে বিষয়টি তার আভ্যন্তরিন বিষয় তো নয়ই আন্তর্জাতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে।
এদিকে ৩৭০ ধারা বাতিলের পর সরকার সেখানে ১৪৪ ধার জারি করেছে। নিউইয়র্ক টাইমস কাশ্মীরকে বিশ্বের সব থেকে বিপদজনক স্থান হিসেবে অবহিত করেছে। ইতোমধ্যে কিছু কিছু স্থানে কারফিউ ভেঙ্গে সেখানকার জনগণ বিক্ষোভ করেছে।
হিন্দুত্ববাদী সংগঠকরা বলেছেন, সমগ্র ভারতের জন্য থাকবে এক আইন - এক বিধান- এক নিশান। কিন্তু ভারতের মত একটি দেশ যেখানে নানা ধর্মের, নানা বর্ণের, নানা সংস্কৃতির এবং নানা ভাষার লোকের বাস সেখানে এক আইন কতটুকু ফলপ্রসূ হবে তা বিতর্কের দাবি রাখে। গ্রেট ব্রিটেন (ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, ওয়েলস এবং উত্তর আয়ারল্যান্ড) এর ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি সেখানে আইনের ভিন্নতা রয়েছে। তাই ভারতের মত একটি দেশকে এক সুতায় বেঁধে রাখতে হলেও আইনের ভিন্নতার প্রয়োজন আছে। আর এই উপলব্ধি থেকেই ১৯৫৪ সালের ১৪ মে ভারতের প্রেসিডেন্ট রাজেন্দ্র প্রসাদ মনে হয় অধ্যাদেশের মাধ্যমে ৩৫এ ধারার অনুমোদন দিয়েছিলেন। কিন্তু ৭০ বছর আগে কাশ্মীরের বৈশিষ্ট্য ও স্বাতন্ত্র রক্ষা করার যে প্রতিশ্রুতি ভারত সরকার দিয়েছিল সে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের ফলাফল কি দাঁড়ায় তা দেখতে আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
লেখিকা: কৃষিতত্ত¡ বিভাগ, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।