Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

দুর্ঘটনা রোধে চালকদের মানসিক পরিবর্তন আনতে হবে

| প্রকাশের সময় : ১৭ আগস্ট, ২০১৯, ১২:০১ এএম

ঈদযাত্রা এবং ঈদ শেষে মানুষের ফেরার পথ ক্রমেই বিপদসংকুল হয়ে উঠেছে। প্রতি বছরই এ সময়ে সড়ক দুর্ঘটনায় অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয়। এবারের ঈদেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বিষয়টি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, ঈদযাত্রা ও ফেরা মানে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে অনেক মানুষের নিশ্চিত মৃত্যু। এই মৃত্যুর মিছিল কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে নিরাপদ সড়ক চাই-এর দাবীতে গাড়িচালক থেকে শুরু করে জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে গত বছর শিক্ষার্থীরা যে আন্দোলন করেছিল তাতে সরকারের কিছুটা টনক নড়ে বিভিন্ন আইন-কানুনের উদ্যোগ নেয়া হয়। দেখা যাচ্ছে, এসব আইন-কানুন খাতা-কলমেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। বাস্তবে তার প্রয়োগ নেই। চালকদের মধ্যে কোনোরূপ পরিবর্তন আসেনি। আগের মতোই বেপরোয়াভাবে যাত্রী নিয়ে ছুটে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছর ঈদুল আজহার আগে ও পরে পাঁচ দিনে সংড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ছিল ৬৪ জন এবং আহত হয় অসংখ্য। এবারের ঈদেও ছুটির আগে-পরে গত পাঁচ দিনে নিহতের সংখ্যা ৬০-এ গিয়ে পৌঁছেছে। গত বৃহস্পতিবার একদিনেই সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ২৫ জন। এই দুর্ঘটনার বেশির ভাগই ঘটেছে চালকের বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানোর জন্য।

অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, চালকদের উগ্র ও বেপরোয়া মনোভাবের কারণে দুর্ঘটনার কারণটি জানা থাকা সত্তে¡ও এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট পরিবহন সংগঠন কিংবা সরকারের মন্ত্রণালয়ের কার্যকরা কোনো পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। বাংলাদেশে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট (এআরআই)-এর গবেষণা অনুযায়ী, দেশে ৫৩ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে যানবাহনের অতিরিক্ত গতির কারণে। অন্যদিকে ৩৭ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে চালকের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে। বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগের। দুই ক্ষেত্রেই চালকদের বেপরোয়া মনোভাবের বিষয়টি প্রধান হয়ে উঠেছে। অতিরিক্ত গতি এবং বেপরোয়া গতি-এই উভয়ক্ষেত্রেই চালক জড়িত। এই বেপরোয়া চালকদের নিয়েই দেশের যানবাহন চলছে। এর কোনো নিয়ন্ত্রণ বা শোধরানোর কোনো উদ্যোগ নেই। যেসব চালক কিছুটা হলেও সুস্থিরভাবে গাড়ি চালান, দেখা যায় ফাঁকা রাস্তা পেলে তাদের এক্সেলেটর অটোমেটিক্যালি বৃদ্ধি পেয়ে দুরন্ত গতির হয়ে উঠে। তারা গতি নিয়ন্ত্রণে আগ্রহী হয় না। অর্থাৎ গতি এবং বেপরোয়া মনোভাবের ক্ষেত্রে চালকদের আজ পর্যন্ত কোনো বোধশক্তি জাগেনি এবং তাদের মানসিক এই সমস্যা নিরসনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষেরও কোনো উদ্যোগ নেই। এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে যতই নিরাপদ সড়ক চাই-এর কথা বলা হোক না কেন, তা মাঠেই মারা যাবে। কোনো দিনও কার্যকর হবে না। সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম আরেকটি কারণ হচ্ছে সড়ক-মহাসড়কে থ্রি হুইলার জাতীয় নসিমন, করিমন, ভটভটি ও রিকসার চলাচল। এটা ভাবা যায়, মহাসড়কের মতো অত্যন্ত দ্রুত গতির সড়কে এসব ধীরগতির ঠুনকো পরিবহন অবাধে চলাচল করছে! গতকাল দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে অবাধে থ্রি হুইলার ও রিকসা চলাচল করছে। অথচ এসব ধীর গতির যানবাহন মহাসড়কে নিষিদ্ধ করার জন্য উচ্চ আদালতের নির্দেশ রয়েছে এমনকি মন্ত্রণালয় থেকেও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তারপরও এগুলো মহাসড়কে কীভাবে চলছে? সচেতন শ্রেণীমাত্রই বুঝতে পারেন, এক্ষেত্রে সড়ক-মহাসড়কে দায়িত্বপালনরত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের গাফিলতি কিংবা দুর্নীতির কারণেই চলাচল করতে পারছে। তারা যদি কঠোর বা জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করত, তাহলে এসব যানবাহন কোনোভাবেই চলাচল করতে পারত না। এই কয়েক দিন আগে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ কিছু সড়কে সিটি করপোরেশন রিকসা চলাচল বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছিল। দেখা গেছে, দুই দিন বন্ধ থাকার পর সেসব সড়কে একটা-দুইটা করে পুনরায় চলাচল শুরু করেছে। এক্ষেত্র ট্র্যাফিক পুলিশের দায়িত্ব যারা পালন করছে তাদের দায় সবচেয়ে বেশি। তারা যদি নিষিদ্ধের ঘোষণা অক্ষরে অক্ষরে পালন করত, তবে কিছুতেই রিকসা চলাচল করতে পারত না। বরং তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, রিকসা নিষিদ্ধ করায় তাদের আয়ের একটি পথ খুলে গেছে। কিছু অর্থের বিনিময়ে একটি-দুটি রিকসা ছেড়ে দিয়ে সেই আগের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টির পথ তৈরি করে দিয়েছে। মহাসড়কের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। পুলিশ সক্রিয় হলে সড়ক-মহাসড়কে নিষিদ্ধ যান চলবে বা চালাবে, এত বড় বুকের পাটা কারও হওয়ার কথা নয়।

সড়ক-মহাসড়কে দায়িত্বপালনরত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যদি তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে এবং সিদ্ধান্ত নেয় কোনোভাবেই অবৈধ যানবাহন চলাচল ও বাজার বসতে দেয়া যাবে না, তাহলে সড়ক দুর্ঘটনা অনেকাংশে সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসবে। ঈদের ছুটিতে ফুটপাত দখল করে বসা হকার থেকে শুরু করে অনেক রিকসা চালক ঢাকা ছেড়ে গেছে। আমরা মনে করি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এই সুযোগটি কাজে লাগাতে হবে। ফুটপাত দখলমুক্ত রাখতে এবং রিকসা নিয়ন্ত্রণে এখনই সুযোগ। তাদের যাতে আর ফুটপাতে বসতে বা ভিআইপি সড়কে রিকসা নিয়ে বের হতে না দেয়া হয়। এ ব্যাপারে কঠোর মনোভাব প্রদর্শন করতে হবে। একইসঙ্গে সড়ক-মহাসড়কে চালকদের গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে পরিবহন মালিক, সংগঠন এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় যদি নিয়মিত মনিটরিংয়ের পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তবে তাদের মানসিকতার পরিবর্তন আসতে বাধ্য। যাত্রী নিয়ে গাড়ির যাত্রার প্রাক্কালে চালকের মানসিক সুস্থ্যতা পরীক্ষার মাধ্যমে সে সুস্থ্য বা উপযুক্ত কিনা, তা নিশ্চিত করতে পারলে দুর্ঘটনা হ্রাস করা সম্ভব। গাড়ি চালককেও তার বিবেক-বুদ্ধি সক্রিয় রেখে গাড়ি চালাতে হবে। ফাঁকা সড়ক পেলেই গতি বাড়িয়ে দিতে হবে, কিংবা উল্লাসে গাড়ি চালাতে হবে-এ বিষয়টি তাদের মন থেকে মুছে ফেলতে হবে। তাকে এই মনোভাব ধারণ করতে হবে, ধীর-স্থিরভাবে এবং সুষম গতিতে গাড়ি চালিয়েও গন্তব্যে পৌঁছা যায়। এরজন্য অতিরিক্ত গতি বা উদ্বেলিত হওয়ার কিছু নেই। সড়ক-মহাসড়কে দায়িত্বরত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও বুঝতে হবে তার কিছু আর্থিক সুবিধা বা গাফিলতির জন্য অনেক মানুষ ও তাদের পরিবার দুর্ঘটনায় নিহত হয়ে নিঃস্ব হয়ে যেতে পারে। আমরা আশা করব, গাড়ি চালক, তাদের মালিক ও সংগঠনের নেতৃবৃন্দ মানবিক এ বিষয়টি মাথায় রেখে সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে আন্তরিক হয়ে উঠবেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন