Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আত্মত্যাগের বিরল দৃষ্টান্ত কোরবানি

আলহাজ¦ মাওলানা এম. এ. মান্নান (রহ.) | প্রকাশের সময় : ১১ আগস্ট, ২০১৯, ১২:০১ এএম

হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর বংশে চল্লিশ হাজার নবী-রাসূল আগমন করেছিলেন। এর মধ্যে প্রথম হযরত ইসমাইল (আ.) এবং সবার শেষে হযরত মোহাম্মদ (সা.)। আল্লাহ পাক হুকুম করলেন, “হে ইব্রাহীম, নমরূদের নিকট যান এবং ইসলামের দাওয়াত প্রদান করুন।” হযরত ইব্রাহীম (আ.) নমরূদের নিকট গিয়ে ঈমানের দাওয়াত দিলেন। নমরূদ তার কথায় কোন সাড়া না দিয়ে বরং বলল, ‘তোমার আল্লাহর নিকট আমার কোন প্রয়োজন নেই। আমি মনস্থ করেছি তোমার আল্লহর নিকট থেকে আসমানের রাজত্বটাও কেড়ে নেব।’ নমরূদ শকুনের সাহায্যে আকাশে উড়ে তীর ছুঁড়তে লাগল আল্লাহ পাককে খতম করার জন্য। আল্লাহ পাক হযরত জিব্রাইল (আ.) কে বললেন, “আমার এই নাফরমান বান্দার খায়েশ পুরা করে দাও!” হযরত জিব্রাইল (আ.) নমরূদের তীরটি নিয়ে মাছের পিঠে ঢুকিয়ে দিয়ে সেই রক্তমাখা তীরটি নমরূদের সামনে ফেলে দিল। রক্তমাখা তীর দেখে নমরূদ অত্যন্ত খুশি হয়ে বলল, “আমার আশা পূরণ হয়েছে। আমি আজ সফল। আসমানের মালিক আল্লাহকে মেরে ফেলেছি।” (নাউজুবিল্লাহ)

হযরত ইব্রাহীম (আ.) বললেন, “আমার আল্লাহকে কেউ মারতে পারে না। তিনি অমর, তিনি সবার উপরে বিজয়ী। তিনি প্রতাপশালী, তিনি অন্নদাতা, তিনি স্রষ্টা।” নমরূদ বলল, “তোমার আল্লাহর সৈন্যদেরও আমি হত্যা করতে চাই। তুমি তোমার আল্লাহকে বল, তার সৈন্যদের জমায়েত করতে। আমি তাদের নিশ্চিহ্ন করে দেব।” হযরত ইব্রাহীম (আ.) বললেন, “তুমি মহান আল্লাহর সাথে বেআদবী করো না। তিনি তোমার ও আমার সকলের স্রষ্টা। তোমাকে এই রাজত্ব তিনিই দিয়েছেন। তিনি ইচ্ছে করলে আবার তা ছিনিয়েও নিতে পারেন।” নমরূদ জবাবে বলল, “তোমার আল্লাহর নিকট আমার চাওয়ার কিছুই নেই।” এই বলে সে সৈন্য জমায়েত করতে শুরু করল।

মশার কামড়ে ধ্বংস হয় বাহিনীসহ নমরূদ: হযরত ইব্রাহীম (আ.) আল্লাহ পাকের নিকট দোয়া করলেন তার ধ্বংসের জন্য, আল্লাহপাক দোয়া কবুল করলেন। ফেরেশতাদের বললেন, “দুনিয়াতে মশা হল অত্যন্ত তুচ্ছ ও দুর্বল জীব। এগুলোই নমরূদের সৈন্য খতম করার জন্য যথেষ্ট। তাদের ছেড়ে দাও।” মশককুল নমরূদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। মশার কামড়ে সৈন্যরা দিগি¦দিক ছোটাছুটি করতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যে নমরূদের সমস্ত সৈন্য ধরাশায়ী হয়ে পড়ল। এই শোচনীয় পরাজয় দেখে নমরূদ রাজবাড়ীর এক গোপন কক্ষে গিয়ে আশ্রয় নিল। এদিকে এক কানা খোড়া মশা নমরূদের তালাশে গিয়ে তাকে ঐ কক্ষে আবিষ্কার করল এবং নাকের মধ্য দিয়ে ঢুকে মগজে গিয়ে কামড়াতে শুরু করল। মশার কামড়ে অতিষ্ঠ হয়ে একবার জুতা দিয়ে মাথায় আঘাত করতেই দেখা গেল মশা আর কামড়াচ্ছে না। এই দেখে তিনি চাকরকে আদেশ করলেন, তাকে জুতাপেটা করার জন্য। চাকর তার মাথায় বিরামহীনভাবে জুতাপেটা করতে থাকল। এভাবে চল্লিশ দিন চলে গেল। একদিন চাকর অতিষ্ঠ হয়ে একটি ডান্ডা দিয়ে এমন আঘাত করল তার মাথায়, যার ফলে তার মাথা ফেটে মগজ বেরিয়ে গেল। নমরূদ চিরদিনের মত জাহান্নামে চলে গেল।

হযরত ইসমাইল (আ.) এর জন্ম ও হযরত হাজেরা (রা.) এর মরুপ্রান্তরে নির্বাসন: নমরূদের মৃত্যুর পর লোকজন হযরত ইব্রাহীম (আ.) এর নিকট এসে বলল, “হযরত, নমরূদ তো শেষ হয়ে গেছে। এখন আপনি এই দেশের বাদশাহী গ্রহণ করুন। হযরত ইব্রাহীম (আ.) অস্বীকার করলেন এবং বাইতুল মুকাদ্দাসের দিকে রওয়ানা হয়ে গেলেন। অনেক দিন পরে বিবি সায়রা (রা.) ও বিবি হাজেরা (রা.) হযরতকে পেয়ে অত্যন্ত আনন্দিত হলেন।

কিছুদিন পর হযরত হাজেরা (রা.) একটি পুত্র সন্তান প্রসব করলেন। নাম রাখা হল ‘হযরত ইসমাইল।’ হযরত হাজেরা (রা.) এর সন্তান দেখে হযরত সায়রা (রা.) এর মনে ঈর্ষা জন্ম নিল। তিনি হযরত ইব্রাহীম (আ.) কে বললেন, “তুমি তাকে নির্বাসনে দিয়ে এসো, নয়ত আমি চলে যাবো।” এ কথা শুনে হযরত ইব্রাহীম (আ.) অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়লেন। এমন সময় হযরত জিব্রাইল (আ.) এসে বললেন, “বিবি সায়রা যা বলছেন আপনি তাই করুন।”

হযরত ইব্রাহীম (আ.) আর কি করবেন। আল্লাহ পাকের হুকুম মাথা পেতে নিয়ে একটি উটে বিবি হাজেরা (রা.) এবং শিশু সন্তানকে চড়িয়ে অন্য একটি উটে নিজে চড়ে বাইতুল মুকাদ্দাস ত্যাগ করে অজানা উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেলেন। হযরত জিব্রাইল (আ.) পথ দেখিয়ে চললেন, বহু পথ অতিক্রম করে ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে হযরত জিব্রাইল (আ.) এর হুকুমে এক স্থানে এসে তশরিফ রাখলেন। জায়গাটি এমনি মরুময় ছিল যে, সেখানে গাছপালা, তৃণলতা বলতে কিছুই ছিল না। চারদিকে পাহাড় আর পাহাড়। পানি নেই, খাদ্য নেই, লোকজন নেই, আছে শুধু পাথর আর বালি। আল্লাহপাক হুকুম করলেন, “ইব্রাহীম, তুমি তোমার স্ত্রী-পুত্রকে রেখে চলে যাও।” কত বড় পরীক্ষা কল্পনা করতে পারেন? জনমানবহীন, মরুপ্রান্তরে একমাত্র আপন পুত্র ও স্ত্রীকে রেখে চলে যেতে হবে। হুকুম পেয়ে এক মশক পানি আর কিছু খেজুর তাদের দিয়ে নির্দ্বিধায় ফিরে চললেন সিরিয়ার দিকে। হযরত হাজেরা (রা.) ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আমাদেরকে এখানে একাকী রেখে কোথায় যাচ্ছেন?” কোন উত্তর নেই। পরে জিজ্ঞাসা করলেন, “আল্লাহ পাকের হুকুমেই কি আমাদের এখানে ফেলে চলে যাচ্ছেন?” হযরত বললেন, “হ্যাঁ”, তখন তিনি আর কিছ্ইু বললেন না। এই সেই জায়গা, যেখানে এখন আল্লাহর ঘর কাবা অবস্থিত।

কঠিন পরীক্ষা: প্রাণাধিক প্রিয়পুত্র ও প্রিয়তমা স্ত্রীকে জনমানবহীন শুষ্ক মরুভ‚মিতে ফেলে চলে যাওয়াকে কোন বিবেকবান মানুষ কি সমর্থন করতে পারে? পারে না। হযরত ইব্রাহীম (আ.) এর পক্ষেও সম্ভব ছিল না। যদি এটি আল্লাহ পাকের নির্দেশ না হতো। কারণ হযরত ইসমাইল (আ.) ছিলেন হযরত ইব্রাহীম (আ.) এর বৃদ্ধ বয়সের একমাত্র সন্তান। সঙ্গত কারণেই তার প্রতি স্নেহ-মমতার আধিক্য ছিল অত্যন্ত বেশি। আর তাকে এই মনুষ্যবিহীন মরুময় প্রন্তর, যেখানে নেই কোন থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা, সেখানে ফেলে যেতে হবে। কত কঠিন পরীক্ষা। হযরত ইব্রাহীম (আ.) নবী না হলে এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া কোন মতেই সম্ভব ছিল না। আল্লাহ পাকের উপর অগাধ বিশ্বাস ও অতুলনীয় ঈমানী শক্তির অধিকারী বলেই এটি সম্ভব হয়েছে। যাবার বেলায় শুধু দু’হাত তুলে আল্লাহ পাকের মহান দরবারে আকুতি-মিনতিসহ বলতে লাগলেন,

“হে আমাদের পালনকর্তা! আমি নিজের এক সন্তানকে তোমার পবিত্র গৃহের সন্নিকটে চাষাবাদহীন উপত্যকায় আবাদ করেছি। হে প্রভু! যাতে তারা নামাজ কায়েম রাখে। অতঃপর আপনি কিছু লোকের অন্তরকে তাদের প্রতি আকৃষ্ট করে দিন এবং তাদের ফলাদি দিয়ে রিজিক দান করুন। সম্ভবত তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে।” (সূরা: ইব্রাহীম, আয়াত: ৩৭)

‘জমজম’ আল্লাহর দান: হযরত ইব্রাহীম (আ.) তো চলে গেলেন, সম্পূর্ণ আল্লাহ পাকের উপর তাওয়াক্কুল করে। হযরত হাজেরা (রা.) শিশু সন্তানকে বুকে নিয়ে বসে আছে। নিজের নিকট যে খেজুর ও পানি ছিল তাই খেতে লাগলেন। অবশেষে পানি গেল ফুরিয়ে। প্রচন্ড গরমে তপ্ত বালির উপর বসে থেকে পানির পিপাসায় গলা শুকিয়ে গেছে। শিশুপুত্র হযরত ইসমাইল (আ.) পিপাসায় ছটফট করছেন। পিপাসায় অস্থির হয়ে ছেলেকে তপ্ত বালিতে রেখে মা হযরত হাজেরা (রা.) এদিক-সেদিক ছুটাছুটি করতে লাগলেন। কোথাও পানি না পেয়ে সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে দৌড়াদৌড়ি করছেন আর ছেলের দিকে তাকিয়ে দেখছেন। হঠাৎ একবার দেখেন শিশু পুত্রের পায়ের দিক থেকে পানি গড়িয়ে যাচ্ছে। পানি দেখে তিনি নিচে নেমে আসলেন এবং বললেন; “আলহামদুলিল্লাহ”। তিনি প্রথমেই নিজ পুত্রকে ভালো করে পানি পান করিয়ে নিলেন এবং নিজেও পান করলেন। তারপর পাথর ও বালি দিয়ে পানিকে আটকিয়ে দিলেন। সেই পানিই হল “জমজম”, যা আজও সমভাবে বয়ে চলেছে। হজ্জ্বের সময় সারা বিশ্বের মুসলমানগণ এ পানি পান করে ধন্য হচ্ছেন এবং নিজ নিজ দেশে নিয়ে যাচ্ছেন। পানির খোঁজে হযরত হাজেরা (রা.) সাফা মারওয়া পাহাড়দ্বয়ে যেভাবে দৌড়াদৌড়ি করেছিলেন আল্লাহ পাক সে কাজটি পছন্দ করে দুনিয়ার সকল হজ্জ্বযাত্রীর জন্য ওয়াজিব করে দিলেন।
বিবি হাজেরার নিকট পানির খোঁজে একটি আরব কাফেলা: একদিন এক মরু কাফেলা পানি খোঁজ করতে করতে সাফা পাহাড়ে এসে উপস্থিত। নিচের দিকে তাকিয়ে দেখে এক মহিলা একটি শিশু বুকে নিয়ে বসে আছে। তার পাশে একটি পানির ফোয়ারা। কাফেলার লোকেরা এর পূর্বেও এ স্থানে কোন মানুষ বা পানির ফোয়ারা দেখেনি। তারা আশ্চার্যান্বিত হয়ে নেমে আসল নিচে। হযরত হাজেরা (রা.) এর নিকট গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “আপনি কে? এখানে কেন বসে আছেন? আর এই পানিই বা এলো কী করে?” হযরত হাজেরা (রা.) সমস্ত বৃত্তান্ত বর্ণনা করলেন। তখন তারা বলল, “আপনি অনুমতি দিলে আমরা এখানে বসবাস করতে পারি। আর পানির বদলে আপনার সমস্ত প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আমরা সরবরাহ করব। আপনাকে আর কোন পরিশ্রম করতে হবে না। আমরা আপনার খাদেম হয়ে এখানে বসবাস করব। হযরত হাজেরা (রা.) তাদেরকে অনুমতি দিলেন। ফলে এখানে তারা এসে তাঁবু ফেলল। আল্লাহ পাকের উপর তাওয়াক্কুল করার ফলে আল্লাহ পাক কী সুন্দরভাবে তাদের ভরণ-পোষণের সুব্যবস্থা করে দিলেন। এই ছোট্ট মরু রাজ্যের সম্রাজ্ঞী হিসেবে পরম সুখে জীবন অতিবাহিত করতে লাগলেন, হযরত বিবি হাজেরা (রা.) এবং শিশু পুত্র হযরত ইসমাইল (আ.)। দেখতে দেখতে হযরত ইসমাইল (আ.) বড় হতে লাগলেন।

পর পর তিন দিন হযরত ইব্রাহীম (আ.) একই স্বপ্ন দেখেন: হযরত ইব্রাহীম (আ.) মাঝে-মধ্যে হযরত বিনি হাজেরা (রা.) এবং পুত্র হযরত ইসমাইল (আ.) এর খোঁজ খবর নিতে আসেন। এরই মধ্যে আল্লাহ পাক স্বপ্নের মাধ্যমে এমন এক নির্দেশ দিলেন যা পালন করা একজন নবী ব্যতীত অন্যের পক্ষে অসম্ভব। আল্লাহ পাক বলেন, “অতঃপর যখন পুত্র পিতার সাথে চলাফেরা করার মত বয়সে উপনীত হল, তখন হযরত ইব্রাহীম (আ.) বললেন, ‘বৎস আমি স্বপ্নে দেখেছি যে আমি তোমাকে জবেহ করছি। এখন তোমার অভিমত কী?’ পুত্র বলল, ‘পিতা, আপনাকে যে আদেশ করা হয়েছে, আপনি তাই করুন। আল্লাহ চাহেতো আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন’।” (সূরা: ছাফফাত, আয়াত: ১০২)

কুরতবী উল্লেখ করেছে যে, এই স্বপ্নটি পরপর তিনদিন দেখানো হয়েছিল। নবীদের স্বপ্নও অহীর মধ্যে গণ্য। এর অর্থ ছিল, একমাত্র পুত্রকে জবেহ করে ধৈর্য ও সহনশীলতার পূর্ণ পরাকাষ্ঠ প্রদর্শন করা। উপরোক্ত আদেশটি ফেরেশতার মাধ্যমে সরাসরি না পাঠিয়ে স্বপ্নের মাধ্যমে পাঠানোর আর একটি পরীক্ষা এই যে, মানুষ স্বপ্নের তাবির ভিন্নভাবে করে থাকে। একজন নবী হয়ে হযরত ইব্রাহীম (আ.) কি তাবির করবেন তা দেখা। কারণ, স্বপ্নের মধ্যে পুত্রকে জবেহ করার কথা ছিল না। নিজের প্রিয়তম বস্তু কোরবানি করার কথা ছিল। হযরত ইব্রাহীম (আ.) এর নিকট সবচেয়ে প্রিয়তম বস্তু ছিল হযরত ইসমাইল (আ.)। অর্থাৎ তার অনেক কামনা, বাসনা ও দোয়া প্রার্থনার পর পাওয়া প্রাণ প্রতিম পুত্র। আর তখন তার বয়স হয়েছিল ১৩ বছর। কেউ কেউ বলেন, তিনি তখন সাবালক ছিলেন। হযরত ইব্রাহীম (আ.) পুত্রেরও পরীক্ষা নিয়ে নিলেন এই বলে যে, “বল তোমার অভিমত কী?” নবীগণের চিরন্তন কর্মপদ্ধতি এই যে, তারা সদাসর্বদা আল্লাহর আদেশ পালনে প্রস্তুত থাকেন। কিন্তু আনুগত্যের জন্য সর্বদা উপযোগী ও যতটা সম্ভব সহজ পথ অবলম্বন করে থাকেন। হযরত ইব্রাহীম (আ.) নিজ পুত্রকে পূর্বাহ্নে অবগত না করালে হয়তো কাজটি কঠিন হয়ে যেতে পারত। পূর্বাহ্নে জানিয়ে দেয়ার অর্থ হল, ছেলে যেন চিন্তা ভাবনা করে প্রুস্তুতি নিতে পারেন। হযরত ইব্রাহীম (আ.) হযরত হাজেরা (রা.) এর নিকট গিয়ে বললেন, “তোমার ছেলেকে ভালো করে গোছল করিয়ে, চুল আঁচড়ে, সুগন্ধি ও সুরমা লাগিয়ে দাও।” হযরত হাজেরা (রা.) পুত্রকে সুন্দর করে সাজিয়ে দিলেন।

পুন পুন শয়তানের ধোকা ও তাকে পাথর নিক্ষেপের আদেশ: হযরত ইব্রাহীম (আ.) এবং তাঁর পুত্র হযরত ইসমাইল (আ.) চলছেন মিনার দিকে। শয়তান পথিমধ্যে এসে হযরত ইসমাইল (আ.) কে বলতে লাগল, “কোথায় চলেছ? তিনি তো তোমাকে জবেহ করার জন্য নিয়ে যাচ্ছেন।” হযরত ইসমাইল (আ.) এই কথা শুনে পিতাকে বললেন। উত্তরে পিতা বললেন, “এই হল শয়তান, তুমি তাকে পাথর মার।” এইভাবে তিন-তিনবার শয়তান ধোকা দিতে চেষ্টা করেছে। তিন বারই হযরত ইসমাইল (আ.) শয়তানকে পাথর মেরে তাড়িয়ে দিয়েছেন। একাজটিও আল্লাহ পাকের নিকট অত্যন্ত পছন্দ হয়েছে। যার ফলে এই তিন স্থানে পাথর নিক্ষেপ করা প্রতিটি হজ্জ্ব যাত্রী, নর-নারীর প্রতি ওয়াজিব করে দিয়েছেন।
আত্মত্যাগের বিরল দৃষ্টান্ত: অতঃপর পিতা-পুত্র এক অভিনব ইবাদত উদযাপন করার জন্য নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে উপস্থিত হলেন। তখন হযরত ইসমাইল (আ.) বললেন, “পিতা আমাকে শক্ত করে বেঁধে নিন। যাতে আমি ছটফট করতে না পারি। আপনার পরিধেয় কাপড়গুলো সামলে নিন যাতে আমার রক্তের ছিটা না লাগে। আপনার কাপড়ে আমার রক্ত দেখলে আমার মা ধৈর্যহারা হয়ে যেতে পারেন। আপনার ছুরিটা ভালো করে ধার করে নিন। যাতে আমার গলা কাটতে সহজ হয় এবং আমার প্রাণ সহজে বের হয়ে যায়। কারণ, মৃত্যু বড়ই কঠিন ব্যাপার। আপনি আমার মায়ের নিকট গিয়ে আমার ছালাম পৌঁছে দেবেন। আমার জামাগুলো আমার মাকে দেবেন, তাতে করে তিনি কিছুটা সান্ত¡না পেতে পারেন।” একমাত্র পুত্রের মুখে এসব কথা শুনে পিতার মানসিক অবস্থা কী হতে পারে সহজেই অনুমেয়। কিন্তু হযরত ইব্রাহীম (আ.) দৃঢ়তায় অটল পাহাড় হয়ে জবাব দিলেন, “বৎস আল্লাহ পাকের আদেশ পালন করার জন্য তুমি আমার চমৎকার সহায়ক হয়েছ।” অতঃপর তিনি পুত্রকে চুম্বন করলেন এবং অশ্রুপূর্ণ নেত্রে বেঁধে নিলেন। এরপর তাকে এমনভাবে শুইয়ে দিলেন যাতে কপালের একদিক মাটি স্পর্শ করছিল। এরপর ছুরি চালিয়ে দিলেন। কিন্তু গলা কাটছিল না। বারবার ছুরি চালালেন। ছুরির ধার পরীক্ষা করে দেখলেন, কোন ত্রুটি নেই। কিন্তু গলা কাটছে না। এক পর্যায়ে হযরত ইব্রাহীম (আ.) রাগ করে ছুরি ফেলে দিলেন। তখন ছুরি আল্লাহর কুদরতে বলে উঠল, “হযরত রাগ করছেন কেন? আমিতো কাটতে পারছি না। কারণ আল্লাহ পাক আপনাকে আদেশ দিয়েছেন জবাই করার জন্য। আর আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন না কাটতে।” অন্য রাওয়ায়েতে আছে, আল্লাহ পাক সেই গলার উপর একটি কুদরতি তামার পাত রেখে দিয়েছিলেন।

পিতার প্রতি পুত্রের পরামর্শ: হযরত ইসমাইল (আ.) বললেন, “বাবা, আপনি শক্ত করে ছুরি চালাতে পারছেন না। কারণ, আমার মুখ দেখে আপনি নিস্তেজ হয়ে যান। আপনি বরং আমাকে উপুড় করে শুইয়ে দিন। যাতে আপনি আমার মুখ দেখতে না পান এবং আপনার চোখ দুটো ভালো করে বেঁধে নিন। কারণ আমার মুখ দেখলে, আপনার মাঝে পিতৃ ম্নেহ উথলে উঠবে।” পুত্রের কথামত তিনি ছুরি চালিয়ে দিলেন।
গায়েবী আওয়াজ/ছুরির নিচে দুম্বা: হযরত ইব্রাহীম (আ.) যখন তাঁর পুত্র হযরত ইসমাইল (আ.) এর গলায় ছুরি চালিয়ে দিলেন তখন গায়েব থেকে আওয়াজ আসতে লাগল- “আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার অলিল্লাহিল হামদ।” জবেহ হয়ে গেল, চোখ খুলে দেখেন, ছুরির নিচে একটি দুম্বা জবেহ হয়ে আছে। আর হযরত ইসমাঈল (আ.) নিকটে দাঁড়িয়ে হাসছেন। আল্লাহ পাক বলেন, “আমি তাকে ডেকে বললাম, হে ইব্রাহীম তুমি স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখিয়েছ।” অর্থাৎ আল্লাহর আদেশ পালনে তোমার যা করণীয় ছিল তাতে তুমি কোন ত্রুটি করনি। আল্লাহ বলেন, “আমি আমার বান্দাদের এভাবেই প্রতিদান দিয়ে থাকি।”

হযরত ইব্রাহীম (আ.) এর সেই কোরবানিকে আল্লাহ পাক অমর করে রেখেছেন। প্রতিটি হাজীকে আরাফাত থেকে মুজদালিফা হয়ে মিনায় এসে কোরবানি করতে হয়। এই কোরবানি ওয়াজিব। কোরবানি না করা পর্যন্ত ইহরাম খোলা যাবে না। হজ্জ্ব ছাড়াও সাহেবে নেছাব নর-নারীকে জিলহজ্জ্ব মাসের ১০ তারিখে কোরবানি করতে হয়।

[আলহাজ¦ মাওলানা এম. এ. মান্নান (রহ:) এর রচনাবলী হতে সংগৃহীত]



 

Show all comments
  • মোঃ মুসা মিয়া ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ১:৩৩ এএম says : 0
    মাশাআল্লাহ,খুব ভালো লেগেছে লেখাটি।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন