মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় দেউলিয়া হলো যুক্তরাষ্ট্রের ২য় বৃহত্তম ব্যাংক
চলতি সপ্তাহের বুধবারও আর দশটি সাধারণ ব্যাংকের মতো বাণিজ্যিক ও আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক (এসভিপি), যা দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক ব্যাংক
ম্যালেরিয়া রোগ আনার মাধ্যমে মশা মানব ইতিহাসের গতিপথ পাল্টে দিয়েছে। মশার হাত থেকে শুধু সাধারণ মানুষ নয়- সৈন্যবাহিনীও রক্ষা পায়নি। যেমন এই ম্যালেরিয়াই থামিয়ে দিয়েছিল চেঙ্গিস খানের পশ্চিমমুখী লুন্ঠন। একটি নতুন বইতে এ কথা বলা হয়েছে।
আমরা যদি যুক্তিবাদী হই, তাহলে সাগর সৈকতে হাঙরের হামলায় মৃত্যুভীতির চেয়েও আমাদের পিছন দিকের হামলা অর্থাৎ মশার হামলাকে বেশি ভয় করতে হবে। যদিও মহাসাগরগুলোতে সাদা হাঙরের মত বাস্তব জীবনের দৈত্য রয়েছে। কিন্তু আমাদের বাড়ির আঙিনা ও পার্কগুলো মানব জীবনের প্রাণঘাতী শত্রু মশককুলের আবাসে পরিণত হয়েছে।
ইতিহাসের অধ্যাপক টিমোথি সি.ওয়াইনগার্ড গত মঙ্গলবার প্রকাশিত তার নতুন বই ‘দি মসকুইটো : এ হিউম্যান হিস্টরি অব আওয়ার ডেডলিয়েস্ট প্রিডেটর’-এ এই উড়ন্ত পতঙ্গকে ‘মানব বিনাশকারী,’ ‘ভয়ঙ্কর মৃত্যুদূত’, ‘বিশে^র মারাত্মক প্রাণ সংহারক’ বলে বর্ণনা করেছেন।
মশার কামড়ে নিহতদের সংখ্যাই তাদের স্বরূপকে প্রকাশ করে। ওয়াইনগার্ড বলেন, মানব ইতিহাসে অন্য যে কোনো ঘটনার চেয়ে মশা সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ হত্যা করেছে। পরিসংখ্যানগত তথ্যে দেখা যায় যে এ পর্যন্ত বিশ্বে যত লোকের মৃত্যু হয়েছে তার অর্ধেকেরই হয়েছে মশার দ্বারা। অন্য কথায়, বিশ্বের দুই লাখ বছরের ইতিহাসে মশা প্রায় ৫২ বিলিয়ন মানুষকে হত্যা করেছে।
গত বছর মশা সাড়ে ৮ লাখ মানুষ মেরেছে। তবে বার্ষিক গড় মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ। পক্ষান্তরে হাঙরের হামলায় নিহতের সংখ্যা মাত্র ১০ জন। এ মুহূর্তে বিশ্বে ১১০ ট্রিলিয়ন মশা ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে (মাত্র কয়েকটি স্থান মশার শুঁড়ের আওতা বহির্ভূত : যেমন অ্যান্টার্কটিকা, সিচেলিস ও কয়েকটি ফরাসি পলিনেশীয় দ্বীপ)। এই পতঙ্গগুলো ১৫টি ভয়ঙ্কর রোগ লালন করে। সবচেয়ে ভয়াবহ দুটি রোগ হচ্ছে ম্যালেরিয়ার ‘বিষাক্ত যমজ’ ও হলুদ জ¦র। তবে মশা অন্যান্য মারাত্মক ভাইরাসও ছড়ায়- যেমন ওয়েস্ট নাইল ও জিকার ওয়ার্ম ও প্যারাসাইট। এদিকে মশার এক বড় ঝাঁক মাত্র দুই ঘণ্টার মধ্যে পূর্ণ বয়স্ক মানুষের শরীর থেকে অর্ধেক রক্ত টেনে নিতে পারে। মনে হয়, এখন ডিসকভারি চ্যানেলের ‘শার্ক সপ্তাহ’র বদলে এর নাম ‘মশা সপ্তাহ’ করার সময় এসেছে।
আজ থেকে ১৯ কোটি বছর আগে মশার উদ্ভব ঘটে। এখনকার মত সেকালেও মশা গণবিধ্বংসী অস্ত্র বহন করত। তারা ডায়নোসরদের নির্মূল করে। মশা ম্যালেরিয়া ও কৃমিসহ মারাত্মক রোগ সূচিত করে (আজকের দিনের কুকুরের হার্টওয়ার্মের মত), এমনকি অত্যন্ত পরাক্রমশালী জন্তুও মশার আক্রমণ থেকে বাঁচতে পারে না।
পতঙ্গ বিজ্ঞানী জর্জ ও রবার্টা পয়নার ‘কী যা ডায়নোসরদের নির্মূল করল?’ শীর্ষক গবেষণাপত্রে লিখেছেন যে খাদ্য শৃঙ্খলে মশা ছিল শীর্ষ শিকারী এবং তারাই ডায়নোসরদের ভবিষ্যত নির্ধারণ করে যেমন করছে আজকের পৃথিবীকে।
ওয়াইনগার্ড বলেন, মশারা ডায়নোসরদের নির্মূল করার পর শুধু টিকেই থাকেনি, বরং আরো শক্তিশালী হয়েছে। তিনি বলেন, মশা মানব সভ্যতার অগ্রগতির পথে এক বাধা। ইতিহাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু মুহূর্তে অদৃশ্য খেলোয়াড়ের মত হানা দিয়েছে।
মশা আলেকজান্ডার দি গ্রেটের পতন ঘটাতে সাহায্য করেছিল। ওয়াইনগার্ড বলেন, আলেকজান্ডার ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন যা পূর্ব ও পশ্চিমকে একত্রিত করতে সক্ষম হওয়ার আগেই তার প্রাণ কেড়ে নেয়। এই ম্যালেরিয়াবাহী মশা তার জীবনাবসান না ঘটালে সকল ইঙ্গিত এটাই নির্দেশ করে যে তিনি দূরপ্রাচ্য অভিমুখে অগ্রসর হচ্ছিলেন। এটা ঘটলে ইতিহাস ও মানব সভ্যতার গতিপথ এমন এক পর্যায়ে পৌঁছত যেখানে আধুনিক সমাজ আক্ষরিক ভাবেই অ-সনাক্তযোগ্য হত।
চেঙ্গিস খান ও তার মঙ্গোল সেনাবাহিনীর অগ্রাভিযান বন্ধে ম্যালেরিয়া এক গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে। ওয়াইনগার্ড বলেন, ম্যালেরিয়া পাশ্চাত্যকে মঙ্গোল বাহিনীর হাতে সম্পূর্ণ পরাজিত হওয়া থেকে রক্ষা করে। ম্যালেরিয়া তার শক্তির ব্যাপক প্রয়োগ ঘটায় এবং মঙ্গোলদের বিজয় থামিয়ে দিয়ে তাদের ইউরোপ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে।
আমেরিকার বিপ্লব ও গৃহযুদ্ধেও মশার ভ‚মিকা ছিল। ম্যালেরিয়া ওয়াশিংটনের সেনাবাহিনীকে ব্রিটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে সুবিধাজনক অবস্থানে নিয়ে আসে। কারণ, আমেরিকানরা ম্যালেরিয়ার প্রতিষেধক নিলেও বেশির ভাগ ব্রিটিশ সৈন্য ম্যালেরিয়ার প্রতিষেধক গ্রহণের বাইরে ছিল। অর্থাৎ তারা ম্যালেরিয়ার আক্রমণ মুক্ত ছিল না। অন্যদিকে মশা-নিরোধক কুইনাইন ক্যারিবিয়াান ও ভারতীয় ব্রিটিশ সৈন্যদের জন্য প্রচুর পরিমাণে পাঠানো হলেও আমেরিকায় তা পাঠানো হয়নি। ফলে তা আমেরিকানদের জন্য বিরাট সুবিধা বয়ে আনে।
আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সময় যুদ্ধে যত ব্রিটিশ সৈন্য মারা যায় তার পাঁচগুণ মারা যায় ম্যালেরিয়ায়। দেশের দক্ষিণে কয়েকটি অঞ্চলে ম্যালেরিয়ার ব্যাপক বিস্তার ঘটেছিল। এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান ম্যালেরিয়া বিশেষজ্ঞরা মিত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে জীবাণু যুদ্ধে ব্যবহারের জন্য ইটালিতে নাজি সৈন্যদের পরিখা খনন ও জলাভূমিগুলো নোনা পানিতে ভরে তুলতে বাধ্য করে। যাতে সেসব স্থানে মারাত্মক প্রজাতির এনোফিলিস ল্যাবরানসিয়া মশার বিস্তার ঘটানো যায়।
ওয়াইনগার্ড আরো বলেন, মশা সাম্রাজ্যের উত্থান ও পতনও ঘটিয়েছে। বহু স্মরণীয় ও প্রধান যুদ্ধে মশা ভ‚মিকা পালন করেছে। ম্যালেরিয়ায় অসংখ্য সৈন্য হত্যা করে প্রসিদ্ধ জেনারেল ও সামরিক পরিকল্পকদের ব্যর্থতার গ্লানিতে জর্জরিত করেছে। এমনকি আজকের দিনেও মশা প্রতিরোধের নানা পন্থা থাকা সত্তে¡ও (যার মধ্যে আছে ডিডিটি যা পরিবেশের ক্ষতি সাধনের জন্য কুখ্যাত) আমরা মশার সাথে লড়াই করছি। মশার হাত থেকে মানুষকে রক্ষার জন্য বিশ্বে প্রতি বছর ব্যয় হচ্ছে ১১ বিলিয়ন ডলার যার অধিকাংশই কাজে আসছে না। তাই মশা আমাদের হত্যা করা অব্যাহত রেখেছে।
১৯৩০-এর দশকে হলুদ জ্বর বা ইয়েলো ফিভার প্রতিরোধে সফল ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হয়। এখনো প্রতি বছর ৩০ হাজার লোক ইয়েলো ফিভারে মারা যায়। জিকা ভাইরাস, যাতে গর্ভবতী মা আক্রান্ত হলে তা মাইক্রোসেফালির (শিশুর ত্রুটিপূর্ণ মাথা) মত জন্মত্রুটির কারণ হতে পারে। ২০১৬ সালে আমেরিকায় জিকা বিস্তার লাভ করলে রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (সিডিসি) বিশ্বব্যাপী জরুরি অবস্থা জারি করে। জিকার প্রাদুর্ভাবের চরম পর্যায়ে আমেরিকায় পাঁচ হাজার ১৬৮ জন রোগী সনাক্ত করা হয় (ব্রাজিলে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল দুই লাখ)। ভ্রমণ হুঁশিয়ারি, মশা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করায় ধন্যবাদ। সিডিসি জানায়, ২০১৮ সাল থেকে আমেরিকায় আর জিকা রোগীর সন্ধান পাওয়া যায়নি।
কিন্তু ম্যালেরিয়া মানব সমাজের জন্য এখনো ভীতিকর রোগ। এর কারণে আফ্রিকায় বাণিজ্যিক ক্ষতির পরিমাণ ৩০ থেকে ৪০ বিলিয়ন ডলার। ওয়াইনগার্ড বলেন, মশা নিয়ন্ত্রণহীন মানব জন্মহারের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করে। তিনি মনে করেন, মশাজনিত মৃত্যু বাড়তেই থাকবে। আধুনিক বিজ্ঞান ও ওষুধ সত্তে¡ও মশা মানব সমাজের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর পতঙ্গ হিসেবে থাকবে।
বিশ্বে নানা কারণে মানুষের মৃত্যু ঘটে থাকে। এর মধ্যে মশার কারণে মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। একটি পরিসংখ্যানে প্রতি বছর বিশ্বে মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা দেখানো হয়েছে। এতে বলা হয় : প্রতি বছর মশার কারণে ২০ লাখ, মানুষের হাতে পৌনে পাঁচ লাখ, সাপের কামড়ে ৫০ হাজার, স্যান্ড ফ্লাই-এর কামড়ে ২৫ হাজার, সেৎসি মাছির কামড়ে ১০ হাজার, কুমিরের আক্রমণে এক হাজার, জলহস্তির আক্রমণে ৫০০, হাতির আক্রমণে ১০০, সিংহের আক্রমণে ১০০, হাঙরের আক্রমণে ১০ ও নেকড়ের আক্রমণে ১০ জন মারা যায়।
কিছু লোক মশার খুব পছন্দ। যেমন ১. গর্ভবতী মহিলা। তাদের শরীরের তাপমাত্রা একটু বেশি থাকে ও শ্বাস-প্রশ্বাসে ২০ শতাংশ বেশি কার্বণ গ্রহণ ও ত্যাগ করে বলে অন্যদের তুলনায় মশা তাদের দ্বিগুণ কামড়ায়। ২. যেসব লোকের বেশি পরিমাণ ল্যাকটিক এসিড, ইউরিক এসিড ও অ্যামোনিয়া আছে তারা মশার কাছে বেশি আকর্ষণীয়। ৩. ‘ও’ গ্রæপের রক্তের লোকজনকে মশা পছন্দ করে। তাদের মশা দ্বিগুণ বেশি কামড়ায়। ৪. নোংরা ও দুর্গন্ধময় পা মশাকে বিপুল ভাবে আকর্ষণ করে। এ ধরনের লোককে বাঁচতে চাইলে পা পরিষ্কার রাখতে হবে। ৫. দুর্ভাগ্যক্রমে বেশি পরিষ্কার থাকলেও ঝুঁকি আছে। মশারা দুর্গন্ধনাশক, সুন্ধি, সাবান ও অন্যান্য সুগন্ধের ঘ্রাণ ভালোবাসে। ৬. গবেষণায় আরো দেখা গেছে মশারা বিয়ার পানকারীদের পছন্দ করে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।