Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

থেরেসা মে’র বিদায়ে সমস্যা মিটবে কি?

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ২৮ জুলাই, ২০১৯, ১২:০০ এএম

‘ব্রেক্সিট’ এখনও বিশ বাঁও জলে। ‘ট্রেক্সিট; টা কিন্তু হয়েই গেল। হ্যাঁ থেরেসার সঙ্গে এক্সিট-এর পোর্টম্যান্টো বা হাঁসজারু সংস্করণ করে মে’র বিদায়টাকে এভাবেই এখন বর্ণনা করছে মিডিয়া। অল্প বয়স থেকেই ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হওয়াটাকে পাখির চোখ করে নাকি এগিয়েছিলেন থেরেসা মে। তাঁর সে লক্ষ্য পূর্ণ হয়েছে অবশ্যই। একটু বেশি বয়স হলেও। হ্যাঁ, ঊনষাট বছরে প্রধানমন্ত্রী হওয়াটা ব্রিটিশ রাজনীতির সাম্প্রতিক দস্তুর নয়। তবে, যেটা গুরুত্বপূর্ণ, তাঁর বিদায়-বেলায় দুঃখ করার লোকের বড্ড অভাব। সকলেই যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন। এমন প্রধানমন্ত্রী হতে নিশ্চয়ই চাননি থেরেসা মে। কেউই হতে চায় না।

আসলে থেরেসা মে যে ঠিক কতটা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, আর কতটা ছিলেন ব্রেক্সিটের অফিসার ইন চার্জ বলা কঠিন। তাঁর ক্ষমতার শীর্ষে ওঠাও ব্রেক্সিটের বিসর্পিল পথ ধরে। ব্রিটিশ জনতা বিস্ময়করভাবে ব্রেক্সিটের পক্ষে মত দিয়ে ফেলল ২০১৬-র দুনিয়া কাঁপানো গণভোটে। প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের বিদায়ে কনজারভেটিভ দল শুরু হলে নেতৃত্ব নিয়ে কুৎসিত কাড়াকাড়ি। সেই দৃশ্যপটেই শীর্ষপদে উত্তরণ থেরেসা মে-র । এই পটভূমিকে কিন্তু কখনও বিস্মৃত হননি মে। ব্রেক্সিটের প্রতি তিনি তাঁর আনুগত্য এবং দায়বদ্ধতাকে সঙ্গে করেই এগিয়েছেন। বরং প্রয়োজনের তুলনায় যেন খানিক বেশিই। সে পথে ভেসে গিয়েছে তাঁর প্রধানমন্ত্রীত্বের অন্য বিষয়গুলো। যেমন ক্ষমতায় এসে ডাউনিং ষ্ট্রিটের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে তিনি প্রতিশ্রæতি দিয়েছিলেন ‘জলন্ত অবিচার’-এর প্রতিকারের। সাতটি বিষয় ছিল তাতে।’ অথনৈতিক পরিস্থিতি, গৃহসমস্যা, বর্ণবৈষম্য, সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা, রোজগারের ক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্য এবং মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত। তিন বছরের পারে, এগুলোর সব ক‘টাতেই ব্রিটেন পিছিয়ে পড়েছে আরও। শিশু দারিদ্র সব চাইতে বেশি হয়েছে তিন দশকের মধ্যে, গৃহ সমস্যাও বেড়েছে। সেই সঙ্গে উইন্ডরাশ কেলেঙ্কারিও তাড়া করে ফিরছে থেরেসা মে-কে। আসলে থেরেসা মে’র প্রধানমন্ত্রিত্ব যেন ছায়াচ্ছন্ন একটি শব্দের আড়ালে- ‘ব্রেক্সিট’। তাঁর বিদেশ নীতি ও সমালোচনার মুখে। তুরস্ককে অস্ত্র বিক্রি, সৌদি আরবকে মদত দেওয়া নিয়ে সরব অনেকেই।

দলের প্রতি কিন্তু তীব্র দায়বদ্ধতকা দেখিয়েছেন থেরেসা মে। তবু, তাঁর শাসনকালে করজারভেটিভদের জনপ্রিয়তা কমেছে লক্ষণীয়ভাবে। জনসমর্থন বেড়েছে জেরেমি করবিন-এর নেতৃত্বাধীন লেবার পার্টির, আর নাইজেল ফ্যারাজ-এর বেক্সিট পার্টির । এ সবের অনেকটাই বেক্সিট নিয়ে থেরেসা মে’র কিংকর্তব্যবিমুঢ়তার জন্যে। ব্রেক্সিটের সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করে ফেলেছেন মে। ব্রিটিশ জনতা এবং রাজনীতিবিদদের যুগান্তের অজ্ঞানতা এবং হতভম্বতার দায়ভার তিনি নিজের উপর চেয়ে বসতে দিয়েছেন। ব্রেক্সিটের অভিঘাতে ব্রিটেনের অর্থনীতি টালমাটাল হয়ে উঠেছে বলে মনে করছেন অনেকে। স্টকল্যান্ডের উপর ব্রিটেনের দখলও আলগা হয়ে যাবার সম্ভাবনা। বিশেষ করে ব্রেক্সিটের ভোটে স্কটিশ জনতা ভোট দিয়েছিল ইউ-তে থেকে যাবার পক্ষে। স্কটিশ ফার্স্ট মিনিস্টার নিকোলা স্টারজন নির্ঘাৎ সঠিক সময়ের প্রতীক্ষায় আছেন, ব্রিটেন থেকে বেরোবার জন্য আর একটা গণভোটের অভীক্ষায়। এ সবের লিগ্যাসি তাই বয়ে বেড়াতে হবে মে-কেই।

জুনের ৭ তারিখে তিনি ছেড়েছেন করজারভেটিভ দলের নেতৃত্ব। জুলাইয়ের মধ্যে নতুন নেতা ঠিক হয়েছে। নতুন প্রধানমন্ত্রীও ব্রিটেন পেয়ে গেছে। লন্ডনের প্রাক্তন মেয়র এবং থেরেসা মে’র প্রাক্তন বিদেশ সচিব বরিস জনসন প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। কিন্তু থেরেসা মে’র প্রস্থানই ব্রিটেনের সব সমস্যার সমাধান করে দেবে, তেমনটা মনে করছেন না প্রায় কেউই।

ব্রেক্সিট নিয়ে ভুলের পাহাড় বানিয়ে গিয়েছেন থেরেসা মে। ব্রাসেলস-এর সঙ্গে তিনি ঠিক কী ধরনের চুক্তির কথা ভাবছেন, তা জানতে দেননি কাউকে, এমনকি নিজের দলের নেতাদেরও নয়। বিরোধী লেবার পার্টির সঙ্গে নিয়মিত আলোচনা করেননি। এমন একটা শতাব্দীর দিশা নির্ণায়ক ঘটনার গতি প্রকৃতি নিয়ে রাজনৈতিক ট্রেন্ড-কেও থেরেসা মে গড়তে পারেননি ঠিকঠাক। ব্রেক্সিটের পরের বছর নির্বাচনের অকাল-রোধন ডেকে দিয়েছেন, সংসদে নিজের শক্তিবৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে। তিন বছরের মধ্যে দেশজুড়ে তৃতীয় ভোট সেটা। ফল হয়েছে উলটো। ব্রিটিশ জনতা তার শক্তি খর্ব করে দিয়েছে। এর ফলে বরং পরবর্তী সময়কালে থেরেসা মে-র রাজনৈতিক ভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছিল আরও নড়বড়ে। তাঁকে নির্ভর করতে হয়েছে নর্দান আয়ারল্যান্ডের মৌলবাদী ছোট দলের উপরে। এবং অবশ্যই তাঁর নিজের দলের ইউরোপ-বিরোধী অংশের উপরে। নির্বাচনে গরিষ্ঠতা হারালে বদলাতে হয় কৌশল। এটাই রাজনীতি। মে কিন্তু সে পথে হাঁটেননি। কীভাবে ব্রেক্সিট হবে সে সম্পর্কে তাঁর নিজেরই কোনো স্পষ্ট পথ-নির্দেশিকা না- থাকা সত্তে¡ও তিনি বলবৎ করে দিয়েছেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছাড়ার আইন প্রক্রিয়া-আর্টিকেল ৫০, যা চালু করে দেয় দু’বছরের সময়সীমার ঘড়ি। আর এই ‘ডেডলাইন’-এর তাড়নায় এক অস্থির ফলহীন প্রক্রিয়া চলছে ব্রেক্সিট নিয়ে।

থেরেসা মে-র ভুলের এখানেই শেষ নয়। ‘ব্রেক্সিট’ নিয়ে গণভোটে ব্রিটিশ জনতা রায় দিয়েছিল ইইউ ছাড়ার পক্ষে। সেই বিচ্ছেদটা কী রকম হবে, সে নিয়ে কোনো রায় ছিল না জনগণের। তার সুযোগও ছিল না গণভোটে। গণভোটে ব্রেক্সিটের গরিষ্ঠতা ছিল খুবই অল্প ব্যবধানের। আর তা দেখে থেরেসা মে ইচ্ছে করলেই সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন ইউরোপীয় ‘কমন মার্কেট’ আর ‘ফ্রি- ট্রেড জোন’-এ থেকে যাওয়ার, ইইউ ছাড়লেও। কিন্তু তা না-করে সমস্যা বাড়িয়ে ফেললেন মে। উত্তর আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে রিপাবলিক অব আয়ারল্যান্ডের সীমানা নিয়ে সমস্যার সৃষ্টিও এর ফলে।

ব্রিটিশ জনতা হয়তো ঠিকঠাক না-বুঝেই ভোট দিয়ে ফেলেছে ব্রেক্সিটের পক্ষে। ইউরোপ থেকে বেরিয়ে আসা খুবই সহজ এবং লাভজনক এমনই মিথ্যের উপর হয়েছিল ব্রেক্সিটের প্রচার। থেরেসা মে ক্ষমতায় এসে কিন্তু জনগণের কাছে সেই মিথ্যেটার আররণ উন্মোচনের কোনো চেষ্টাই করেননি। পরিবর্তে এক প্রায়-অসম্ভব কাজের দায় নিয়েছেন নিজের কাঁধে। তাই যে দায় সকল ব্রেক্সিট পন্থী রাজনীতিবিদের, যে দায় ব্রিটিশ জনতার, তার দায়ভার আজ বর্তেছে থেরেসা মে’র কাঁধে।

থেরেসা মে’র এক সহকর্মী তাঁকে বলেছেন, পরিশ্রমী। কিন্তু তিনি গান বাঁধতে পারেন না, পারেন না কবিতা লিখতে। আর বড় পরিবর্তন করতে গেলে বোধহয় এটুকু দরকার। থেরেসা মে’র কি অনেক নমনীয় হওয়া উচিৎ ছিল, কিংবা সরে যাওয়া উচিৎ ছিল অনেক আগেই? বিশেষ করে যখন গত নভেম্বরে হাউস অফ কমন্স-এ তাঁর ব্রেক্সিট ডিল পরাজিত হয় একশো বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় ব্যবধানে।

থেরেসা মে কি স্মরণাতীত কালের সময়সীমায় সব চাইতে অযোগ্য ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী? এখনও আলোচনা দেখছি যে, অষ্টাদশ শতকে লর্ড নর্থের শাসনকালে যখন মার্কিন কলোনিগুলো স্বাধীনতা ঘোষণা করে, তার পরবর্তী সময়কালে থেরেসা মেই সবচেয়ে অযোগ্য ব্রিটিশ শাসক। ম্যাথু পেরিসের মত কলামিস্ট মে-কে বর্ণনা করেছেন আধুনিক ব্রিটিশ রাজনীতির মৃত নক্ষত্র হিসাবে। কে জানে, হয়তো একটু বেশিই অবিচার হয়ে যাচ্ছে মে’র উপর। ভবিষ্যৎ এর বিচার করবে।

নিউ ইয়র্ক টাইমস থেরেসা মে-কে তুলনা করেছে ‘গেম অব থ্রোন’- এর চূড়ান্ত সিজনের একদা শক্তিশালী এবং অংহকারী রানীর সঙ্গে। যিনি তাঁর দুর্গের শীর্ষে দাঁড়িয়ে আছেন প্রায় একাই। তাঁকে ছেড়ে গিয়েছে সবাই-যারা তাঁকে ভয় পেত এবং তাঁর অনুসরণ করত। ছেড়ে গিয়েছেন তাঁর নির্ভরযোগ্য সেনাপতিও। তাঁর সব কৌশল শেষ হয়ে গিয়েছে। থেরেসা মে-র প্রধানমন্ত্রীত্বও শেষ হয়েছে তাঁর অন্ধত্ব এবং গোপনীয়তার প্রাবল্যে এক একাকিত্ব এবং হতাশার মধ্যে।

বাস্তবিক অর্থেই ব্রেক্সিট যেন এক অজানা রাজনৈতিক কৃষ্ণ-গহ্বর। দুই প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক জীবনের সমাপ্তি ঘটল ব্রেক্সিটের ফলে। এখন ব্রেক্সিটের আগেই ‘বরিস-এক্সিট’ ঘটে যায় কিনা, সেটাই দেখার বিষয়।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন