পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ আগাগোড়া একটি বিশিষ্টতা অর্জন করেছে। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ত্রিশের দশকে কলকাতায় লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলিতে এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের গণপরিষদে এর সপক্ষে দৃঢ় বক্তব্য রেখেছেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের ঐতিহাসিক ২১ দফায় এটিই ছিল অন্যতম দাবি। ১৯৫৭ সালে ঢাকায় প্রাদেশিক পরিষদে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ বিল পাস হলেও সেটি আর কার্যকর হয়নি। এই প্রেক্ষাপটে ১৯৭২ সালে বাহাত্তরের সংবিধান রচয়িতাগণ প্রথম সুযোগেই প্রজাতন্ত্রের বিচারিক ক্ষমতা যাতে সর্বতোভাবে সুপ্রিম কোর্টের হাতেই ন্যস্ত থাকে, সে কারণে সংবিধানের ২২, ১০৯ এবং ১১৬ অনুচ্ছেদ সুরক্ষা দিয়েছিলেন। কিন্তু ঔপনিবেশিক ও পাকিস্তানি প্রশাসনের ধারাবাহিকতার প্রতি বিশ্বস্ত থাকা ব্যক্তিবর্গ তা যাতে বাস্তবায়ন না হয়, সেদিকে সজাগ নজর রাখে। সে কারণে তারা বিচার বিভাগের পৃথকীকরণকে কোনো দিনই মেনে নেয়নি।
বাংলাদেশের ইতিহাসে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণে আওয়ামী লীগ আমলেই যে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটেছে, সেটাও অনস্বীকার্য। দু’টি বড় উদাহরণ। মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সরকারের প্রথম মেয়াদে সুপ্রিম কোর্টকে আর্থিক স্বায়ত্তশাসন দিয়েছিলেন। আর দ্বিতীয় মেয়াদের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণকে পার্লামেন্টে আইনের মাধ্যমে স্থায়ী রূপ দিয়েছিলেন। কিন্তু আজকে যেটা উদ্বেগের বিষয়, সেটা হলো সরকারি কর্মকর্তাদের দিয়ে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা এবং তারই ধারাবাহিকতায় ডিসি সম্মেলনে ফৌজদারি অপরাধ আমলে নিয়ে সংক্ষিপ্ত বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষমতা লাভে ডিসিদের পরিকল্পনা। এ জন্য তারা সিআরপিসির ১৯০-এর ৪ নম্বর উপবিধি বাতিল করে ১ নম্বর উপবিধি সংশোধন করে ‘ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট অ্যান্ড এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট’ যুক্ত করার সুপারিশ করার পরিকল্পনা করে। তারা বিদ্যমান মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে আর সন্তুষ্ট নন। তারা অপরাধ আমলে নেয়ার ক্ষমতা চান। এটা পরিতাপের বিষয় যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে প্রণীত বাহাত্তরের সংবিধানের বিধানের পরিপন্থী জেনেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ডিসি সম্মেলন এলেই ১৯০ ধারার আওতায় আরো বিচারিক ক্ষমতা অর্জন করতে তারা দেনদরবার করে চলছেন।
আমরা বিনীতভাবে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, বিশ্বব্যাপী মোবাইল কোর্ট আছে। কিন্তু তা কোথাও পাবলিক সার্ভেন্টরা পরিচালনা করেন না। ২০১৭ সালে হাইকোর্ট বিভাগ ২০০৯ সালের মোবাইল কোর্ট আইন বাতিল করেছেন। বর্তমানে যা আপিল বিভাগে বিচারাধীন রয়েছে। তবে ওই আইন সর্বতোভাবে বাহাত্তরের সংবিধানকে প্রতিনিয়ত আঘাত করে চলছে। মোবাইল কোর্ট অসাংবিধানিক। আর এভাবে একটি সমান্তরাল বিচার বিভাগ গড়ে তোলাও ভীষণ ক্ষতিকর। আমাদের জানা মতে, এখন অপরাধ আমলে নেয়ার পক্ষে যুক্তি দেয়া হচ্ছে যে, বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারভুক্ত এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটরা বেআইনি সমাবেশ প্রতিহত, অবৈধ দখল উচ্ছেদ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণসহ ১০৪টি আইনে নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেন। মোবাইল কোর্টের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে অবগত অপরাধীরা প্রায়ই দোষ স্বীকার না করায় তাদের মোবাইল কোর্টের আওতায় বিচার করা যায় না। ফলে সাধারণ মানুষ ভুক্তভোগী হন এবং তাৎক্ষণিক ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হন। কিন্তু কথা হলো, বিশ্বের কোনো বিচারব্যবস্থায় অপরাধীর দ্বারা দোষ স্বীকার করানো সাপেক্ষে কোনো বিচার চলে না। তাই এটা একটা কৃত্রিম সীমাবদ্ধতা। এটা একটি কৃত্রিম আইন, যার সূচনা হয়েছিল এক-এগারোতে। পাবলিক সার্ভেন্ট দ্বারা পরিচালিত মোবাইল কোর্ট আইন প্রকারান্তরে একটি সামরিক ফরমান। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট সব পরিস্থিতিতে সামরিক ফরমানকে চিরকালের জন্য অবৈধ ঘোষণা করেছেন।
তাই ডিসিদের অপরাধ আমলে নেয়ার ক্ষমতাদানের বিষয়টি অসাংবিধানিক। বিশেষ করে ২০০৯ সালের মোবাইল কোর্ট আইনের ১৪টি ধারা ও উপধারা অবৈধ ও অসংবিধানিক ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের করা লিভ টু আপিলের শুনানি না হওয়া পর্যন্ত এখন নতুন করে মেবাাইল কোর্ট আইনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যেকোনো পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে ডকট্রিন অব সাব জুডিস-এ কী প্রভাব ফেলবে সেটা বিচার্য। আমরা আইনগতসহ সকল পরিস্থিতি বিবেচনায় মনে করি, পাবলিক সার্ভেন্টদের বিচারিক ক্ষমতা দেয়া মোটেই সমীচীন নয়।
লেখক: চেয়ারম্যান, হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশন
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।